আজ ১৪ দিন মতিঝিলের ফুটপাতে। কত অভিজ্ঞতা হলো যা ঘরে থাকলে শত বছরেও হতো না। আমরা কত শ্রেণিতে বিভক্ত, কত রকমের মন-মানসিকতা- একজন সাধারণ মানুষের সেসব বুঝতে কত যুগ লেগে যাবে। ভগবান রামচন্দ্রের বনবাস হয়েছিল ১২ বছর, মহাভারতের নায়ক পঞ্চপাণ্ডবদেরও হয়েছিল বনবাস। সবার বনবাস শেষ হয়েছিল, আমার গণঅবস্থান শেষ হবে কিনা জানি না। তবে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গঠনের পর দলীয় নেতা-কর্মীদের এমন সমর্থন ও সহযোগিতা আগে কখনো পাইনি। রাত-দিন গাধার খাটুনি খাটছে অনেকে। কেউ কেউ তো এই ১৪ দিনে একবারও বাড়ি যায়নি। লালমিয়া, ফরিদ আহমেদ, আলমগীর, কাওসার জামান খান, রোকন, রাজ্জাক, টিপু- সাতজন ইতিমধ্যেই জেল খেটে এসেছে। আরও কত সাতজন খাটবে জানি না। কিন্তু আমরা শান্তি চাই। এই চাওয়া থেকে কেউ আমাদের টলাতে পারবে না। তবে গণঅবস্থানে বসার আগে অনেকটাই অন্ধকারে ছিলাম। দেশের মানুষের চেতন-চৈতন্য সম্পর্কে যতটা আশা ও বিশ্বাস ছিল, ফুটপাতে বসে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ততটা দেখতে পাইনি। আবার একেবারে খেটে খাওয়া মানুষদের কল্পনার চেয়ে বেশি মায়া-মমতা, দেশপ্রেমে ভীষণ উজ্জীবিত হয়েছি।
২৮ জানুয়ারি অবস্থান নেওয়ার পর থেকেই পুলিশি জুলুম সহ্যের সীমা ভেঙে দেওয়ার মতো অবস্থায় এসে ঠেকেছে। যারা আমাকে মোটামুটি জানে বা চেনে তাদের সবার জানা, আমার ভীষণ ঠাণ্ডার দোষ আছে। একটু বাতাস লাগলেই চোখ-মুখ ফুলে যায়, গলা বন্ধ হয়ে আসে, জ্বরে আক্রান্ত হই। গত পর্বেও লিখেছিলাম, এসব আমার প্রিয় ভগ্নি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও জানেন। তাই আশা করেছিলাম, শীতের রাতে আমার নিরাপদে থাকতে কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু সে আশা পূরণ হয়নি। বড় নির্মম বাস্তব, প্রতিবারই রাতের বেলায় চোরের মতো বাতাস ফেরানো চটের বেড়া, চকি, কাঠ-বাঁশ এটা ওটা পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো সিজার লিস্ট দিচ্ছে না। সেদিন আমার কম্পিউটার অপারেটর আলমগীর এবং অনেক বছরের পুরনো কর্মী, ব্যক্তিগত সচিব ফরিদ আহমেদকে ধরে নিয়ে জেলে পুড়েছে। নিক। এসব করেও যদি শান্তি আসে তাতেই আমি খুশি। কিন্তু বড় ব্যথিত হয়েছি শুক্রবার বায়তুল মোকাররমে জুমার নামাজ আদায় করতে গিয়ে। বায়তুল মোকাররমের খতিব অধ্যাপক সালাহউদ্দিন জিগাতলার মহসীন বুলবুল ভাইয়ের বন্ধু। সে জন্য তিনি আমায় অসম্ভব সম্মান দেখান। সেদিন নামাজে তার পিছনেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। আগের শুক্রবার কমিউনিস্ট নেতা রাশেদ খান মেননসহ বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ছিলেন। তাই হয়তো নিরাপত্তা ছিল অনেক বেশি। ৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার তা ছিল না। তাই বেশ নিবিষ্ট মনে নামাজ আদায় করেছি। ফেরার পথে শুনি পুলিশ মঞ্চ চুরি করে নিয়ে গেছে। খবরটা শুনেই মনে হয়েছিল, হুজুর মওলানা ভাসানী বলতেন, মুসলিম লীগের ওরা আমার পেশাব-পায়খানার বদনা চুরি করেছে। দাঙ্গাপীড়িত নোয়াখালীতে মহাত্মা গান্ধীর ছাগল চুরি হয়েছিল। এবার দেখি, আমার মতো অতি সাধারণ মানুষের ফুটপাতে বসার চকি-চৌকাঠ, এমনকি পেশাব-পায়খানা করার চটের বেড়া চুরি করা হলো। কী বলি এদের? কী চায় এরা? এরা কী শান্তিও চাইতে দেবে না? আমাদের দাবি তো বেশি না। প্রধানমন্ত্রী গোঁ ধরে না থেকে শান্তি ও স্বস্তির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন। যার বা যাদের সঙ্গে আলোচনা প্রয়োজন আলোচনা করুন। আমরা তো তার পদত্যাগ চাইনি, আমরা তার কাছে শান্তি চেয়েছি। তাতে কেন এত অশান্তি? আমরা ফুটপাতে বসলে দোষ, মাইকে গান গাইলে দোষ। কিন্তু রবিবার এফবিসিসিআইয়ের নেতারা কোটি কোটি টাকা খরচ করে লাখ লাখ লোকসমাগম করবেন আশায় রাত ২টা থেকে মাইক বেঁধে সারা দিন চিৎকার করে পাঁচ হাজার লোকও করতে পারেনি। তাদের কোনো দোষ হলো না? তারা টাকাওয়ালা, ভুঁড়িওয়ালা বলে তাদের কোনো দোষ নেই, সব দোষ আমাদের। আমরাও বুঝতে পারি না, একেবারে ফুটপাতে বসে কার বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছি। কেন এত জ্বালা-যন্ত্রণা? একজন মুসলমান হিসেবে নামাজ পড়তে গেলেও জল্লাদের মতো সরকারি লোক এসে আশ্রয় ভেঙে নিয়ে যাবে- এসব কী, এই কি গণতন্ত্র? তারপরও আমরা কী বলতে পারি, আমরা মুসলমান, আমরা গণতান্ত্রিক সমাজে বাস করি? প্রশ্নগুলো কেন যেন কিলবিল করে। রাতে ঘুম হয় না। একে তো গাড়ি ঘোড়ার দানবীয় শব্দ, তার ওপর মাথায় কিলবিল করা প্রশ্ন নিয়ে ঘুমানো যায়? ভালোভাবে তেমন কিছুই করতে পারছি না। কত মানুষের কাছে কতভাবে শুনেছি, একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাকি তাদের অন্তরজুড়ে আমার স্থান। স্বাধীনতা যুদ্ধের বহু বছর পর এই প্রথম সাহস করে শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ফুটপাতে বসেছি, শুয়ে রাত কাটাচ্ছি।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের তেমন দেখা পাইনি। জানি তাদের বয়স হয়েছে। তারপরও যারা ভাতা পায় তারা মনে করে কাদের সিদ্দিকীর পাশে গেলে ভাতা বন্ধ। যারা জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা, তারা ভাবে দলীয় পজিশন নষ্ট হবে। তাছাড়া আমাদের অবস্থানে আসায় সরকারি বাধাবিঘ্ন তো আছেই। নিজের কর্মীরা তো প্রতিদিন গ্রেফতার হচ্ছেই, বাইরের অনেকেও হচ্ছে। সেদিনও বিএনপির সাবেক এমপি আশরাফ উদ্দিন নিজাম ও নিজাম উদ্দিন আহমেদ গ্রেফতার হয়েছেন। তারপরও সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সাধারণ মানুষের ঢল। সাধারণ মানুষের জন্য সারা জীবন কাজ করেছি। তাদের ছায়া এবং সান্নিধ্য পেলে আর কিছু চাইবার নেই। তবে এই অবস্থানে না বসলে অনেক কিছুই আমার কাছে স্পষ্ট হতো না। স্পষ্ট হতো না, সত্যিই আমাদের দেশে শিক্ষিত সমাজের অনেকেই এত দলকানা যে সত্যকে সত্য, মিথ্যাকে মিথ্যা বলে না। আমি অবস্থানে আছি কেউ কেউ এটাকে এখনো অনশন বলে ঠাট্টা করার চেষ্টা করে। অনশন আর অবস্থানের পার্থক্য যারা লেখেন তারা কি বোঝেন না? নিশ্চয় বোঝেন, তবু লেখেন। কারণ তারা একটা বিতর্কের সৃষ্টি করতে চান, আলোচনার খোরাক হতে চান। তা হয়ে যদি তাদের ভালো লাগে তাতে বাধা দেব কেন? তবে ওসব করে তেমন কোনো কাজের কাজ হবে না।
অবস্থানে বসে আশপাশের মানুষের যে সাড়া পাওয়া গেছে তার কোনো তুলনা হয় না। প্রথম থেকেই মনে হয়েছে সরকারের ভয়, গণজাগরণ মঞ্চের মতো যদি লাখ লাখ লোক হয়। আমাদের উদ্দেশ্য সেটা নয়। আমাদের উদ্দেশ্য মানুষকে জানানো। সরকার এবং বিরোধী দলে বিভক্ত প্রচার মাধ্যম আমাদের প্রচার যে হবে না- সেটা জেনেশুনেই বসেছি। আমাদের প্রচার আমাদেরকেই করতে হবে। বাংলা সাহিত্যের এক প্রখ্যাত সাহিত্যিক বলেছিলেন, কখনো কখনো নিজের ঢোল নিজেকেই পিটাতে হয়। অন্যের হাতে দিলে সে ফাটাইয়া ফেলিতে পারে। অনেকেই সন্তুষ্ট না হলেও আমাদের যতটা প্রচার হয়েছে আমি তাতেই খুশি। আরও খুশি আশপাশের লোকজনের সহায়তায়। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের প্রচারে রাত-দিন টিভি ক্যামেরা চলেছে, ঘাটে ঘাটে ভ্রাম্যমাণ পায়খানা, কেউ গেলেই এফবিসিসিআইর নেতা জনাব আকরামের তত্ত্বাবধানে প্যাকেটে প্যাকেটে খাবার, বোতলের পানি, নগদ ৫০০ টাকার নোট। আমিও যদি দু-একটা ফকির মিসকিন পাগলকে মাঝে-মধ্যে দু-একশ টাকা দেই। কিন্তু আশপাশের যত অফিস আছে সেখানকার পিয়ন চাপরাশিরা সে যে কী সহায়তা করে। পানি চাইলে উদগ্রীব হয়ে বলে খাবার পানি, না ব্যবহারের কোনটা চাই? রাত ১২-১-২-৩টায় কর্মীরা গিয়ে যখন পেশাব পায়খানা করে বিরক্ত না হয়ে তারা খুশি জাহির করে- কী যে ভালো লাগে! গতকাল সকালের কথা বলি। একটা ছোট বাচ্চা মেয়ে শম্পা আক্তার লিমা বান্দর টুপি পরে আসে। দেখতে একেবারে কার্টুনের টম অ্যান্ড জেরির মতো। গোসল আসল করে ফুটপাতে বসতে একটু সময় লেগেছিল। দেখি বাচ্চাটি কাঁদছে। প্রথম মনে করেছিলাম কেউ তাকে বকাঝকা করেছে। কাছে ডেকে দেখি টসটস করে চোখ থেকে পানি পড়ছে। বাচ্চাদের চোখ থেকে সহজেই পানি ঝরে। জিজ্ঞেস করি, কথা বলে না। একটু পরে বলল, দাদু, একজন বলল, তুমি চলে গেছ। তাই আমার কান্না পেয়েছে। বাচ্চাটিকে হাসতে বলেছিলাম। অনেকবার বলার পর তার মুখে যখন হাসির ঝিলিক খেলে তখন আমার চোখে মায়ের মুখ ফুটে উঠে। ছোটরা কত সহজে আপন হয়, বড়রা হয় পর- সারা জীবন দেখে দেখে এতটা পথ এসেছি। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ধানমন্ডির ১৯ নম্বরের এলি খালা মানে ড. আর এ গনির বাড়িতে কয়েক দিন লুকিয়ে ছিলাম। বিদায়ের সময় মা এসেছিলেন। ১৫-১৯ আগস্ট চোখে এক ফোঁটাও পানি আসেনি। মাকে জড়িয়ে ধরে ভীষণ কেঁদেছিলাম। মা বলেছিলেন, বজ্র, তুই এখনো এখানে? তোকে এখানে পেলে মেরে ফেলবে। তুই এখনই বেরিয়ে যা। রাস্তায় যদি তোকে মারে আমি বুকভরে কাঁদতে পারব, বলতে পারব, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে আমার বজ্র মারা গেছে। মা হিসেবে তুই আমার কাঁদার অধিকার নষ্ট করিস না। সঙ্গে বলেছিলেন, রাস্তায় যা, গিয়ে দেখবি আল্লাহর ঘরে শুধু আলোই আছে, কোনো অন্ধকার নেই। সেই বেরিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে। সেদিনও বেরুবার সময় এমনি ছোট্ট টম অ্যান্ড জেরির মতো মামা জনাব আর এ গনি খানের বাচ্চা- সজিব গনি, কান্তা গনি, টিনা গনি, রত্না গনি আমার সঙ্গে যাবার বায়না ধরেছিল। অনেক কেঁদেছিল। এখন বুঝি সব শিশুই এক, সব শিশুর হাসি-কান্না, মায়া-মমতা এক। জানি না এখন আর ওদের আমার কথা মনে হয় কিনা। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর কেন যে বলেছিলাম, খুনিরা কামাল, জামাল, রাসেলকে হত্যা করলেও বঙ্গবন্ধুকে নির্বংশ করতে পারেনি। আমি তার চতুর্থ সন্তান। যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ, ততক্ষণ পিতৃহত্যার বদলা আমরা নেবই নেব। আজ ওসব কথা মনে হলে কখনো সখনো বুকের ওপর পাথর চাপা ভার অনুভব করি। জননেত্রী শেখ হাসিনা না থাকলে অন্য কেউ এসব করলে কিছু মনে হতো না। কিন্তু তিনি যখন প্রধানমন্ত্রী, আমি তখন নিরাপদে রাস্তায় থাকতে পারি না- ভাবতেই খারাপ লাগে। গত পরশু সকালে একসঙ্গে ৮-১০ জন রিকশাওয়ালা এসেছিল। কত আর হবে, সকাল ৭-সোয়া ৭টা। সবাই একসঙ্গে বলেছিল, আপনি এখানে? আমরা গরিব মানুষ, আমরা থাকব এখানে, রাস্তায় ফুটপাতে। আপনি থাকবেন পাঁচ তলা-ছয় তলার উপরে। শরীর শিউরে উঠেছিল। ষাটের দশকে বাড়ি থেকে পালিয়ে আমিও তো রিকশা চালিয়েছি। আমার জন্য ফুটপাত না হয়ে শুধুই পাঁচ তলা হবে কেন? বঙ্গবন্ধু তো আমাদের শুনিয়েছিলেন, দেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানের ধনী ২২ পরিবারের মতো বাংলাদেশের কোনো পরিবার হবে না। বাংলাদেশ হবে সাধারণ মানুষের দেশ। কারও কোনো নিরাপত্তা বিঘি্নত হবে না, কেউ লাঞ্ছিত হবে না। কাকে কী বলি! গুলিবিদ্ধ হয়ে আ স ম আবদুর রব এক সময় পিজিতে ছিলেন। তিনি কেমন আছেন খোঁজ নিতে লোক পাঠিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাতে কয়েকজন গুঞ্জন তুলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বিরক্ত হয়ে বলেছিলেন, তোরা কি রবকে মেরে ফেলবি? স্বাধীনতায় ওর কোনো ভূমিকা নেই? আমার বিরোধিতা করে বলেই ওকে মেরে ফেলতে হবে? তোরাও তো কেউ অমন করতে পারিস? আগে আমি মরি, তারপর তোদের যা ইচ্ছে তাই করিস। আমি থাকতে করতে পারবি না। আজ কোথায় সেই মনুষ্যত্ব, সেই মানবতা? কোথায় সেই পিতা? কেন যেন কোথায় সব হারিয়ে গেল।
আজ বেলা ১১টায় আমার স্ত্রী ছেলেমেয়ে নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাবে। দেখা হবে কী হবে না জানি না। কারণ আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পাওয়া যায় না, ভিন দেশের প্রধানমন্ত্রীকে পাওয়া যায়। দেখা হলে হবে। আমাকে না বলে সে সেদিন ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখার্জির সঙ্গে কথা বলেছেন। শ্রী প্রণব মুখার্জি বহু বছরের আমাদের পারিবারিক বন্ধু। তার মেয়ে শর্মিষ্ঠা মুখার্জি মুন্নী এবার দিল্লি প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। যদি জেতে খুবই খুশি হব। মুন্নী যখন ছোট কত গল্প শুনিয়েছি। মুন্নীর ছোট পিন্টু। অমন দস্যি ছেলে আর হয় না। কাঁধে উঠে লাফালাফি করত। এমপি অভিজিৎ একটু বড় ছিল। দিদি শুভ্রা মুখার্জির ছোট ভাই খোকন থাকত তার সঙ্গে। দিদি খোকনকে না যতটা ভালোবাসতেন, যত্ন করতেন, তারচেয়ে অনেক বেশি আমাকে করতেন। দিদি বহু বছর থেকে অনেকটা অসুস্থ। বিএনপির আমলে একবার এক সাংস্কৃতিক দল নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন। আমার মোহাম্মদপুরের বাসায় গিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে বউয়ের হাতে ইলিশ মাছ ভাজা খেয়ে আজো তার গল্প করেন। এই তো গত আগস্টে দিল্লির রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছিলাম। কতভাবে যে আমার বউয়ের ইলিশ মাছ ভাজার গল্প শুনিয়েছেন লিখে বুঝাতে পারব না। তাই স্বামী রাস্তায় থাকলে স্ত্রী হিসেবে যদি কারও সঙ্গে কথা বলে আপত্তি করি কী করে। ৬ তারিখ থেকেই গুনগুন করছিল, আমি আপার সঙ্গে দেখা করব। বলেছি ঠিক আছে। তাই আজ ছেলেমেয়ে নিয়ে সে যাবে। কুঁড়ি, কুশি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বেশি আদরযত্ন পায়নি। দীপ বড় নাদুশনুদুশ ছিল। তখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তেমন খুব একটা কাজ ছিল না। তাই দীপ বড় বেশি আদরযত্ন পেয়েছে। দীপকে গোসল করানো, খাওয়ানো- এসব বেশ কিছু দিন তিনি নিজেই করেছেন। আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাচ্চাদের আমার চেয়ে অনেক বেশি আদরযত্ন করেন, ভালোবাসেন। তাই ৭ তারিখ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নাসরীন যখন বলছিল, আপা আমার স্বামীর কাঁথা-বালিশগুলো না নিলে কী চলত না? আমি নড়েচড়ে উঠেছিলাম। সেই দীপ, কুঁড়ি, কুশিকে নিয়ে আমারই বাড়ির পাশে মিরপুর সড়কের গণভবনে আজ আমার স্ত্রী যাবে। এও এক ঐতিহাসিক ঘটনা। ওই গণভবনের একটা অংশ আগে সেন্ট্রাল স্টেট গেস্ট হাউস ছিল। স্বাধীনতার পর আমি সেখানে দু'তিন মাস ছিলাম। এক-দেড় মাস কাকরাইলের সেন্ট্রাল সার্কিট হাউসে ছিলাম। বড় ভালো লেগেছে আল্লাহ আমায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যে ঘরে থাকতেন সেই ঘরে রাত কাটানোর সৌভাগ্য বা তৌফিক দিয়েছেন। রাস্তায় বসে বসে কত কথা, কত স্মৃতি সিনেমার পর্দার ছায়াছবির মতো হৃদয়ের পর্দায় ভেসে উঠছে। কায়েমি স্বার্থ যে কী আবার নতুন করে দেখলাম। আমার অবস্থানের সামনেই এক সংবাদপত্রের অফিস। তারা নাকি আমাদের খুব সমর্থক। তাদের পত্রিকায় আমাদের অবস্থানের খবরও নাকি মাঝে মাঝে ছাপা হয়। তাই তারা চিঠি দিয়েছেন, আমাদের মাইক ব্যবহারে তাদের কাজের ক্ষতি হয়। সেহেতু মাইক বন্ধ করতে হবে। অথচ ১০ ফুট দূরে খাবার দোকানে কাচের দরোজা বন্ধ হলে কিছুই শোনা যায় না।
কী বলব! পত্রিকার মালিকের সঙ্গে নাকি তথ্যমন্ত্রীর বড় বেশি ভাব। হতেই পারে। কার সঙ্গে কার ভাব জানব কী করে? রাস্তার পাশে শুয়ে শুয়ে কত কিছু শিখছি। আমাদের সাহায্য পাত্রে কত গরিব হুমড়ি খেয়ে টাকা-পয়সা দেয়। কিন্তু পাশেই মিষ্টির দোকান, কোট-প্যান্ট, ভালো কাপড়-চোপড় পরারা শত শত হাজার হাজার টাকার জিনিস নিয়ে যায়, আমাদের দিকে ফিরেও তাকায় না। এক পয়সা দান করে না, কেউ আসে সব অন্তর উজাড় করা ভালোবাসা নিয়ে, আবার কেউ ছবি তুলতে- এর মধ্যেই কেটে যাচ্ছে দিন-রাত।
লেখক : রাজনীতিক।