সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ বাংলাদেশ। মানচিত্র বা ভৌগোলিক সীমারেখা দিয়ে বিচার করলে অতি ক্ষুদ্র। জনসংখ্যার তুলনা করলে অনেকেরই চোখ চলে যায় কপালে, এমনকি মাথার পেছনে। ভাবেন, এ কি করে সম্ভব। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশ। বাঙালি পারে না, এমন কিছুই নেই। ৯ মাসে স্বাধীনতা লাভ। ভাষা আন্দোলন এবং তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। কুখ্যাত হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বাতিলের আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, '৭০-এর নির্বাচন। কি-না করল বাঙালি! পৃথিবীর কোনো দেশে কি এত ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে? সব ইতিহাসের দেশ বাংলাদেশ। তবে খারাপ ইতিহাস যে নেই, তা নয়, নতুন প্রজন্মকে তা বাদ দিতে হবে।
২০১৪ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরে এই ক্ষুদ্র দেশটি, বিশ্বের প্রভাবশালী বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ছাড়াও বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক ফোরামের নেতৃত্ব লাভ করেছে, বিভিন্ন দেশের সঙ্গে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সংস্থার নেতৃত্ব লাভ, সরাসরি ভোটে জয়ী হওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি কঠিন এবং গৌরবের অর্জন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিরল নেতৃত্বে অর্জিত হয়েছে সুবিশাল বিজয়। জানি না, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ইতিহাসবিদ এবং বিশ্বের রাজনৈতিক নেতারা এই বিজয়কে কীভাবে বিশ্লেষণ করবেন। এর মধ্যেও কি কোনো রাজনীতি আছে? রাজনীতি বলতে আন্তর্জাতিক চক্রান্তকে বুঝাচ্ছি।
বাংলাদেশ ইতিমধ্যে গণতান্ত্রিক বিশ্বকে তাক লাগিয়ে জয় করে নিয়েছে কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারপারসনের পদটি। নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ৯ অক্টোবর, ২০১৪ যেখানে বিজয়ী হন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের মাননীয় স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি ক্যামেন আইল্যান্ডের প্রার্থীকে হারান ৭০-৬৭ ভোটে। তিনি নির্বাচিত হন আগামী তিন বছরের জন্য। উনার বিজয়ে আমরা গৌরবান্বিত। যথাযথ কারণও রয়েছে, কেননা তিনি ২০০৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সম্মানিত সদস্য হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি প্রণয়ন, সংশোধনসহ বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেছেন। ওই সিন্ডিকেটের চেয়ার লেখক নিজে। কিন্তু নিঃসংকোচিত্তে বলছি, উনার ভূমিকা ছিল প্রশাসন এবং চেয়ারের চেয়েও অনেক বেশি। আমাদের বর্তমান তরুণ প্রজন্মের জন্য দুটো লাইন লিখছি, উনার সম্পর্কে। একই সঙ্গে অভিভাবকরাও নিশ্চয়ই উনার অভিভাবকদের কাছ থেকে শিখতে পারবেন। ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী আইন শাস্ত্রে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করে আইন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত রাখেন। রক্তে যার রাজনীতি বহমান তাকে তো সবসময় রাজনীতির কাছেই থাকতে হয়। শুধু রাজনীতির কাছে নয়, এখন রাজনীতির আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু জাতীয় সংসদের অভিভাবক। কি ছিল তার ছাত্র হিসেবে উৎকর্ষতা? এসএসসি পরীক্ষায় ঢাকা বোর্ডে প্রথম, এইচএসসিতে একই বোর্ডে মেধাতালিকায় দ্বিতীয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন শাস্ত্রে অনার্স এবং মাস্টারস পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। উনার বাবা জনাব রফিকউল্লাহ চৌধুরী ১৯৫৮ সালে বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের প্রথম নির্বাচিত সভাপতি, পরবর্তীতে একজন সিএসপি। বঙ্গবন্ধু সরকারের একজন সচিব ছিলেন। রত্নগর্ভা মা, অধ্যাপিকা নায়ার সুলতানা, যিনি ইডেন কলেজের উদ্ভিদ বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন। পরবর্তীতে ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ, শিক্ষা অধিদফতরের ডিজি এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্য হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।
বিশ্বের প্রভাবশালী সংস্থা ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সভাপতির পদ, যেখানে বাংলাদেশের প্রার্থী জনাব সাবের হোসেন চৌধুরী এমপির (আইপিইউ) দখলে। যেখানে বাংলাদেশ পেয়েছে ১৬৯ ভোট পক্ষান্তরে অস্ট্রেলিয়া মাত্র ৯৫ ভোট। সরকারের পক্ষ থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বিচক্ষণতার সাহায্যে এই দুজন যোগ্য প্রার্থীকে মনোনীত করতে পেরেছিলেন বলেই হয়তো তা সম্ভব হয়েছে।
জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের সদস্য পদে বাংলাদেশ পুনরায় তিন বছরের জন্য অর্থাৎ ২০১৫-২০১৭ সালের জন্য নির্বাচিত হয়েছেন ১৪৯ ভোট পেয়ে। অন্যান্য তিনটি দেশ হলো ভারত (১৬২), ইন্দোনেশিয়া (১৫২), কাতার (১৪২)।
জাতিসংঘের নারীর বিরুদ্ধে বৈষম্য দূরীকরণ কমিটিসহ Convention on the Elimination of Discrimination Against Womens (CEDAW)-এর সদস্য পদে নির্বাচিত হয়েছেন রাষ্ট্রদূত ইশমত জাহান। ১২টি পদের নির্বাচনে বাংলাদেশ সর্বোচ্চ ১৫৩ ভোট পেয়ে নির্বাচিত। তারপরে জাপান (১৪৩), তুরস্ক (১৩২), স্লোভেনিয়া (১৩০), মিসর (১৩০), সুইজারল্যান্ড (১২৯), প্যারাগুয়ে (১১৯), ক্রোয়েশিয়া (১১৮), মরিশাস (১১৪), তিমোর লিসতে (১১৩), ইসরায়েল (১০৩) এবং আলজেরিয়া (৯৬)।
দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক টেলিযোগ ইউনিয়নের (ITU) কাউন্সিল সদস্য পদে জয়লাভ করেছে বাংলাদেশ। ১২টি নির্বাচিত দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছিল সপ্তম স্থানে ২১৫ ভোট পেয়ে। বাংলাদেশের পেছনে ছিল ফিলিপাইন, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, ভারত ও পাকিস্তান। যেখানে ভোটাভুটিতে অংশ নেন ১৯৩টি জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত দেশ এবং বেসরকারি খাতের বিভিন্ন সংগঠন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ৪৮০ জন সদস্য। এ নির্বাচন ২০১৫-২০১৮ অর্থাৎ চার বছরের জন্য। গত বছরের এপ্রিলে আগামী তিন বছরের (২০১৫-২০১৭) সালের জন্য ইউনিসেফ নির্বাহী বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ। এরপর মে মাসে এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আস্থা বৃদ্ধি ও সংলাপবিষয়ক সংস্থা কনফারেন্স অন ইন্টারএকশান এবং কনফিডেন্স বিল্ডিং ইন এশিয়ার (সিকার) পূর্ণ সদস্য পদ পায় বাংলাদেশ। গত বছরের জুন মাসে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (ILO) পরিচালনা পর্ষদের ডেপুটি মেম্বার নির্বাচিত হয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে জয় এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য এবং সৎ নেতৃত্বে নির্বাচন এবং আন্তর্জাতিক প্রত্যেকটি সংস্থার নির্বাচনে বাংলাদেশের বিপুল এবং গর্বিত বিজয় এ সরকারের প্রতি বিশ্ব নেতৃত্বের আস্থার ফসল।
লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।