২০১৪ সাল পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে একটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ সময়। স্বাধীনতার আগে বা পরে যা কখনো ঘটেনি তা ঘটিয়ে ফেলেছে পশ্চিমবঙ্গের মমতা সরকার। তালিকা দীর্ঘ। তাই সংক্ষেপে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে হতভাগ্য পশ্চিমবঙ্গের জনগণ পরিবর্তনের নামে পেয়েছে একটি দুর্নীতিপরায়ণ সরকার। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও পৌঁছে গেছে তৃণমূল সরকারের দুর্নীতির কথা। আর এসবই হয়েছে তৃণমূলের মা-মাটি-মানুষের সরকারের প্রধানের রাজত্বে। রাজ্যের মানুষ সম্পূর্ণ দিশাহারা, কোন পথে যাবেন তারা। তারা যে আশা নিয়ে ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়েছিলেন সে আশা হতাশায় পরিণত হয়েছে। বিগত শতকের নয়ের দশকের শেষ দিকে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে হাত ধরে বিজেপিকে এ রাজ্যে নিয়ে এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দিল্লিতে ক্ষমতায় আসার পর এ রাজ্যেও বিজেপির বাড়বাড়ন্ত হওয়ায় সে দিদিমণিই ঘাবড়ে গেছেন। তাদের সঙ্গে ঘর করার সুবাদে তিনি দ্রুত বুঝতে পেরেছেন বিজেপির উদ্দেশ্য কী। তিনিও তার পাল্টা হিসেবে ভোটব্যাংক তৈরির জন্য '৭১ সালের পর বাংলাদেশ থেকে যেসব রাজাকার এ রাজ্যে ঢুকেছে তাদের নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার চেষ্টার কসুর করেননি। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পর তার এই চেষ্টা ধরা পড়ে গেছে। ২০১৪ সালই ছিল মমতার পক্ষে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। মন্ত্রী থাকাকালীন দুর্নীতির দায়ে জেলে গেছেন তৃণমূলের একাধিক নেতা-মন্ত্রী। তবুও এখনো পর্যন্ত কাউকে তিনি দল থেকে তাড়াননি। বরং প্রকাশ্যে তাদের পাশে থাকার বার্তাই দিয়েছেন।
২০১৪ সালের উল্লেখযোগ্য ঘটনার মধ্যে আছে বর্ধমান কাণ্ড, সারদাকাণ্ড। বর্তমানে তার দলের চার সাংসদ দুর্নীতির দায়ে জেল খাটছেন। ঘটনার বিরাম নেই। যে বছরটি সদ্য শেষ হলো সে বছরে ধর্ষণ, খুন, লুট, জমি দখল, শিক্ষক পেটাও- সব মিলিয়ে বাঙালিকে কোণঠাসা করে রেখেছিল। ভারত সরকার থেকে বারবার সতর্ক করে দিয়ে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের জামায়াত ও জেএমবি সন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে তৃণমূলের যোগসূত্র রয়েছে। এ সুযোগটি পুরোপুরি কাজে লাগাচ্ছে বিজেপি। নয়ের দশকের শেষ দিকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন বিজেপিকে এ রাজ্যে নিয়ে এলেন সে সময় প্রয়াত জ্যোতিবসু বলেছিলেন, মমতার সব সহ্য করা যায়, কিন্তু এ রাজ্যে বিজেপিকে নিয়ে আসা রাজ্যের মানুষ ক্ষমা করবেন না।
কার্যত জ্যোতিবাবুর কথার সত্যতা আজ এ রাজ্যের মানুষ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন। বিজেপি যতটা না ক্ষতিকর তার চেয়েও বেশি ক্ষতিকর সংঘ পরিবার। সংঘ পরিবার গত সাত আট মাসে রাজ্যের প্রায় প্রতিটি ব্লকে তাদের শাখা খুলে ফেলেছে। আর তাতে মদদ দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসই। রোজই তৃণমূল থেকে দলে দলে লোক যোগ দিচ্ছে বিজেপিতে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ থেকে দুটি আসন পায়। চার শতাংশ থেকে তাদের ভোট বেড়ে হয় ১৬ শতাংশ। উপনির্বাচনেও তারা সীমান্ত এলাকায় একটি আসন দখল করে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি নিম্নগামী। এমন দিন নেই লুট-খুন-ধর্ষণের খবর প্রথম পাতায় থাকে না। মমতা ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করেছিলেন তার সরকার সংখ্যালঘুদের জন্য বহুমুখী পরিকল্পনা নিয়েছে। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল কেন্দ্রীয় সরকার গত বছর সংখ্যালঘু উন্নয়নের জন্য ২০০০ কোটি টাকা দিয়েছিল। মমতা সরকার তার ৫০ ভাগ টাকাই ফেরত পাঠিয়েছে খরচ না করতে পেরে।
গত লোকসভা ভোটে ধাক্কা খাওয়ার পর চুপ করে বসে নেই বামপন্থিরাও। পিছিয়ে নেই কংগ্রেসও। রাজনৈতিক মহল মনে করে সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি এবং দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলকে রুখতে সিপিএম তথা বামফ্রন্ট এবং কংগ্রেস আগামী দিনে একই সঙ্গে হাঁটবে। প্রস্তাবটা প্রকাশ্যে এসেছে সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেবের মুখ থেকে। একটু পেছনের দিকে তাকালে দেখা যাবে ১৯৫২ সাল থেকে কংগ্রেসের স্বাভাবিক বন্ধু বামপন্থিরা। নেহরু এবং ইন্দিরা উভয়ই সোভিয়েতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলেছেন। ১৯৬৯ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাননি তখন বামপন্থিরাই দক্ষিণপন্থিদের হাত থেকে দেশকে বাঁচানোর জন্য ইন্দিরাকে সমর্থন করেছিলেন। ১৯৯১-৯৬ পিভি নরসিমা রাওয়ের সরকারকেও বামপন্থিরা বাইরে থেকে সমর্থন করেছিল। সিপিএম পলিটব্যুরোর অনেক সদস্যই মনে করছেন বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদ এবং তৃণমূলের সন্ত্রাসবাদকে রোখার জন্য কংগ্রেস ও বামপন্থিদের কাছাকাছি আসতেই হবে।
মমতার কাজকর্মে চমকের অভাব নেই। সম্প্রতি তিনি ঘোষণা করেছেন ৫০ হাজার টাকা দিলে তার দলের আজীবন সদস্যপদ পাওয়া যাবে। এতদিন ক্লাবে এই ধরনের আজীবন সদস্যপদের কথা শোনা যেত। কোনো রাজনৈতিক দলের আজীবন সদস্য হওয়ার কথা এভাবে শোনা যায়নি। তার বিরোধীরা সবাই একমত যে, সারদা এবং রোজভ্যালির কোটি কোটি কালো টাকা এভাবেই সাদা করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেস। তিনি হয়তো ভুলে গেছেন, কেন্দ্রে এখন মোদি সরকার ক্ষমতায়। তারা বিভিন্ন এজেন্সিকে দিয়ে খবর সংগ্রহ করা শুরু করে দিয়েছে।
এতদিন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধিতা করার পর এখন তিনি দূত পাঠিয়ে ঢাকায় তাকে আমন্ত্রণ জানানোর বার্তা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর ঢাকা সফরের আগে সীমান্ত চুক্তির জন্য আইন সংশোধন করে নিতে চান। সেই প্রক্রিয়া মার্চের আগে শেষ হবে না। কারণ ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হবে বাজেট অধিবেশন। সীমান্ত চুক্তির বিল পাস হতে হতে মার্চ মাস হয়ে যাবে। এই দেরির জন্য দায়ীও মমতা। ইউপিএ আমলে এই বিল পাস করাতে বারবার বাধা দিয়েছেন মমতা।
এককথায় যে বছরটা চলে গেল সেটি ছিল পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন বা তারাশঙ্করের লাভপুর যে জেলায় সেই বীরভূমে দিনের পর দিন খুন-জখম-ধর্ষণ হয়েই চলেছে। আর কলকাতায় বসে মমতা বলেই চলেছেন কিছুই হয়নি। কিন্তু কলকাতা ছাড়লেই বোঝা যাচ্ছে কী পরিবর্তন ঘটেছে। বহু মানুষ ঘরছাড়া। গ্রামবাংলার কৃষক, শ্রমিক আক্রান্ত। তিনি যে সততার প্রতীক হয়ে বাংলার মন জয় করেছিলেন তা ফাঁস হয়ে গেছে। সারদা কাণ্ড থেকে দলের মেম্বারশিপ- সর্বত্রই তার অসততার ছাপ ফুটে উঠছে।
বিগত বছরে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকার আইনশৃঙ্খলা ঠেকানোর নামে বিরোধী দলগুলোর বহু যুবক-যুবতীকে বিনাকারণে বেআইনিভাবে বন্দী করে রেখেছে। এতদিন ঘরে বসে থাকা বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস গত সেপ্টেম্বর থেকে পৃথকভাবে জেলায় জেলায় আন্দোলন শুরু করেছে। তাদের আন্দোলন, দক্ষিণপন্থি বিজেপি ও সন্ত্রাসবাদী তৃণমূলকে রোখার জন্য যে কোনোভাবেই হোক জনগণের কাছে যেতে হবে। গণতন্ত্রে শেষ কথা বলে জনগণ। সেই জনগণ অনেক অত্যাচারিত হয়েছে দার্জিলিং থেকে দীঘা- সর্বত্র। সর্বত্র চরম অরাজকতা মানুষকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে রাজ্য রাজনীতি নতুন বছরের শুরুতে জমজমাট হয়ে রয়েছে। মমতা যে সবচেয়ে বড় দুর্নীতিপরায়ণ তা মানুষ জেনে গেছেন। অলিগলিতে শোনা যাচ্ছে- মমতা এবং তার দল যেভাবে লুটতরাজ চালাচ্ছে তা ঠেকানোর উপায় কী? ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে তিনি যে আর এগোতে পারবেন না, তা পরিষ্কার হয়ে গেছে। নতুন বছর কীভাবে যাবে তা নির্ভর করবে পরিস্থিতির ওপর।
যেহেতু রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা একেবারে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে তাই মমতাপন্থি শিল্পপতিরা তাকে বারবার সতর্ক করছেন- আপনি জমি নীতি নিয়ে অন্য পথে হাঁটবেন না। কেন্দ্র যে অর্ডিন্যান্স এনেছে তা মেনে নিন। কিন্তু এও প্রকাশ্যে এসেছে যে সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে যে আন্দোলনের ভিত্তিতে তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন তাতে মমতা বা তার দলের খুব একটা ভূমিকা ছিল না। বরং বড় ভূমিকা ছিল মাওবাদীদের। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর সেই মাওবাদীদের নেতা কিষেণজিকে সন্ত্রাসবাদ দমনের নামে 'অ্যানকাউন্টার' করিয়ে হত্যা করা হয়। ওই আন্দোলনের সময় কিষেণজি বলেছিলেন- আমি মমতাকে মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চাই। তার স্বপ্ন হয়তো সত্যি হয়েছে। কিন্তু তিনি আর নেই।
লেখক : প্রবীণ ভারতীয় সাংবাদিক।