তিন মাস ধরে টানা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি- একদিকে পেট্রলবোমা, অপরদিকে ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ ও গণপিটুনির নামে বিচারবহির্ভূত হত্যা, যে ভীতিজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, ঢাকা-চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচন সেই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের একটু ক্ষীণ আশার আলো দেখাতে পেরেছিল। কিন্তু হায়! তা মাত্র কয়েক দিনের জন্যই। ২৮ এপ্রিল নির্বাচনের নামে যে তামাশা অনুষ্ঠিত হলো, তাতে বরং গণতন্ত্রের সামান্যটুকু আশাও মিলিয়ে গেল।
বাংলাদেশ প্রতিদিনসহ প্রায় সব খবরের কাগজ এবং বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে ভোট রিগিং এবং প্রিসাইডিং অফিসার ও পুলিশের উপস্থিতিতে সরকারি দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে গণহারে সিল মারার যে চিত্র দেখা গেল, তাতে আর যাই হোক, একে নির্বাচন বলা যায় না। হ্যাঁ, তামাশাই বটে। তামাশা দেখে অনেক সময় মানুষ কৌতুকবোধ করে, আনন্দ পায়। এই তামাশা নিয়ে তেমন ভাব সৃষ্টি হওয়ার কোনো কারণ ছিল না। কারণ এ যে বড় নির্মম তামাশা। এর সঙ্গে একটি আদর্শবোধ, মূল্যবোধ এবং সর্বোপরি গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ঘটেছিল।
সরকারি দল আওয়ামী লীগ দাবি করছে যে, বিএনপির নির্বাচন বর্জন ছিল পূর্বপরিকল্পিত। এমন অনুমানের সত্যতা থাকতেও পারে, আবার না-ও পারে। কিন্তু সে যাই হোক, বিএনপির মনে মনে কী ছিল, সেই বিশ্লেষণ দ্বারা কি কেন্দ্র দখল ও গণহারে সিল মারাকে যুক্তিসিদ্ধ করা চলে? তবু সরকারপক্ষীয় কোনো কোনো দলকানা অথবা দলদাস বুদ্ধিজীবী (এখন আওয়ামী বুদ্ধিজীবী ও বিএনপি বুদ্ধিজীবীর বাইরে প্রকৃত নিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা খুবই নগণ্য) বলতে চেয়েছেন যে বিএনপির বর্জন সত্ত্বেও তারা যে পরিমাণ ভোট পেয়েছেন, তা নাকি তাদের জন্য আশাপ্রদ সংবাদ হলেও হতে পারত। বস্তুত, যেখানে গণহারে সিল মারাই ছিল একমাত্র ঘটনা, সেখানে আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন কর্তৃক ঘোষিত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে কি কোনো বিশ্লেষণ করা চলে? না কোনো সিদ্ধান্তে আসা যায়? এমনও হতে পারে, যারা কেন্দ্র দখল করে সমানে সিল মেরেছেন, তারাই 'দয়া করে' প্রতিদ্বন্দ্বীকেও কিছু ভোট পাইয়ে দিয়েছেন, যাতে মনে হয় যেন আসলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছিল। এটা ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের একটা কৌশলও বটে।
দ্বিতীয়ত, শুধু বিএনপি নয়, সরকারি দলের বাইরে আরও যে সব দল ছিল, তারাও হয় বর্জন করেছেন অথবা প্রত্যাখ্যান করেছেন। কেউ সকালে, কেউ দুপুরে, কেউ বিকাল ৪টায়। সর্বত্র ব্যাপকভাবে এবং একই প্যাটার্নে যেভাবে রিগিং হয়েছে, তাতে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, রিগিংটাই বরং ছিল পূর্বপরিকল্পিত। বেশ আগে থেকেই ছিল সরকারি দলের একটা মাস্টার প্ল্যান। সেটা নির্বাচন কমিশনেরও জানা ছিল। সেই পরিকল্পনার কিছু কিছু আলামত আগের দিনই ধরা পড়ে গিয়েছিল।
আগের রাত থেকেই ত্রাস সৃষ্টি করা ছিল সেই মাস্টার প্ল্যানেরই অংশ। খালেদা জিয়ার গাড়ি বহরে হামলা তারই অংশ ছিল। হ্যাঁ, পেট্রলবোমার কারণে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছিল। অগ্নিদগ্ধ মানুষ যে ক্ষুব্ধ ছিল, এটা মনে করার কারণ আছে। কিন্তু পরপর তিন দিন তার গাড়িতে যারা আক্রমণ চালিয়েছিল, তারা সেই বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ নয়। যারা এই আক্রমণ করেছিল, তাদের ছবি ছাপা হয়েছিল খবরের কাগজে। তারা সবাই ছিলেন ছাত্রলীগের চেনা মুখ। পিস্তলসহ ছবি দেখা গেছে। পুলিশের সামনেই ঘটনা ঘটেছিল। পুলিশ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছিল। আর নির্বাচন কমিশনও তাই। বরং তারা আক্রান্ত খালেদাকেই নোটিস দিয়েছিল। ২৭ এপ্রিল বিকাল বেলায় কল্যাণপুরে সিপিবি-বাসদের এক পথসভায় স্থানীয় সরকার দলের লোকেরা অকস্মাৎ আক্রমণ করে নারীসহ অনেককে আহত করেছিল। সেদিন সন্ধ্যায় সিপিবির মেয়র প্রার্থী ক্বাফী রতনের তেজগাঁও অফিস ভাঙচুর করেছিল সরকারি দল। উদ্দেশ্য সন্ত্রাস সৃষ্টি করা, যাতে পরদিন রিগিংয়ের কাজটি ভালোভাবে করা যায়। ২৭ এপ্রিল সিপিবি সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম অভিযোগ করেছিলেন, থানার পুলিশ কর্মকর্তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধমক দিচ্ছে, যাতে পোলিং এজেন্ট না দেওয়া হয়। কমরেড সেলিম কয়েকটি থানার নাম পর্যন্ত উল্লেখ করেছিলেন বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্টের ভিত্তিতেই।
অনেকে বলছেন, সকাল বেলায় কেন বর্জন করা হলো। শেষ পর্যন্ত দেখলেই তো হতো। এ প্রসঙ্গে সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. শামসুল হুদা বলেছেন, নির্বাচনের শুরুটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তার বক্তব্য থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করা যাক, 'অনেক কেন্দ্রে একমাত্র সরকারদলীয় প্রার্থী ছাড়া অন্যদের পোলিং এজেন্ট ছিল না। এ বিষয়ে অভিযোগ হলো, আগের রাতে অনেক পোলিং এজেন্টের বাড়ি বাড়ি গিয়ে তাদের ভয়ভীতি দেখিয়ে না আসতে বলা হয়েছে। তারপরও যারা এসেছেন তাদের অনেককে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আবার অনেককে বের করে দেওয়া হয়েছে। পোলিং এজেন্ট ভোট গ্রহণের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ।' এজেন্টের সামনেই বাক্স দেখানোর নিয়ম আছে। এজেন্টরা দেখবেন সেখানে আগের থেকে ব্যালট ঢুকানো হয়েছে কিনা। কিন্তু সেই সব কিছুই হয়নি। ড. শামসুল হুদা আরও বলেছেন, 'এরপর তৃতীয় চোখ হিসেবে ছিলেন সাংবাদিকরা। কিন্তু অনেক স্থানে তাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি, অনেকে আহত হয়ে হাসপাতালে গেছেন।'
ড. শামসুল হুদা যা বলেছেন, তা আমরা অনেকেই সরাসরি চোখে দেখেছি (অথবা টিভির পর্দায় দেখা গেছে)। এসব দেখেই বামপন্থি দল সিপিবি-বাসদও ঘৃণাভরে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছিল। সিপিবির সাধারণ সম্পাদক কমরেড সৈয়দ আবু জাফর আহমদ সংবাদ সম্মেলন ডেকে ২৮ এপ্রিল বিকাল ৪টায় যা বলেছেন, সেটাও প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, 'ভোটকেন্দ্র দখল করে, আগে থেকেই ব্যালট বাক্স ভরে রেখে, সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে জাল ভোটের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ... ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন, জালিয়াতির উপজেলা নির্বাচনের পর আজকের ভোট ডাকাতি ও প্রহসনের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রমাণ হয়েছে, এই সরকারের অধীনে কোনো অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। নির্বাচনের নামে জনগণের সঙ্গে তামাশার মাধ্যমে গণতন্ত্রের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা হয়েছে।' আমাদের দেশের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে একটা প্রবণতা আছে, বিদেশিরা কী বলে, তা দেখার। এই প্রবণতা জনগণের মধ্যে সম্প্রসারিত হয়েছে। বিদেশি কূটনীতিক, মিডিয়া, বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার সংস্থা, দূতাবাস কেউই এ নির্বাচনকে ভালো সার্টিফিকেট দিতে পারেনি। আসলে বাস্তব ঘটনা সবার সামনে এত জলজ্যান্তভাবে ছিল যে, ভিন্ন কিছু বলার সুযোগও ছিল না। ২৮ তারিখ ভোট গ্রহণ বা গণহারে সিল মারার প্রক্রিয়া চলাকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট চার চারটি টুইট বার্তা পাঠিয়েছিলেন। তার মধ্যে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত অথচ সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল যে বার্তাটি তা ছিল 'যে কোনো মূল্যে জিততে চাওয়া আসলে কোনো জয়ই নয়।' বস্তুত, সরকারি দল যে কোনোভাবেই জিততে চেয়েছিল। কেন্দ্র দখল ও গণহারে সিল মারাই ছিল তাদের কৌশল। এভাবে তারা আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে একটা ঘোষণা করিয়ে বিজয়ীর ভাব দেখাতে পারলেও, তারা যে আসলে জেতেনি একথা এখন কে না জানে।
২৮ এপ্রিল তারিখেই মার্কিন দূতাবাস যে বিবৃতি দিয়েছে তা ছিল নিম্নরূপ, 'আজকে বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে ভোট জালিয়াতি, ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে ব্যাপক ও বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন পাওয়া গেছে এবং বিএনপি সিটি করপোরেশন নির্বাচন বয়কটের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাতে আমরা হতাশ।' 'ব্যাপক' এবং 'বিশ্বাসযোগ্য' শব্দদ্বয় কিন্তু খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুখপাত্র বলেছেন, 'শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও স্বচ্ছ নির্বাচনের জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আহ্বান সত্ত্বেও ২৮ এপ্রিল ঢাকা-চট্টগ্রামের নির্বাচন যে ভোট রিগিং, ভয়ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতা দ্বারা সম্পূর্ণরূপে বিনষ্ট হয়েছে, এমন বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট আছে। ... ভোটারদের গণতান্ত্রিক পছন্দসই ভোট প্রদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।'
বলাই বাহুল্য, যা ঘটে গেল তার পরিণাম বড় ভয়াবহ। জনপ্রিয়তা হারিয়েও হয়তো সরকার আরও কিছুকাল ক্ষমতায় থাকতে পারবে। বস্তুত, মেয়র নির্বাচন দ্বারা সরকার পরিবর্তিত হতো না। তবু সরকার কেন এমনটা করল? কারণ সরকার কোনোভাবেই পরাজয় স্বীকার করতে রাজি ছিল না। কিন্তু যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে সরকারি দলের প্রার্থী পরাজিত হতেন, তাহলেই বরং সরকারের মুখ উজ্জ্বল হতো। কিন্তু না, সেভাবে সরকার ভাবছে না। জয়ী তাদের হতেই হবে, যেমন করেই হোক। সে জয় যে জয় নয়, তা তো আগেই বলেছি। এই নির্বাচন (?) প্রসঙ্গে সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) শাখাওয়াত হোসেন যথার্থই বলেছেন, 'কেউ জেতেনি, হেরেছে সবাই।' বিশেষ করে হেরেছে সরকারি দল। ভাবমূর্তি খুইয়েছে। ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল সামরিক শাসকদের মতোই একই পথ গ্রহণ করল।
আর এটা করতে গিয়ে তারা যে মাস্তানদের ব্যবহার করেছেন ভোট কেন্দ্র দখলের জন্য, সেই মাস্তানরা যে পরবর্তীতে অন্যকিছু দখলের জন্য সাহসী ও উদ্ধত হয়ে উঠবে, এমন আশঙ্কা অমূলক নয়। সম্পত্তি দখল, জবর দখল, টেন্ডারবাজি, যা এখনো আছে, তা আরও ব্যাপক ও ভয়াবহ হয়ে উঠবে। সরকার যে ফ্রাঙ্কস্টাইনের জন্ম দিল, সেটা কি ভবিষ্যতে কাল হয়ে দেখা দেবে না? এ যে বড় ভয়ঙ্কর খেলা। এ খেলার পরিণতি কোথায় আমরা জানি না। তবে এটুকু বলতে পারি যে, পরিণতি শাসক দলের জন্যও সুখকর হবে না।
এবার যা হয়েছে তা ভোট চুরি নয়, এমনকি ডাকাতি বললেও কম বলা হবে। এর ফলে আমরা হারালাম গণতন্ত্র। দীর্ঘদিনের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণ যেটুকু অধিকার অর্জন করেছিল, তাকে পুনরুদ্ধারের জন্য যে আবার জনগণকে সংগ্রাম করতে হবে।
হায় গণতন্ত্র! ৪৩ বছরেও জনগণ গণতন্ত্রের স্বাদটুকুও পেল না।
লেখক : রাজনীতিক।