তিন সিটি নির্বাচনে মানুষের আশা ও স্বপ্নের মিনার ভেঙে গেছে। আবার এক কেলেঙ্কারির নির্বাচন নতুন করে প্রশ্ন জাগিয়ে দিয়েছে যে, শুধু জাতীয় নির্বাচন নয়, স্থানীয় কোনো নির্বাচনও কি আর দলীয় সরকারের অধীনে স্বচ্ছভাবে ও নিরপেক্ষ অনুষ্ঠিত হতে পারে? গত চার দিনে এই নির্বাচন নিয়ে যে মতামত প্রকাশিত হয়েছে, সরকার পক্ষের লোকজন ছাড়া দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল একবাক্যে বলছে, এ নির্বাচনটিও বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলেছে নির্বাচন কমিশন। মনে হয়েছে লীগ সরকার এবং বর্তমান নির্বাচন কমিশন একে অপরের পরিপূরক। এই নির্বাচন যেন ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন থেকে শুরু করে উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম ধাপের ধারাবাহিক 'প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনী নাটকের' নতুন আরেকটি এপিসোড। সিটি নির্বাচন স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এই নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতা প্রকাশ্যে ও প্রবলভাবে থাকলেও সবাই জানতেন এই নির্বাচনের ফলাফল বা জয়-পরাজয় সরকার পরিবর্তনের নিয়ামক নয়। কিন্তু ক্ষমতাসীন সরকারের আচরণে মনে হয়েছে, এতে হারলেই বুঝি ক্ষমতাটা গেল! ক্ষমতার অদল-বদল না হলেও এই ছোট্ট পরিসরের নির্বাচনের অনেক বিরাট আকারের একটি রাজনৈতিক গুরুত্ব ছিল। কেউ কেউ একে মিনি পার্লামেন্ট নির্বাচন, কেউবা আবার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের 'ড্রেস রিহার্সাল' বলে অভিহিত করেছিলেন। নির্বাচনটি বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ায় সবার হিসাব-নিকাশই এলোমেলো হয়ে গেল। সিটি নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরুর আগে দেশে তিন মাস এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ ছিল। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০-দলীয় জোটের ডাকে টানা অবরোধ ও হরতাল চলছিল দেশজুড়ে। অবরোধ কর্মসূচি নাকি এখনো বলবৎ আছে! কিন্তু কোথায় অবরোধ? তিন মাসের অবরোধ এবং দুই মাস সপ্তাহে পাঁচ দিন করে হরতাল চলাকালে দেড় শতাধিক মানুষ মারা গেছেন। এর মধ্যে ৮০ জন মারা গেছেন পেট্রলবোমা হামলা, অগ্নিসংযোগ ইত্যাদি নাশকতায়, বাকিরা মারা গেছেন ক্রসফায়ার নামক আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সংঘর্ষ ইত্যাদিতে।
বিএনপির সমস্যা হচ্ছে, সরকার পক্ষ যেমন পরিচিত শতমুখে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে প্রচার-অপপ্রচার চালিয়েছে, বিএনপি-জামায়াত সেভাবে পারেনি। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া, দুই প্রভাবশালী নেতা কাদের মোল্লা ও কামারুজ্জামানের ফাঁসি, ভোগকালীন কারাগারে গোলাম আযমের মৃত্যু, অনেকের জেল, মামলা-মোকদ্দমা, বিশেষ করে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দলগতভাবেও কোণঠাসা জামায়াত বর্তমানে ব্যাক ফুটে আছে। তাদের পক্ষে সরকারের সঙ্গে টক্কর দেওয়া সম্ভব নয়। তারা কৌশলীও বটে! কখনো কখনো সরকারের সঙ্গে তলে তলে তাদের সমঝোতার ব্যাপারেও রব ওঠে। বিএনপির ব্যাপারটা কিন্তু বিস্ময়কর তাদের পার্টি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া এসব ব্যাপারে জোরালোভাবে কথা বলার যেন লোকই নেই। তিন মাসের অবরোধ চলাকালে সহিংসতা-নাশকতার সঙ্গে বিএনপি জড়িত নয় এ কথা বেগম জিয়াই বারবার বলেছেন। বিএনপির স্ট্যান্ডিং কমিটির প্রায় এক কুড়ি সদস্যের মধ্যে একজন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত, আর দুজন খোন্দকার মোশাররফ হোসেন এবং গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কারারুদ্ধ। বাকি সবাই মুক্ত আলো-বাতাসেই আছেন। তাদের মধ্যে লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান প্রায়শ কথাবার্তা বলেন মিডিয়ায়, লেখালেখিও করেন মাঝে মাঝে। আর দুজন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হান্নান শাহ এবং নজরুল ইসলাম খানের নামও হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকের মতো দেখা যায়। কিন্তু বড়ই নিষ্প্রভ। দলের সাইজ ও নেতার সাইজ অনুযায়ী ভূমিকা অতিশয় অদৃশ্য প্রায়। ফলে তিন মাসের সহিংসতা-নাশকতার ব্যাপারে ব্লেইম গেমেও পরাস্ত বিএনপি। তাছাড়া 'করপোরেট হাউসের' মতো কর্মচারী দ্বারা চালিত দল হয়ে যাওয়ায় অনেক সময়ই বোঝা মুশকিল হয়ে যায় যে, এটা কি একটি রাজনৈতিক দল? তিন মাস লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি পালন করে (এখনো সেই কর্মসূচি নাকি জারি আছে) তারা যে রাজনৈতিক অপরিপক্বতার পরিচয় দিয়েছে তাতে দলের বর্তমান সর্বেসর্বাদের রাজনৈতিক মানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। একটি রাজনৈতিক দল তার সাংগঠনিক অবস্থা, সমর্থনের জোর ও জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও কষ্ট স্বীকারের সীমারেখা বিবেচনা করেই কর্মসূচি প্রণয়ন করে। কর্মসূচির পরিধি, সময়কাল ও তীব্রতা নির্ধারণ করা হয় সাফল্যের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। যে কর্মসূচি দলের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের কাছেই বোঝা ও জনক মনে হয়, জনগণ যাতে শুধু ক্ষতিগ্রস্ত ও বিরক্ত হয় না, বিরোধিতাও শুরু করে, সে কর্মসূচি ব্যর্থ বলে প্রমাণিত হয়। বিএনপি-জামায়াতের তিন মাসের টানা অবরোধ ও দুই মাসের হরতাল কর্মসূচি তার সাফল্য লাভ করেনি। কোনো প্রকাশ্য আন্দোলন কর্মসূচি যদি ব্যর্থতার পথে এগুতে থাকে, সেখান থেকে ফিরে আসা সহজ নয়। মেরে-কেটে, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালিয়েও যদি কোনো আন্দোলন-লড়াই মোকাবিলায় শাসকগোষ্ঠীও ব্যর্থ হয়, সেই আন্দোলন সহিংসতা-নাশকতা হোক, আর অবরোধ-অসহযোগই হোক- তারও এমন একটা পথ খোঁজা উচিত, যে পথে শান্তি আর স্বস্তির আলোর রেখা দেখা যায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের বিরোধিতা করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে একটি অংশগ্রহণমূলক মধ্যবর্তী নির্বাচন চেয়ে আসছে বিএনপি। অনেকের ধারণা, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক এবং একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামী বিএনপির এ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলে আন্দোলনটি ভিন্ন মর্যাদায় অভিষিক্ত হতো। একটি অংশগ্রহণমূলক, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি গণতান্ত্রিক দাবি। এই দাবিতে আন্দোলন গণতান্ত্রিক আন্দোলন। সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি গণতন্ত্রের মিত্র নয়, শত্রু। এদের সঙ্গে নিয়ে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হয় না। তাছাড়া বিএনপির এজেন্ডা আশু মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি আদায় হলেও জামায়াতের এজেন্ডা কিন্তু তা নয়। তাদের এজেন্ডা দল ও নেতাদের রক্ষা করা। অস্থিতিশীলতা জিইয়ে রাখতে পারলেই তাদের লাভ। বিএনপি জিতে গেলে সুবিধা নেবে, চাপে ফেলে সরকারের কাছ থেকে তলে তলে ফায়দা নেওয়া গেলে তাও লাভ। সঙ্গিনী-সাপের মতো। এরা বিএনপির সঙ্গে না থাকলে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের ছোট-মাঝারি কিছু প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল, শক্তি ও ব্যক্তিকে বিএনপি কাছে পেতে পারত। সে যাগগে। তিন মাসের আন্দোলনে বিএনপি তার লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি এটাই হলো সত্য। সরকার শক্তি প্রয়োগ করেও জনগণের জানমালের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। এটাও সত্য।
এমতাবস্থায় তিন সিটি নির্বাচনের ঘোষণাটি আসে। এর আগে থেকেই দুই পক্ষকে এক জায়গায় বসানো এবং একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ চলে নানা মহল থেকে। ব্যবসায়ীরা উদ্যোগ নেন, বুদ্ধিজীবী মহল থেকে চেষ্টা করা হয়, সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. শামসুল হুদার নেতৃত্বে একটি নাগরিক কমিটিও গঠিত হয় সমঝোতা উদ্যোগ চালানোর উদ্দেশ্যে। তারা এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী এবং বিএনপি চেয়ারপারসনকে চিঠিও লেখেন। বিদেশি কূটনীতিকদেরও প্রকাশ্যে উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, খোদ জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন পর্যন্ত হস্তক্ষেপ করেছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিনের সমঝোতার উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখেনি। হঠাৎ করে মনে হলো বরফ গলতে শুরু করেছে। মারমুখী দুই নেত্রী শেখ হাসিনা, বেগম খালেদা জিয়া হঠাৎ করেই যেন শান্ত হলেন। বেগম খালেদা জিয়া আদালতে হাজিরা দিলেন, সরকার জামিন আবেদনে কোনো প্রকার বিরোধিতা করল না, খালেদা জিয়ার জামিন হলো, তিনি তার গুলশান অফিসে নয়, বাসায় গেলেন। সব কিছু যেন ম্যাজিকের মতো ঘটল। সিটি নির্বাচনের ঘোষণা এলো। সবার মনে থাকার কথা যে, উপজেলা নির্বাচনের তৃতীয় ধাপ থেকে শেষ ধাপ পর্যন্ত শাসক দলের সীমাহীন কারচুপি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বৈরী ভূমিকা, সর্বোপরি নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের প্রতিবাদে বিএনপি ঘোষণা করেছিল, বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অধীনে তারা আর কোনো নির্বাচনে যাবে না। কিন্তু সেই ঘোষণা থেকে সরে এসে তিন সিটি নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘোষণা দিলেন বেগম খালেদা জিয়া। এটা অবশ্যই একটা তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।
নির্বাচনটি শান্তিপূর্ণ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে বলে যেমনটি আশা করা গিয়েছিল মোটেই তেমন হয়নি। বরং এই সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকেও হার মানিয়েছে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ছিল না। একপক্ষীয় নির্বাচনে ১৫৩ আসনে কোনো নির্বাচনই হয়নি। বাকি আসনে 'আমরা আর মামুরা' মিলে যা খুশি তাই করেছে। এবার তিন সিটি নির্বাচন ছিল অংশগ্রহণমূলক। শুনেছি প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনটি স্বচ্ছ করতে চেয়েছিলেন। এখন চরম একটি অস্বচ্ছ ও নোংরা নির্বাচনের বদনাম বইতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকেই। অনেকে বলেন, সরকারের মধ্যে আরেকটি শক্তিশালী সরকার আছে। তারা পরাজয়ের কোনো ঝুঁকি নেননি। এই নির্বাচনে পরাজয়কে তারা হয়তো ভেবেছেন সরকারের দ্রুত বিদায়ের অশনি সংকেত। তারাই নির্বাচন কমিশনকে প্রভাবিত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচন কমিশন তাই এই নির্বাচনে প্রতিশ্রুতি দিয়েও 'লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড' নিশ্চিত করেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সরকার পক্ষের প্রার্থীদের সুবিধার জন্য যা যা করা দরকার সব কিছু করেছে বলে এন্তার অভিযোগ মিডিয়াতেও এসেছে। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা অনেকে বাসাবাড়িতেই নেই, এলাকাতেও থাকতে পারেননি। কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থীকে গ্রেফতারও করা হয়। বিরোধীরা নির্বাচনে সেনাবাহিনী তলবের দাবি করেছিল। নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্তও নিয়েছিল ২৬ থেকে ২৮ এপ্রিল সেনাবাহিনী টহলে থাকবে। কিন্তু পরদিনই তা পাল্টে ফেলে। নির্বাচনের দিন যে ধরনের কারচুপির অভিযোগ পত্র-পত্রিকায় এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের পর্দায় এসেছে, সেনাবাহিনী টহলে থাকলে এসব সম্ভব হতো না বলেই বলছেন পর্যবেক্ষকরা। সব নির্বাচনী কেন্দ্র যে শাসক দলের লোকদের নিয়ন্ত্রণে ও পাহারায় ছিল তা প্রত্যক্ষ করেছে। এমন একটা ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছিল যে, বিরোধী প্রার্থী বা তাদের কর্মী-সমর্থকরা তো বটেই, সাধারণ মানুষও ভয়ে পা বাড়ায়নি সেদিকে। যা ইচ্ছা তাই হয়েছে ভোটকেন্দ্রের ভিতরে। জাল ভোট, সিল মারামারি, আগেই ব্যালট পেপারে সিল মেরে রাখা, কী হয়নি? মিডিয়াতে সবই ফাঁস হয়ে গেছে। 'জনগণের চোখের সিসিটিভিতে' সবই ধরা পড়েছে। এই লজ্জা এবার বিদেশি কূটনীতিকদের কাছেও লুকিয়ে রাখা যায়নি। এই নির্বাচনে বিএনপির বহু দুর্বলতা আছে। প্রমাণ হয়েছে বিএনপির সমর্থক বিপুল, কিন্তু সংগঠন বড় দুর্বল। প্রার্থী বাছাইয়ে দুর্বলতা ছিল। তাবিথ আউয়াল বিএনপির কে? বিকল্প কোনো প্রার্থী ছিল না কেন? ৯৩ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ৫৪ জনই মামলায় জড়িত প্রার্থী কেন দেওয়া হলো? বিএনপিতে আর লোক নেই? বিকল্প এজেন্ট ছিল না কেন? যেসব এজেন্টকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি বা বের করে দেওয়া হয়েছে বা ভয় দেখানো হয়েছে আগের রাতে তারা কারা? তারা প্রতিবাদ করল না কেন? সব এজেন্ট পার্টি অফিসের সামনে জড়ো হলে তো ১৫-২০ হাজার লোকের একটা প্রতিবাদ সমাবেশ ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদী মিছিল করা যেত। পুলিশ বাধা দিত বা মামলা দিত বা গ্রেফতার করত- এই তো? 'খাড়া' কমিটি 'শোয়া' কমিটি, 'লম্বা' বেঁটে কমিটির মতো কমিটি! কত নেতা! তারা কই? যাদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা নেই তারাই বা কই? সেদিন ভোট জালিয়াতির শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ করতে গিয়ে ২০০-৩০০ বা তারও বেশি নেতা-কর্মী গ্রেফতার হতেন তাতে রাজনৈতিক অর্জন কি আরও বেশি হতো না? নির্বাচন বর্জনের ঘোষণাটি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদের কাছে এসেছে একজন কর্মচারীর মাধ্যমে। টেলিফোনে তা শোনা গেছে। বেগম খালেদা জিয়ার বরাত দিয়ে প্রদত্ত নির্দেশনাটি যদি মিথ্যে হতো? হতে তো পারত। এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও দলের প্রধান নেত্রী যদি তার নীতিনির্ধারক(!) একজন সহকর্মীর সঙ্গে সরাসরি কথা না বলেন, দলের অন্য নেতা-কর্মীরা দলের এমন উঁচু পদাধিকারীকে মান্য করবে না, গুলশান অফিসের কর্মচারীদের তোয়াজ-তোষামোদ করবে?
এতসব ভুল-দুর্বলতার পরও এই সিটি নির্বাচনে বিএনপি একটি কাজ করতে পেরেছে সাফল্যের সঙ্গে। দেশি-বিদেশি সবার কাছে সরকারি দলের কারচুপি হাতেনাতে ধরিয়ে দিতে পেরেছে। পেরেছে মুখোশ উন্মোচন করে দিতে। বিদেশি কূটনীতিকরাও সরেজমিন, স্বচক্ষে দেখলেন সব কিছু। দেখে তারা স্তম্ভিত ও হতাশ।
সিটি নির্বাচন সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করেছেন। তাদের পর্যবেক্ষণেও ধরা পড়েছে ভোট কারচুপি। তারা কারচুপির নিরপেক্ষ তদন্ত চেয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে বলা হয়েছে, বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণভিত্তিক অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া দরকার। যুক্তরাজ্যও একই দাবি করেছে। এদিকে ভোট কারচুপির তদন্ত চেয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডা। তাদের সুষ্ঠু তদন্তের ব্যাপারে জাতিসংঘও দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে। স্পষ্ট হয়েছে, ভোট কারচুপি হাতেনাতে ধরা পড়েছে বিদেশিদের কাছেও। সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম শাখাওয়াত হোসেন বলেন, প্রার্থিত তদন্ত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে হলে তদন্ত প্রক্রিয়া থেকে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে দূরে রাখতে হবে।
এমন একটি কেলেঙ্কারির নির্বাচনে ইসি যাদের বিজয়ী ঘোষণা করেছে, এই জয়ে কোনো স্বচ্ছতা নেই, গৌরব নেই। বিএনপি ভোট বর্জন করে রাজনৈতিকভাবে বড় অর্জন করেছে। ভোট কারচুপি হাতেনাতে ধরিয়ে দিয়ে তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং তার মিত্রদের মুখোশের অন্তরালে লুকোনো আসল চেহারা উন্মোচন করে দিতে পেরেছে। গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের মন্তব্য হচ্ছে, সরকার ও নির্বাচন কমিশন একটি বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রের বুকেই বিষাক্ত তীর বিদ্ধ করল। এতে আপাতত সুখ সুখ মনে হলেও আখেরে দুঃখ আছে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
ই-মেইল :[email protected]