নিরাপদ মত প্রকাশ হচ্ছে গণতন্ত্র সুসংহতকরণের অন্যতম মাইলফলক। স্বাধীনভাবে গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চার লক্ষ্যে সব নাগরিকের মতামত প্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই মতামত প্রকাশের অধিকার গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হিসেবে বিবেচনা করে সর্বান্তকরণে সংবর্ধিত করা প্রয়োজন- কেননা এই অধিকার কেবল গণতন্ত্রকেই সুসংহত, প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করে না জনগণের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মতামত প্রকাশের পথও সুগম করে দেয়। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ডতা রক্ষার্থে কিছু কিছু মতামত প্রকাশ জনজীবনে সীমাবদ্ধ করা প্রয়োজন। সংবিধানের ৩৯ উল্লেখ্য (১)- চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল। (২) তবে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশি রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ- সংগঠনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ- সাপেক্ষে (ক) প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা অধিকারের (খ) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল (গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান অক্টোবর ২০১১)। সংবিধানের ৩৯, ৯ এবং ৩২ অনুচ্ছেদে তথ্য প্রাপ্তি ও পরবর্তীতে মত প্রকাশ এবং অন্যান্য প্রিন্ট/ইলেকট্রনিক মাধ্যমের প্রকাশের অধিকার সম্পৃক্ত। গবেষকদের মতে, সংবিধানের এই বিধানটির ওপর ১৯৬২ সালে পাকিস্তানের সংবিধানের অশুভ প্রভাব আছে অর্থাৎ বাধানিষেধের শর্তটি দীর্ঘায়িত হয়েছে। কিন্তু উদার দৃষ্টিতে পরিলক্ষিত যে কোনো সীমাবদ্ধতা ব্যতিরেকে চিন্তা-চেতনা ও বিবেক বুদ্ধির সম্পূর্ণ স্বাধীনতার মতো অবাধ তথ্য প্রাপ্তির স্বাধীনতাও বাংলাদেশের নাগরিকগণ 'মৌলিক অধিকার' হিসেবে অর্জন করেছে (তথ্যের অধিকার, ২০০৭)।
বর্তমান বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ভিন্ন মত প্রকাশে গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। নিরাপদ মত প্রকাশে গণমাধ্যম মুক্ত কিনা, এই আলোচনার জন্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বিশ দশকের পূর্বে মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি ছিল আন্দোলন বা অধিকার হিসেবে 'স্বীকৃতি আদায়ের' বিষয়। কারণ কাঠামোগতভাবে রাষ্ট্র ছিল স্বৈরতান্ত্রিক এবং জনসম্মুখে নিজের মতামত প্রকাশ করাটাই তখন মুখ্য ছিল। ইংরেজ কবি মিল্টন সপ্তদশ শতকে ব্রিটিশ রাজার সঙ্গে লড়াইয়ে লিপ্ত হন বিবেকের স্বাধীনতা, চিন্তার স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায়। অ্যারিওপ্যাজিটিকায় তার উচ্চারণ ছিল এই রকম; দাও আমায়, জ্ঞানের স্বাধীনতা দাও, কথা কইবার স্বাধীনতা দাও, মুক্তভাবে বিতর্ক করার স্বাধীনতা দাও। সবার ওপরে আমাকে দাও মুক্তি। লক্ষণীয় যে, শর্তহীন বাকস্বাধীনতার অধিকার আজও আমরা অর্জন করতে পারিনি। উল্লেখ্য, মিল্টন স্বাধীনতা চেয়েছিল চার্চ ও রাষ্ট্র থেকে কারণ ক্ষমতার বিলিবণ্টন তখন এ দুটি প্রতিষ্ঠান করত। আঠারো শতকের শেষ পর্যায়ে ভাব বা মত প্রকাশের স্বাধীনতায় সংবাদপত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সে সময় সংবাদপত্র একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় বা মতাদর্শগত বিতর্কের জন্য। গণমাধ্যম তাত্তি্বক জুর্গেন হেবারমাস মুক্ত আলোচনা বিষয়ে প্রথমে উদাহরণ দিয়েছে আঠারো শতকের public sphere-এ আলোচনাকে যেটা ছিল চার্চ ও রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। হেবারমাসের প্রতীতি, আঠার শতকে সংবাদপত্র ও সাময়িকী 'জনপরিসর'-এর অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছিল। পরবর্তীতে হেবারমাস সংক্ষুব্ধ হন যে, সংবাদপত্র ও সাময়িকীগুলো বিজ্ঞাপন ও পণ্য বাণিজ্যের কবলে পড়ে যায়; যার পরিণতিতে সৃষ্টি হয় গণভোক্তা ও গণবণ্টন ব্যবস্থা, যার ফলে স্বার্থের বিষয়গুলো আলোচনার শিরোনাম হতে ব্যর্থ হয়। পত্রিকার উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায় কাটতির দিকে। ফলে গণমাধ্যম ক্রমশ ঝুঁকে পড়ে ব্যবসায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতাদের ওপর (তথ্যের অধিকার, ২০০৭)।
হেবারমাস যদিও গণমাধ্যমের বাণিজ্যকরণ প্রক্রিয়ার উল্লেখ করেছেন কিন্তু ইউরোপে তখন সমাজ, রাষ্ট্র এমনকি তথ্য ও শিক্ষার মতো বিষয়ও ব্যক্তিখাতে চলে যায়। পুঁজিবাদের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশই রাষ্ট্রের চরিত্র, বাণিজ্য সম্পর্ক, পণ্য অর্থব্যবস্থার প্রকৃতি এবং সামাজিক মূল্যবোধ বদলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার বিষয়টি প্রভাবিত হতে শুরু করে। পুঁজিবাদের সঙ্গে এসেছে শিল্পায়ন, নগরায়ণ এবং মুক্তবাজার অর্থনীতি (তথ্যের অধিকার, ২০০৭ : ibid))। এই পুঁজিবাদের নেতিবাচক প্রভাব থেকে বাংলাদেশের গণমাধ্যম কতটুকু মুক্ত? লক্ষণীয় যে, বর্তমানে বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক/প্রিন্ট মাধ্যমের বেশির ভাগ মালিকানা চলে গেছে ব্যবসায়ীদের হাতে এবং সম্পাদকরা মালিক হিসেবে পত্রিকায় কাজ করছেন। যদিও অনেক সম্পাদক/নির্বাহী কর্মকর্তা দাবি করেন যে তারা মালিকের স্বার্থের ঊর্ধ্বে গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে যাচ্ছেন কিন্তু বাস্তবে সবসময় তার প্রতিফলন নেই। গণমাধ্যমও অন্যান্য সেক্টরের মতো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিভক্ত হয়ে পড়ছে। উপরন্তু কোনো কোনো সময় সাংবাদিকরা স্বার্থ হাসিলের জন্য বেতনভুক্ত কর্মকর্তা/মালিক হিসেবে অসত্য তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে জাতীয় জীবনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। সমষ্টিগত স্বার্থের বিপরীতে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য গণমাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে। তাত্তি্বক দৃষ্টিকোণ থেকে গণমাধ্যম দুভাবে কাজ করতে পারে। Radical Approach যেটা গণমাধ্যমকে status/law দ্বারা নির্ধারিত করে না। গণমাধ্যমে এই ধারার চর্চা অনেক ক্ষেত্রে অপব্যবহার হয়। অপরদিকে Technocratic Control যুক্তি যেটা গণমাধ্যমের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্ন করে। তাই গণমাধ্যম পরিচালিত হতে হবে নির্ধারিত ধারা এবং আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। যেটা প্রয়োজন তা হলো যৌক্তিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে গণমাধ্যমের নিরাপদ মত প্রকাশ নিশ্চিতকরণ।
বর্তমানে যে রাজনৈতিক দলটি সরকারের দায়িত্বে আছে তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চিতকরণের জন্য গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মূলত গণমাধ্যম কাজ করে রাষ্ট্রের এবং সরকারের যাবতীয় কার্যকলাপের ‘Watch Dog’ হিসেবে। এ কারণে গণমাধ্যম ‘Second State’ হিসেবেও বিবেচিত। গণমাধ্যমের মূল কাজ হচ্ছে সরকার এবং জনজীবনের সব কার্যকলাপের স্বচ্ছতা এবং ঘটনা নাগরিকের কাছে বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করা। এই জাতীয় সংবাদ প্রকাশের মাধ্যমেই গণমাধ্যম তার নিজস্ব স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রটি প্রতিষ্ঠিত করে নেয়। যদি মুক্তভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হয় তখনই গণমাধ্যম হয়ে যায় ‘Lap Dog’। মোদ্দাকথা গণমাধ্যম এখন একটি শিল্প এবং এই সেক্টরেও শিল্পের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো উৎপাদন বণ্টন, শ্রম বিভাজন ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনায় নয়া পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে। গণমাধ্যম সজ্জিত হচ্ছে করপোরেট সংস্কৃতির আলোকে এবং দেশে দেশে তা সফলও হচ্ছে। প্রযুক্তির অমিত সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সংবাদপত্র তার উৎপাদনের গতি বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং এসেছে প্রায় ২৯টি বেসরকারি চ্যানেল, ঢাকায় প্রকাশিত ১১৩টি পত্রিকা এবং সমগ্র দেশে প্রকাশিত হচ্ছে প্রায় ৫০০টি পত্রিকা। পূর্বের যে কোনো সময় থেকে সংবাদকর্মীদের কাজ পদ্ধতি মাফিক ও কাঠামোবদ্ধ হয়েছে। গণমাধ্যমের সংবাদকর্মী মালিক ও মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাবমুক্ত হয়ে ন্যায্য মজুরি এবং কাজের স্বীকৃতি কি পাচ্ছে? গণমাধ্যমের গবেষকদের মতে, পুঁজিবাদের বিকাশ যত ত্বরান্বিত হয়েছে অন্য শিল্পের মতো গণমাধ্যমেও উদ্বৃত্ত মূল্যের শোষণ প্রক্রিয়া কি তীব্র হচ্ছে না? লক্ষণীয় গণভোক্তা তৈরির কাজে বিশেষ ভূমিকা রাখছে বিজ্ঞাপন আয়ের উৎস হিসেবে। আশঙ্কা করা হয়, অনেক ক্ষেত্রেই বিভিন্ন পত্রিকা এবং বেসরকারি চ্যানেলের বিপুল গ্রহণযোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যদি পর্যাপ্ত বিজ্ঞাপন না থাকে তবে এটি বন্ধ হয়ে যাবে (তথ্যের অধিকার; ২০০৭ : ৪২৮)। তাই লক্ষণীয়, যখন গণজাগরণ মঞ্চে প্রজন্ম চত্বরে 'চেতনার আন্দোলন' থেকে উৎসারিত ছয়টি দাবির মধ্যে প্রাধান্য পেয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি, জামায়াত-শিবির রাজনীতি নিষিদ্ধ এবং মৌলবাদ অর্থনীতি সংশ্লিষ্ট সব অর্থনৈতিক সামাজিক প্রতিষ্ঠান বয়কট, তখনই দেখা যাচ্ছে গণমাধ্যমের প্রজন্ম চত্বরের দাবির সঙ্গে একাত্দতা থাকা সত্ত্বেও সর্বোচ্চ সার্কুলেশন অর্জিত কিছু পত্রিকা এবং কিছু জনপ্রিয় বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলো বিশেষ মৌলবাদী অর্থনৈতিক সংগঠনের বিজ্ঞাপন প্রচার করে চলেছে। ৪৭-এর দেশ বিভাগের সময়ে এবং আইয়ুবের সামরিক শাসনে 'সংবাদপত্র প্রকাশ ও প্রকাশনা অর্ডিনেন্স'-এর মাধ্যমে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বের চেষ্টা চালানো হয় কিন্তু প্রতিবাদের মুখে কিছুটা সংশোধন হলেও তৎকালীন সময়ে সাংবাদিকতার ওপর হামলা/হুমকি অব্যাহত ছিল। বর্তমান বাংলাদেশে সামরিক শাসনামলে গণমাধ্যম সেন্সরশিপেরও সম্মুখীন হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ এখনো নানা কায়দায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সমাবেশেও সাংবাদিকরা আক্রমণের শিকার হচ্ছে এবং সাহসী সত্য রিপোর্টের জন্য বহু সাংবাদিকের প্রাণহানিও ঘটছে।
বাংলাদেশে গণমাধ্যমে পুঁজির বিনিয়োগ এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হতে পারেনি। গণমাধ্যম অনেক ক্ষেত্রে আচরণ করছে বহুজাতিক কোম্পানির মতো। এমনকি প্রাইভেট সেক্টর হওয়ার দরুন তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করে কোনো নাগরিক তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে না কিন্তু গণমাধ্যমের কর্মীরা অনুসন্ধানীমূলক রিপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন ব্যবহার করতে শুরু করেছে। তথ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছে সম্প্রচার নীতিমালা তৈরির, তবে প্রক্রিয়াটা হতে হবে মুক্ত গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠায় অংশগ্রহণমূলক। এই প্রেক্ষাপটে গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী সমাজ পুঁজি অবাধ প্রবাহ, সুস্থ প্রতিযোগিতা এবং মুক্তবুদ্ধি ও চর্চা- এসব প্রপঞ্চ একসঙ্গে যায়- কিন্তু সেটা কি সম্ভব? নিরাপদ মত প্রকাশে গণমাধ্যম বাজার অর্থনীতি ও বিজ্ঞাপনদাতাদের ঊর্ধ্বে কতটুকু যেতে পারবে? তবে হতাশ হলে চলবে না, এই গণমাধ্যমই নানা প্রতিকূলতার মধ্যে ডেসটিনি, হলমার্ক, শেয়ার বাজারের কেলেঙ্কারি, নারী ধর্ষণ, বিভিন্ন নির্যাতন, সাম্প্রতিককালে বাস্তবের বিরোধী দল কর্তৃক নাশকতা ও সহিংসতার চিত্র, সংখ্যালঘিষ্ঠদের ওপর সাম্প্রদায়িক আক্রমণ, তাজরীন, স্মার্ট এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা-পরবর্তী সবচেয়ে মর্মস্পর্শী সাভারে রানা প্লাজায় গার্মেন্ট ট্র্যাজেডির খবর সার্বক্ষণিকভাবে দিয়ে প্রমাণ করেছেন যে গণমাধ্যম জনগণের কত কাছাকাছি- যারা সংবাদপত্র পড়তে পারে না তাদেরই নিকটজন। নিরাপদ মত প্রকাশে তাই সাংবিধানিক ও আন্তর্জাতিক সনদের আলোকে মুক্ত গণমাধ্যম সুষুম মত প্রকাশে প্রয়োজন।
সাম্প্রতিককালে সামাজিক মাধ্যমে মতামতের অধিকার নিয়ে ও বিভিন্ন স্তরে ব্যাপকভাবে আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে আমার দেশ পত্রিকায় পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে কিছু ব্লগারের মতামত, প্রজন্ম চত্বরকে ঘিরে বিভিন্ন উসকানিমূলক তথ্য প্রকাশ, সাঈদীর মক্কা শরিফে গিলাফ পরিবর্তনের ছবি প্রকাশ এবং প্রথম আলোতে হাসনাত আবদুল হাই রচিত 'টিভি ক্যামেরার সামনে মেয়েটি' শীর্ষক ছোটগল্পে ব্যক্ত মতামত তীব্র প্রতিবাদ এবং নিন্দার শিকার হয়েছে। মুক্তচিন্তার প্রাণকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র এলাকায় ড. অভিজিৎ রায়কে পরিকল্পিতভাবে নিষ্ঠুর পৈশাচিক উপায়ে হত্যা এবং তার স্ত্রীকে গুরুতর আহত করার ঘটনা স্বাধীন মুক্তচিন্তা প্রকাশের প্রশ্নটি সামনে এনেছে। অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ড নির্মম, কিন্তু নতুন বা আকস্মিক ঘটনা নয়। কয়েক বছর আগে বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদের একই ধরনের হত্যা প্রচেষ্টা (পরিণতিতে মৃত্যু) আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এ ব্যতীত আমরা দেখেছি পৈশাচিক জঙ্গিদের হাতে রাজীবসহ একাধিক ব্লগারের নির্মম মৃত্যুবরণ। অভিজিৎ মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। অভিজিৎ লেখক বা ব্লগার হিসেবে কোনো ধর্মীয় মহাপুরুষকে নিয়ে ব্যঙ্গ করেননি। বরং তিনি অধ্যাপক অজয় রায়ের সুযোগ্য পুত্র হিসেবে বর্তমানের ধর্মান্ধতা, অসাম্প্রদায়িকতা, ধর্মকে রাজনীতিতে বর্ম হিসেবে ব্যবহার করা, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ও সন্ত্রাসের ঘোর বিরোধী ছিলেন। অর্থাৎ ছিলেন একজন ধর্মনিরপেক্ষ সজ্জন ব্যক্তি। একজন ধর্মনিরপেক্ষ হলেই কি তাকে হত্যা করার বিধান কোনো ধর্মের রয়েছে? ইসলাম এই জাতীয় মধ্যযুগীয় বর্বরতা সমর্থন করে না। তাই ধর্মের মুখোশের আড়ালে এই হত্যাকারীরা যারা মুক্তচিন্তার বিরোধী তারা আসলে ঘৃণ্য ঘাতক। এরা ধর্মনিরপেক্ষ চিন্তাবিদদের মতে মানবতার শত্রু। 'সামাজিক মাধ্যম' মত প্রকাশের একটি অন্যতম প্লাটফর্ম, যেখানে সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং বিভিন্ন বিষয়ে মতামত তরুণরা প্রদান করে যাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যমে প্রদত্ত বিভিন্ন মতামত বিনয়ের সঙ্গে বলছি যে, প্রবীণ রাজনীতিবিদ এবং নীতিনির্ধারকদের অজানা। সবসময় সমাজের পরিবর্তন আনে নতুন প্রজন্ম। বর্তমানে নতুন প্রজন্মকে দাবি আদায় বা মতামত প্রদানের জন্য মিটিং-মিছিল করতে হয় না। প্রথাগত প্রচার মাধ্যমের বাইরে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে তারা কাজে লাগাচ্ছে। নতুন জীবন দর্শনের জন্ম দিচ্ছে। তারা সমাজ ও রাজনীতির মারাত্দক অবক্ষয়ের মধ্যে ও বাংলাদেশের সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করে। 'সামাজিক মাধ্যম' গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চারও সুযোগ দেয়। তাই এই চর্চার জায়গাটি রক্ষা করতে হবে। জনগণ সমাজ এবং রাষ্ট্রের বাইরে নয়। সমাজ ও রাজনীতির কায়েমী স্বার্থের আক্রমণ প্রতিহত করার ক্ষমতা কোনো প্রতিবাদী ব্লগ বা গণমাধ্যমের কতটা থাকতে পারে, যদি তার পাশে শক্ত নাগরিক সমাজ না থাকে। যেখানে ক্রিটিক্যাল অথরিটি বা সমালোচনার কর্তৃত্ব দুর্বল, সেখানে কেবল মুক্তচিন্তার বিভিন্ন মাধ্যম জনস্বার্থ রক্ষা করতে পারে না। সমাজ পরিবর্তনের জন্য তাই ভিন্ন মতামত গ্রহণের উদার মানসিকতা এবং রাষ্ট্রের সমর্থন কাম্য।
লেখক : সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং
সাবেক তথ্য কমিশনার