যতদূর জানা যায়, উল্লেখযোগ্য বা বড় ধরনের ইসলামি জঙ্গিবাদ কার্যক্রম বা উত্থান এখনো বাংলাদেশে লক্ষ করা যায় না। কিন্তু বেশ কিছু লক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলে ধারণা হয় দেশে ইসলামি জঙ্গিবাদ সৃষ্টি হচ্ছে। যদিও এখন পর্যন্ত শুরু পর্যায়ে আছে। তবুও গণমাধ্যমের খবরাখবর দেখে প্রতীয়মান হয় দিন দিন এর প্রসার হচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ সমাজে জঙ্গিবাদের ধারণা আগ্রহ সৃষ্টি করছে বলে শোনা যায়। মূল কারণ সুশাসনের অভাব, যার বহিঃপ্রকাশ আইনের শাসনে দুর্বলতা। একই সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি, বৈষম্য, বঞ্চনা ইত্যাদির ফলে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও হতাশা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিক্ষুব্ধ তরুণ সমাজ একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ লাভের আশায় যে কোনো প্রক্রিয়ায় সমাজ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে মরিয়া হয়ে উঠছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি অতি সম্প্রতি প্রকাশিত লেখায় (“Our plan for countering violent extremism” ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০১৫, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল) পৃথিবীর যে কোনো স্থানে সন্ত্রাসী চরমপন্থা সৃষ্টির কারণ হিসেবে একই ধরনের পরিবেশকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, 'সবচেয়ে মূল বিষয় হলো সুশাসন। এটি শুনতে চমৎপ্রদ মনে নাও হতে পারে, কিন্তু বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ যারা মনে করে সরকার শুধু নিজেদের নয় তাদেরও প্রয়োজন মেটাবে ও তাদের জন্য একটি উন্নততর জীবনের সুযোগ সৃষ্টি করবে, সেসব মানুষ একে-৪৭ অথবা আত্দঘাতী বোমা বহনকারী জামার ফিতা নিজ শরীরে বাঁধবে বা যারা বাঁধে তাদের সহায়তা করবে, এ সম্ভাবনা খুবই কম।'
(“The most basic issue is good governance. It may not sound exciting, but it is vital. People who feel that their government will provide for their needs, not just its own, and give them a chance at a better life are far less likely to strap on an AK-47 or a suicide vest, or to aid those who do.”)
বৃহত্তর পরিসরে দেখলে, সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ ও শাসন প্রক্রিয়ার ওপর অনাস্থা জঙ্গিবাদ সৃষ্টির অন্যতম মূল কারণ। যখন কোনো মানুষের ধারণা হয় শাসনকার্য পরিচালনাকারী সরকার তাদের জন্য ভালো কিছু করবে না ও একই সঙ্গে প্রচলিত পদ্ধতিতে এ ধরনের সরকার বা শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনের কোনো সুযোগ নেই তখন তারা বিকল্প কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হয়।
এ ধরনের মানুষ যারা সরকার ও শাসনব্যবস্থার ওপর হতাশ ও বিভিন্ন কারণে ক্ষুব্ধ তাদের সংখ্যা যখন যথেষ্ট বেশি হয় তখন সম্মিলিতভাবে তারা শুধু চরমপন্থি বা জঙ্গি সৃষ্টির উর্বর ভূমিতে পরিণত হয় না; বরং জঙ্গিদের আশ্রয়দানকারী ও সহায়ক হিসেবেও কাজ করে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনো দরিদ্র। শিক্ষার অভাব, নানাবিধ অন্যায়-অনাচার, বঞ্চনা, লাঞ্ছনার শিকার। বেশিরভাগ মানুষের উপলব্ধি সরকারি প্রশাসনের কাছে তারা অসহায় প্রজা, এর বেশি কিছু নয়। সরকারের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার প্রতিষ্ঠানগুলো অকার্যকর। গণতান্ত্রিক পদ্ধতি দুর্বল ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। সমাজজীবনে ধর্মের প্রভাব যথেষ্ট। সব কিছু মিলিয়ে ইসলামি জঙ্গিবাদ বিস্তারের নানা ধরনের উপাদান আমাদের সমাজে বিদ্যমান।
বর্তমানে রাজনীতিতে যে সহিংসতা দেখা যাচ্ছে তাকে বাহ্যিকভাবে শুধু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে এর মূল নিহিত রয়েছে সামাজিক অশান্তি ও অস্বস্তিতে; যার সূচনা হয়েছে অতি সম্প্রতি গৃহীত সুনির্দিষ্ট কিছু রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড থেকে- যেমন সংবিধান সংশোধন করে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন, সে অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে একটি প্রশ্নবিদ্ধ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান, দেশের সরকারবিরোধী দলগুলো কর্তৃক সে নির্বাচন বর্জন ইত্যাদি। মূল দাবি একটি, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং সে কারণে নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা পরিবর্তন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন ইত্যাদি। যেহেতু দাবিগুলো ইসলামি আদর্শ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে নয় এবং এর নেতৃত্বদানকারী ও অংশগ্রহণকারী বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রকামী, ধর্মভিত্তিক দল নয়, সে কারণে একে এখনো ইসলামি জঙ্গিবাদ সৃষ্ট চরমপন্থি সহিংসতা বলা যায় না।
বর্তমান সমস্যাকে শুধু আইনশৃঙ্খলা অবনতি হিসেবে বিবেচনা করে কঠোর হস্তে দমনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সদস্যদের কর্তৃক এ দায়িত্ব পালনে আইনি সীমারেখার বাইরে শক্তি ও কর্তৃত্ব প্রয়োগের অভিযোগ আসছে। এতে জনগণের মধ্যে অস্বস্তি ও অসন্তোষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে কট্টর রাজনীতির সমর্থন বৃদ্ধি পাবে এবং ইসলামি জঙ্গিবাদের দিকে বেশিমাত্রায় মানুষ উৎসাহিত হবে, ধারণা হয়।
কিছুদিনের মধ্যে যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েও আসে তথাপি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ দীর্ঘদিন বজায় রাখা যাবে কিনা সে বিষয়ে সংশয়ের অবকাশ আছে। সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ যারা কিছু দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে রত তারা এ দাবিগুলোকে যথার্থ ও যুক্তিসঙ্গত বলে বিশ্বাস করে। বল প্রয়োগের মাধ্যমে জোরপূর্বক দাবিগুলো দাবিয়ে রাখলে তারা নিজেদের অত্যাচারিত ও বঞ্চনার শিকার মনে করতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাদের ক্ষোভ ও অশান্তি সুপ্ত থাকবে এবং যে কোনো সুযোগে পুনরায় এর সহিংস বহিঃপ্রকাশ ঘটার সম্ভাবনা থাকবে। এ প্রসঙ্গে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের এ উক্তিটি উল্লেখ্য- 'শান্তি অর্থ সহিংসতার অনুপস্থিতি নয়, শান্তির অর্থ ন্যায়বিচারের উপস্থিতি।' (‘Peace is not the absence of violence, but the presence of justice’). শুধু বল প্রয়োগের মাধ্যমে কখনোই সন্ত্রাস অথবা জঙ্গিবাদ নির্মূল করা সম্ভব নয়। প্রত্যেকটি চরমপন্থিকে খুঁজে বের করে মেরে ফেললেও হিংসাত্দক কার্যক্রম শেষ হবে না। কেননা নতুনভাবে আবার চরমপন্থি সৃষ্টি হবে। যেসব সমস্যার কারণে এর সূচনা হয়েছে, সে বিষয়গুলো চিহ্নিত করে সেগুলোকে সমাধান করার মাধ্যমেই শুধু রাজনৈতিক সন্ত্রাসের পুনঃউত্থান ঠেকানো সম্ভব।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির পূর্বে উল্লিখিত লেখায় এ বিষয়টিও উঠে এসেছে। নিচে সংশ্লিষ্ট অংশটি উদ্বৃত্ত করা হলো : 'বল প্রয়োগে আজকের সন্ত্রাসীদের নির্মূল করলেও তা আগামী দিনের সন্ত্রাসীদের থেকে রক্ষা পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয় না। যে পরিস্থিতির কারণে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী আন্দোলনের জন্ম হয় আমাদের সে পরিবেশে পরিবর্তন আনতে হবে। শুধু সহিংস চরমপন্থিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে নয়, এ ধরনের সন্ত্রাসী সৃষ্টি যাতে না হয় সে বিষয়েও আমাদের মনোনিবেশ করতে হবে। অর্থ হলো যেসব স্থানে সন্ত্রাসী সৃষ্টি হয় ও আশ্রয়-প্রশ্রয় পায় সে জনসমষ্টির সামনে দৃশ্যমান গ্রহণযোগ্য বিকল্প তৈরি করা।' (“Eliminating the terrorists of today with force will not guarantee protection from the terrorists of tomorrow. We have to transform the environments that give birth to these movements. We have to devote ourselves not just to combating violent extremism, but to prevent it. This means building alternatives that are credible and visible to the populations where terrorists seek to thrive.”)
বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক আন্দোলনে যে সহিংসতা ঘটছে তা জঙ্গিদের দ্বারা ইসলামি জঙ্গিবাদের আদর্শ বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে, এখন পর্যন্ত এর সমর্থনে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ লক্ষ করা যায়নি। তবে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বীজ দৃশ্যমান ও উদগত হওয়ার উর্বর ভূমি বিদ্যমান। জঙ্গিবাদ প্রসারে প্রয়োজন শুধু উপযুক্ত পরিবেশ। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সহিংসতা ও সংশ্লিষ্ট কারণগুলো এ পরিবেশ সৃষ্টি করে বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। যে প্রক্রিয়ায় আন্দোলন চলছে এবং তা মোকাবিলা করা হচ্ছে তাতে দেশে ইসলামি জঙ্গিবাদের উত্থান হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পরিবেশ সামাজিক স্থিতিশীলতা দেয়, যা উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির সহায়ক শুধু নয়, মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে অপরিহার্য। বর্তমানে যে সহিংসতা, সন্ত্রাস, সংঘর্ষ ও অনিশ্চয়তার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে তা শুধু দেশকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছে না; ক্রমান্বয়ে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে। যেসব রাজনৈতিক বিষয়ে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে বা অন্য আরও বিষয় যা ভবিষ্যতে স্থিতিশীলতায় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে, সেগুলোকে নিষ্পত্তির রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এতে সামাজিক ক্ষোভ ও হতাশা দূরীভূত হবে এবং ভবিষ্যতে শান্তিপূর্ণ ও স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় থাকবে। বিবদমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ও প্রয়োজনে সব সংশ্লিষ্ট পক্ষকে নিয়ে একটি অর্থবহ সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমেই সেটা সম্ভব। এ ধরনের ক্ষেত্রে রীতি অনুযায়ী বৈঠক আহ্বানের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হবে সরকারের পক্ষ থেকেই। ড. রওনক জাহান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ তার সাক্ষাৎকারে বলেছেন (দি ডেইলি স্টার ৬ মার্চ, ২০১৫), 'চরমপন্থিদের মোকাবিলা করার একটি অন্যতম প্রধান পথ হলো গণতন্ত্রকামী অহিংসবিরোধী দলকে সুযোগ দেওয়া।' (“One of the best ways to tackle extremists is to ensure space for non-violent and democratic opposition”)।
লেখক : রাজনীতিক।