সরকারি-বেসরকারি মিলে অবরোধের মনে হয় আজ ১৭ দিন। আর কত দিন চলবে তা পাক পরোয়ারদিগার ছাড়া কেউ জানেন না। সভ্য সমাজে অরাজকতার একটা শেষ থাকে, এখানে তাও নেই। ইতিমধ্যে তুরাগ নদের তীরে দুই পর্বে বিশ্ব ইজতেমা মোটামুটি নির্বিঘ্নেই শেষ হয়েছে। লাখো ধর্মপ্রাণ মুসলমানের অংশগ্রহণের ব্যাপারে অবরোধকারীদের কোনো দয়ামায়া দেখা যায়নি, সরকারও নির্বিকার। সরকারের কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন, কোনো আলোচনা নয়। তারা ১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবেন। কথা বলতে কোনো কর লাগে না, তাই বলতেই পারেন। হানাদাররাও মুক্তিযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জীবন বাঁচাতে আলোচনা করে অস্ত্র সমর্পণ করেছে- সবসময় এমনই হয়। জানি এক সময় অবশ্যই তারা কথাবার্তা বলবেন, নমনীয় হবেন। কিন্তু যখন হবেন তখন পিছু ফিরে দেখবেন দেশের সর্বনাশ হয়ে গেছে। গার্মেন্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, তাদের প্রতিদিনের ক্ষতি কয়েকশ কোটি। সারা দেশে দুই-আড়াই হাজার কোটি টাকা। মানলাম যাদের খুঁটি আছে, তাদের না হয় কোটিতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু যারা দিন এনে দিন খায় তাদের কী হবে? যারা রাত-দিন গাধার খাটুনি খেটে সবজি ফলিয়েছে, ২-৪-১০ দিনের মধ্যে তা বিক্রি করতে না পারলে সবই মাটি- তাদের কী হবে? পত্রিকায় পড়লাম, এক বস্তা বেগুনের দাম ২০০ টাকা। যেখানে এক কেজি বেগুন ৪০-৫০ টাকা, সেখানে ৬০-৭০ কেজি যদি ২০০ টাকা হয় কৃষক যাবে কোথায়? ক্ষুদ্র চাষিদের উপায় কী? যারা গাড়ি-ঘোড়ায় কাজ করে জীবন চালায় অবরোধের কারণে তাদের মুখের দিকে তাকানো যায় না। মরা গরু নিয়ে শকুন যেমন কাড়াকাড়ি করে, তেমন দেশবাসীকে নিয়ে রাজনীতির কাড়াকাড়ি, হানাহানি। মানুষ কত কথা বলে, রাস্তায় বেরুলেই লোকজন চেপে ধরে, 'কিছু একটা করুন'। সাধারণ মানুষ তো বলেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের কত প্রবীণ প্রফেসর, সাহিত্যিক, সাংবাদিক নানা স্তরের গুণীজনও বলেন। কেউ বুঝতে চায় না। তাদের কী করে বুঝাই, মরার আগে আর আমাদের তেমন কিছু করার নেই। আমরা যত চিৎকারই করি, একদিকে জননেত্রী শেখ হাসিনা, অন্যদিকে বেগম খালেদা জিয়া- কেউ শুনবেন না। একবার মাথায় রক্ত উঠলে কারও কথা কেউ শুনে না। এর আগেও কেউ কখনো কারও কথা শুনেনি। তাই এক্ষেত্রে তেমনটা হবে কেন? কোনো মানুষ যখন প্রথম প্রথম মিথ্যে বলে, তখন যন্ত্রণায় সে ছটফট করে। কিন্তু আস্তে আস্তে ধীরে ধীরে মিথ্যে বলতে বলতে গা-সওয়া হয়ে গেলে আর কোনো কষ্ট থাকে না। বরং যারা মিথ্যে শুনে, অন্যায় দেখে তাদেরই কষ্ট হয়। আমাদের মহান নেতা-নেত্রীদের ক্ষেত্রেও তেমন হয়েছে। মানুষ কী অবস্থায় আছে সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই, সবাই আছে নিজের ক্ষমতা নিয়ে। ব্রিটিশকে তাড়াতে যারা জীবন দিয়েছে, পাকিস্তানের বৈষম্যের বিরুদ্ধে একটা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে যে শহীদরা দেশ স্বাধীন করেছে আজ তাদের সে সব আশাও মিথ্যে হতে চলেছে। পাকিস্তানের ২২ পরিবারের হাত থেকে মুক্তি পেতে বাংলার জনগণ ফুঁসে উঠেছিল। কিন্তু আজ বাংলাদেশে কত পরিবার। কিন্তু প্রতিকারের তেমন কোনো পথ নেই। নিজের জীবন এবং সন্তান-সন্ততির ভূত-ভবিষ্যৎ আগামীকাল কী হবে তা নিয়ে ভাবার সময় পাচ্ছে না। সবাই আশা করে, নিজের যত কষ্টই হোক ভাবি বংশধরদের একটা সুন্দর নিরাপদ জীবন দিয়ে যাবে। কিন্তু সেটা আজ বাংলাদেশের মানুষের কাছে এক অলীক স্বপ্ন। দেশ ও সমাজ যখন বিশৃঙ্খল হয়, তখন সাধারণ নাগরিকের তেমন কোনো নিরাপত্তা থাকে না। রাস্তাঘাটে মারামারি, হানাহানি, মানুষের প্রতি মানুষের অশ্রদ্ধা, কেউ কাউকে বিশ্বাস না করা- এক মহামারীর আকার ধারণ করেছে। প্রশাসনে সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই, সমাজের কোনো প্রভাব নেই। যে যেভাবে পারছে সব কেন যেন এক ফ্রি স্টাইল।
নতুন বছরে পুলিশ বিভাগে এক ব্যাপক রদবদল হয়েছে। পুলিশের আইজি, ডিএমপি কমিশনার, র্যাবের ডিজি, বিজিবির অনেকেই নতুন। তাই যা সব শুনছি, গা শিউরে উঠছে। জানতাম এরা প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের ভক্ত-অনুরক্ত। কিন্তু এতটা আশা করিনি। উপরের সরকারি কর্মচারীরা সবসময় সরকারের পছন্দের হয়। কিন্তু এত পছন্দের হয় তা আগে জানতাম না বা বুঝতাম না। পুলিশের আইজি যদি সংবিধান নিয়ে কথা বলে তাহলে দেশবাসীর আত্দহত্যা করা ছাড়া উপায় কী? উচ্চপর্যায়ের এই সরকারি কর্মকর্তাদের পদত্যাগ করে এখনই রাজনীতিতে শরিক হওয়া উচিত। এ কদিন তারা যে যা বলেছেন একটাও সরকারি কর্মচারীর কথা নয়, সবই রাজনৈতিক নেতাদের কথা। সরকার হয়তো মনে করছে, পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এসব কথাবার্তায় তাদের উপকার হচ্ছে। কিন্তু এই কথাবার্তায়ই এক সময় তাদের সর্বনাশ হবে। শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো কর্মকর্তা বলতে পারেন কাউকে গুলি করতে? প্রথমে পায়ে, তারপর বুকে? শুধু এই উদ্যতপূর্ণ কথার জন্যই সভ্য দেশ হলে ভদ্রলোক চাকরি খোয়াত এবং সাজা পেত। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হওয়ার আগেই পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি হয়েছে বিশ্বব্যাংকের এমন অভিযোগে জনাব আবুল হোসেনের মন্ত্রিত্ব যেতে পারে তাহলে এমন দম্ভোক্তির জন্য ওই সব কর্মকর্তার কেন শাস্তি হতে পারে না? অবশ্যই হতে পারে এবং হলে সেটাই হতো যথার্থ। জানি না, এই কর্মকর্তারা বর্তমান সরকারকে কোথায় নিয়ে যাবে?
এদিকে জোট সরকারের শরিক দল জাসদের নেতা মঈনুদ্দিন খান বাদল এখনো এই বুড়ো বয়সে যেভাবে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন, বুকে গুলি করতে বলছেন। এখন ভেবে দেখুন, জোয়ানকালে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে এরা কি-না করেছে। স্বাধীনতার পরপরই জাতির পিতার সরকারকে ব্যর্থ ও ধ্বংস করতে থানায় হামলা, পাটের গুদামে আগুন, প্রকাশ্য জনপদে আওয়ামী নেতাদের খুনখারাবি কোনো কিছু বাদ রাখেননি। অথচ আজ তারাই উপদেশ দিচ্ছেন এবং সেসব উপদেশ অনেকে আবার অলঙ্ঘনীয় বাণী হিসেবে মেনেও নিচ্ছেন। তাই সাধারণ মানুষ রাস্তায় না নামলে আমি তো এর কোনো সমাধান দেখতে পাচ্ছি না।
যখন যেখানেই গায়ের জোরে দেশ চলেছে সেখানেই এমন প্রশ্ন এসেছে, অরাজকতা দেখা দিয়েছে। স্বাভাবিক নিয়মেও হয়তো এ দুঃসময় কেটে যাবে। কিন্তু আমরা যদি সবাই মিলে চেষ্টা করে এই দুঃসময়ের যাতনা কিছুটা কমাতে পারতাম তাহলে সেটাই হতো আমাদের যোগ্যতা। সংসদ ভবনের মতো নিরাপদ এলাকার আশপাশে গাড়িতে বোমা, কলেজছাত্রী আহত- এ নিয়ে কী আমাদের লজ্জা পাওয়ার কথা নয়? সরকারি আসনে বসে তারস্বরে বললেই কী হবে, বিরোধী দল গাড়িতে বোমা মেরেছে? আন্দোলনকারীদের দমনের জন্য সরকারের হাতে কত মাধ্যম রয়েছে, সেসব যোগ্যতার সঙ্গে প্রয়োগ করতে হয়। বোমা মারতে কাউকে হাতেনাতে ধরে জেলে দিলে, শাস্তি দিলে কে প্রতিবাদ করবে? কেউ করবে না। সরকারি অন্যায়ের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নামলে সেখানে বাধা দেওয়া অগণতান্ত্রিক-স্বৈরাচারী কাজ কিন্তু রাস্তাঘাটে জ্বালাও-পোড়াও, গাড়িতে আগুন দেওয়া ফেরাতে না পারা সরকারি ব্যর্থতা। সেক্ষেত্রে বিরোধী দলকে বলে কোনো লাভ নেই। বিরোধী দল আন্দোলন করতে পারে, গাড়িতে আগুন দিতে পারে না, আগুন দেওয়া আন্দোলনের মধ্যে পড়ে না। এমনকি বিরোধী দলের কর্মীরা দিলেও সেটা আন্দোলনের অংশ নয়। সরকার যদি ভেবে থাকেন উদাসীনভাবে গা এলিয়ে দিলেই তারা টিকে যাবেন তাহলে আহম্মকের স্বর্গে বাস করছেন। মানুষের জানমালের হেফাজত, অর্থনীতি সচল রাখা, সভ্য দুনিয়ার কাছে দেশের সম্মান অক্ষুণ্ন রাখা- এসব বিরোধী দলের কাজ নয়, এসব সরকারের বোঝা। সে বোঝা তাকে বইতেই হবে।
গুলশানের অমন নিরাপদ স্থানে বেগম খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা, নির্ভেজাল কূটনীতিক, একজন সজ্জন ব্যক্তি রিয়াজ রহমান আক্রান্ত হলেন, তার গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হলো, এতে কী সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হলো? পত্রপত্রিকায় দেখলাম, তার পায়ের আঘাতে কোনো ধাতব পদার্থের আলামত নেই। তবে কী ওগুলো রাবার বুলেট? রাবার বুলেট হলে তো সাধারণ মানুষের কাছে থাকার কথা নয়, একমাত্র সরকারি লোকজনের কাছে থাকার কথা। তাহলে কী ওসব সরকারি লোকের কাজ? প্রশ্নগুলো মানুষের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করছে বলে উল্লেখ করলাম। গুলশানে ধনবানদের এলাকায় নিরাপত্তা নেই, সংসদ ভবন এলাকায় নিরাপত্তা নেই, তাহলে নিরাপত্তাটা আছে কোথায়? সারা দেশ নিরাপদ হওয়ার কথা, যেখানে রাজধানীই নিরাপদ নয়, সেখানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল নিয়ে আমরা কথা বলি কোন অধিকারে?
প্রবাদ আছে, বাঙালিরা দাঁত থাকতে দাঁতের মর্যাদা বুঝে না। সময় থাকতে সবাইকে নিয়ে আলোচনায় বসে সমাধান বের করা উচিত। দেশ একটি কঠিন ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এখন কারও গোঁ ধরে বসে থাকা উচিত নয়। কারণ দেশটা কারও পৈতৃক সম্পত্তি নয়, এটি জনগণের সম্পদ, রক্তের দামে কেনা। কারও সঙ্গে হাত মিলিয়ে কারও কাছে বিক্রি করার চিন্তা যদি কেউ করে থাকেন, করতে পারেন। কিন্তু এ দেশ কেউ বেচতে পারবেন না। এক সময় শহীদের আত্দা কবর থেকে প্রতিবাদ করে উঠবে। আর তাতে তখন শরিক হবে দেশের আপামর জনসাধারণ। তাই সময় থাকতে হুঁশিয়ার।
লেখক : রাজনীতিক