আমাদের দেশে 'সুশীল সমাজ' বা 'সিভিল সোসাইটি' অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় ইদানীং কেন যেন বেশি মাত্রায় সক্রিয়। এখন তারা না চাইতেই শলাপরামর্শ করে দেশের মানুষ ও সরকারকে অনেক উপদেশ-পরামর্শ দান-খয়রাত করছে, যথেষ্ট হেদায়েত করছে। ইদানীং ওরা 'জনমত ইঞ্জিনিয়ারিং'-এ মহাব্যস্ত! এসবের কারণ কি এই যে ওরা খুব দেশপ্রেমিক, মানবপ্রেমিক, শান্তিকামী? এ এক গভীর অনুসন্ধানের বিষয়। বৈশ্বিক পুঁজিবাদের হোতা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বৈশ্বিক শান্তির এক সমাধান আবিষ্কার করেছে, যার নাম 'সিমিংটন সমাধান'। যে সমাধান তারা ষাটের দশকে ভিয়েতনামসহ পরবর্তী বহু দেশে প্রয়োগ করেছিল। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আবিষ্কৃত 'সিমিংটন সমাধান'টি এরকম : 'আমরা (অর্থাৎ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ) যেহেতু বিশ্বপ্রভু সেহেতু বিশ্বশান্তি রক্ষা আমাদের ঈশ্বর প্রদত্ত দায়িত্ব। আর এ দায়িত্ব পালনে আমরা যখন যেখানে যা ঠিক মনে করব তা-ই করব। আমরা তোমাদের (বিশ্ববাসীকে) শান্তি উপহার দেব তবে আমাদের অবাধ্য হওয়া চলবে না। অবাধ্য হলে হতে পার। অবাধ্যতার শাস্তি তোমাদের জন্য বিজয় হলেও হতে পারে তবে সে বিজয় হবে গোরস্থানের বিজয়'।
শুরুতেই বলা উচিত যে 'সুশীল সমাজ' বা 'সিভিল সোসাইটি' ধারণাটি কোনো নতুন ধারণা নয়। অষ্টাদশ শতকের ফরাসি মুক্তবুদ্ধি-পথিকৃৎদের অন্যতম দার্শনিক জ্যাঁ জ্যাক রুশো বলেছিলেন, 'সুশীল সমাজ হলো ধনীদের এমন এক ষড়যন্ত্র যা তাদের লুণ্ঠন প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়ার গ্যারান্টি প্রদান করে' এবং একই সঙ্গে এ উপসংহারে উপনীত হয়েছিলেন যে, 'সমাজে বৈষম্য-অসমতা-অবিচারের মূল ভিত্তি হলোূ সম্পত্তি ও সম্পদের ওপর ব্যক্তিগত মালিকানা'। আর ইতালিয়ান রাজনৈতিক দার্শনিক এন্থোনিও গ্রামসি বলেছিলেন, 'সুশীল সমাজ হলো সমাজে ঐকমত্য সৃষ্টিকারী মৌল উপাদান যা সমাজে নিয়ামক শ্রেণির কর্তৃত্ব-আধিপত্য বজায়ে অবদান রাখে'।
আসলে 'সুশীল সমাজ' নামক ধারণা বা প্রত্যয়টি যথেষ্ট প্রতারণামূলক-ষড়যন্ত্রমূলক। রিকশাচালক সমাজ, ভ্যানচালক সমাজ, জেলে সমাজ, শ্রমিক সমাজ, রাজনীতিবিদ সমাজ, ভিক্ষুক সমাজ, আমলা সমাজ, চোর-ডাকাত সমাজ, দুর্বৃত্ত সমাজ, ভূমিদস্যু সমাজ, বিচারক সমাজ, গৃহবধূ সমাজূ এসব নামে তো কোনো ভিন্ন ভিন্ন 'সমাজ' নেই। তাহলে কোন গুণ-বৈশিষ্ট্যের কারণে 'সুশীলরা' বিশেষ পদবাচ্য সমাজ হয়? বিভিন্ন পদ-পদবি-পেশার মানুষের সমন্বয়ে কোনো প্রত্যয় বা ক্যাটাগরি দাঁড় করালে তার নাম 'সুশীল' তো হতে পারে না। কারণ তারা 'সুশীল' হলে 'অশীল' বা 'অ-সুশীল' কারা? আবার 'সুশীল' শুনলে মনে হয় এটা 'অভিজাত সমাজের', 'ভদ্রলোক সমাজের', 'উঁচু বংশোদ্ভূত সমাজের', 'ফিটফাট-ধোপদুরস্ত সমাজের' বা 'কুলীন সম্প্রদায়ের' ব্যক্তি বা ব্যক্তি সমষ্টির অপর নাম। অথচ তথাকথিত সুশীল সমাজ আসলে সিভিলও নয় সোসাইটি তো নয়ই। এরা দেশের নাগরিকদের 'বিশিষ্টজন' এলিট ব্যক্তি বলে কথা (!); এরা কমবেশি ধনবান; এদের আছে ক্ষমতা, প্রাচুর্য ও 'সম্মান'; এরা মত-পথ ভাবনা-চিন্তা নির্বিশেষে 'বিশিষ্টজন' হিসেবেই পরিচিত হতে পছন্দ করেন। কিন্তু শেষ বিচারে এরা আসলে স্ব-সেবায় নিয়োজিত মুক্ত-ভাসমান স্বার্থান্বেষী স্বকথিত বুদ্ধিজীবী মাত্র।
এসব সুশীল ভ্রাতা-ভগ্নিদের আবার মাথায় তুলে রাখে সাম্রাজ্যবাদ, বৈদেশিক ঋণ-অনুদান প্রদানকারী গোষ্ঠীসহ বৈশ্বিক অর্থনীতির চালক গোষ্ঠীূ বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা, উন্নত (!) বিশ্বসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের বিভিন্ন কুপরামর্শদাতা 'থিংক ট্যাঙ্ক' অর্থাৎ চিন্তা-মহাদুশ্চিন্তার কারখানা (!), মিডিয়া-গণমাধ্যম, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল যেখানে প্রত্যেক দলের আবার সিলমারা নিজস্ব সুশীল সমাজ আছে, রেন্টসিকার দুর্বৃত্তসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী, গোয়েন্দা সংস্থা, বিভিন্ন মতলববাজ স্বার্থ গোষ্ঠী। কিন্তু এ দেশের (অন্য দেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য) কৃষক-শ্রমিক-দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষ এদের কখনো মাথায় তুলে নেননি, নেবেনও না। কারণ সুশীলদের পেশাটাই বা বলা চলে ব্যবসাটাই (!) 'বুদ্ধি' দিয়ে অন্যের হয়ে অন্যের টাকা পয়সায়, ডলার-পাউন্ড-ইউরোতে সাধারণ জনগণের স্বার্থের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রতারণা করা।
সুশীল ভ্রাতা-ভগ্নিদের কেউই আসলে সংবিধানের অন্যতম মূলনীতি সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতাকে মনের গভীরে বিশ্বাস করেন নাূ কেউ কেউ বিশ্বাসের ভান করেন, আর বিশ্বাস চর্চা করার প্রশ্নই ওঠে না। এরা মানসিক-মনস্তাত্তি্বক ঔপনিবেশায়নে ভোগেন। এরা বিশ্বাস করেন বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিকাশ যে পর্যায়ে পৌঁছেছে এবং মানুষকে তা যা দিতে সক্ষম সেখানে শ্রেণিবিভক্ত সমাজ রূপান্তরের আর প্রয়োজন নেইূ তাদের বিশ্বাসটা ডানিয়েল বেলের 'মতাদর্শের শেষ' বা 'মতাদর্শ বলে কোনো কিছুর আর কোনো গুরুত্ব নেই' জাতীয় তত্ত্বে।
আমাদের দেশে একটু অনুসন্ধান করলেই দেখা যাবে ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে এদের বেশির ভাগ সক্রিয় অংশগ্রহণ করেননি। আর হাতেগোনা দু-একজন যদি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেও থাকেন তাহলে পরবর্তীকালে প্রমাণ হয়েছে যে তারা ছিলেন 'ঘটনাচক্রে মুক্তিযোদ্ধা'। আরও একটু অনুসন্ধান করলে এও দেখা যাবে যে তলায় তলায় এদের অধিকাংশই সক্রিয় জীবনকালের অধিকাংশ সময় এমন মতাদর্শ বিশ্বাস ও চর্চা করেছেনূ দৃশ্যমান অথবা অদৃশ্যভাবেূ যা কোনো অর্থেই জনগণের স্বার্থের পক্ষে নয়, নয় তা দরিদ্র-বঞ্চিত মানুষের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট। এদের অধিকাংশেরই একাধিক দেশের নাগরিকত্ব আছে, আর যে গুটিকয়েক তা ম্যানেজ করতে পারেননি তাদের সাম্রাজ্যবাদী দেশে যাওয়া-আসার জন্য দীর্ঘমেয়াদি মাল্টিপল ভিসা আছে, যা পাসপোর্টখানা দেখলেই বোঝা যাবে। সুশীলরা কেন যেন বিদেশ ভ্রমণে পারদর্শীূ এরা এক ধরনের 'ইবনে বতুতা'! এবং এরা কার টাকায় কখন-কেন-কোন দেশে যান তা আমার কাছে খুব দুর্বোধ্য না হলেও যথেষ্ট রহস্যময়। এদের মধ্যে এমনকি কেউ আছেন যিনি ঢাকার বিভিন্ন দূতাবাসে 'তাদের পছন্দের বাছাইকৃত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্যে আয়োজিত' নৈশভোজে যান না? কেন যান? ওখানে কী কাজ তাদের? এদের অনেকেই ঢাকা ক্লাব-গুলশান ক্লাবসহ বিভিন্ন অভিজাত ক্লাবের সদস্য অথবা অসদস্য হয়ে নিয়মিত অথবা অনিয়মিত বেশ যাওয়া-আসা করেন! ওসব জায়গায় কী করেন? কার সঙ্গে কী নিয়ে কথাবার্তা বলে কী দায়িত্ব-সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘরে ফেরেন?
সুশীল ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ! আপনাদের মধ্যে কেউ কেন দৃঢ়চিত্তে উচ্চকণ্ঠে এবং লাগাতারভাবে বলেন না যে তালেবানইজম, আল কায়েদা, মোল্লা উমর, বিন লাদেনূ এসবই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের 'বিশ্ব প্রভুত্ব রক্ষার স্বার্থে' মার্কিন রাষ্ট্র-সরকার ও মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থারই সৃষ্টি? আপনারা এত ওম শান্তি শান্তি করেন, কিন্তু কেউই কেন উচ্চকণ্ঠে বলেন না যে দেশে ধর্মভিত্তিক মৌলবাদ, জঙ্গিত্ব ও মৌলবাদের অর্থনীতির ভিত উচ্ছেদ না করলে শান্তি আসবে না? আপনারা কেউই কেন বলেন না যে দেশে অর্থনীতি ও রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন যারা ঘটিয়েছে সেসব রেন্ট সিকাররাই রাষ্ট্র-সরকার-রাজনীতিকে অধীনস্থ সত্তায় রূপান্তরিত করে ফেলেছেূ এ থেকে পরিত্রাণ প্রয়োজন? আপনারা কেউই কেন বলেন না যে দেশের ২ কোটি বিঘা খাস জমি-জলা ১ কোটি ভূমিহীন-নিঃস্ব খানা-পরিবারের মধ্যে বণ্টন করা জরুরি? আপনারা একবার ঠাণ্ডা মাথায় ভালো করে ভাবুনূ এটা বললে শেষাবধি আপনাদের লাভ হতে পারে কারণ এ ভয় তো আপনাদের মনের গভীরে কাজ করে যে গরিব মানুষ কখন কী করে বসে, কখন যে আপনার সুউচ্চ-সুরম্য অট্টালিকা দাবি করে বসে ঠিক নেই। আপনারা কেউ কেন বলেন না যে প্রতি তিন মাস অন্তর বাংলাদেশ ব্যাংককে সব বড় ঋণখেলাপির ঋণের সুদ ও আসলসহ নামধাম প্রকাশ করতে হবে? আপনারা কেউই কেন উচ্চস্বরে বলেন না যে দেশের অন্যান্য অনেক প্রান্তিক মানুষের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘু ও আদিবাসী মানুষ প্রকৃত অর্থেই নিপীড়িত-নির্যাতিত এবং এ সমস্যার সুরাহা জরুরিূ আপনারা সংলাপে পারদর্শী কিন্তু এ ধরনের সংলাপের কার্যকর উদ্যোগ নেন না কেন?
সুশীল সমাজের বন্ধুরাূ অন্য সবার উদ্দেশ্যে বাণী-বিবৃতি-পরামর্শ দেওয়ার আগে আপনারা যে জোট বেঁধেছেন ঠিক সেই জোট থেকেই আপনাদের পছন্দের দুই শব্দূ স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার স্বার্থে প্রথমেই পত্রপত্রিকা-রেডিও-টেলিভিশনসহ সব গণ ও ব্যক্তি যোগাযোগ মাধ্যমে কেন ঘোষণা দেন না বা প্রকাশ করেন নাূ আপনাদের প্রত্যেকের (স্বামী-স্ত্রী-সন্তানাদি পৃথকভাবে) নামধামসহ দেশে এবং/অথবা বিদেশে অস্থানান্তরযোগ্য ও স্থানান্তরযোগ্য অর্থকড়িসহ পরিমাণ ও তার বর্তমান বাজার মূল্য, ওই বিত্ত-সম্পদের উৎস, কবে-কীভাবে মালিক হলেন, সম্পদের মালিকানার সঙ্গে সরকারকে প্রদেয় করের সমন্বয়ূ গত ১০ বছরে বছরওয়ারি কী পরিমাণ কর দিয়েছেন, সন্তানাদি কোথায় লেখাপড়া করেছেূ তাতে ব্যয় হয়েছে কত? এখন তারা কোথায় আছে এবং কী করছে, বিদেশি নাগরিকত্ব আছে কিনাূ থাকলে কোন দেশের, গত ১০ বছরে কোন কোন দেশে কী কাজে গেছেন ইত্যাদিসহ এদেশের জনগণের কাছে আপনার নিজ সততা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি প্রকাশ করে আপনাদের স্ব-স্ব স্বচ্ছতা প্রদর্শনে বাধা কোথায়?
সুশীল-ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ! আমার এ প্রস্তাবনা অথবা বলতে পারেন চ্যালেঞ্জ যদি আপনারা গ্রহণ না করেন তাহলে আমার ধারণাই পুরোপুরি সত্য হবে যে আপনারা আসলে জনগণকে মনে করেন 'বিরাট জন্তু বিশেষ' যেমনটি মনে করতেন আলেকজান্ডার হ্যামিলটন। জনগণ আপনাদের কাছে 'বিরাট জন্তু বিশেষ' যা 'ভৃত্য তুল্য' যে ভৃত্যের উচ্চকণ্ঠ যে কোনো মূল্যে রুদ্ধ করাটাই প্রভুর পবিত্র দায়িত্ব! আমার এসব কথা সঠিক হলে সুশীল সমাজের এসব মানুষের বেশির ভাগই আসলে হবেন বিভিন্ন ধরনের বিভিন্ন মাপের বিশেষজ্ঞ (!) 'মতলববাজ'; আর এদের মধ্যে যারা তুলনামূলক 'ভালো' বলে নিজেদের ভাবেন তারা আসলে ওই মতলববাজদের খপ্পরে পড়েছেন তবে বুঝে উঠতে পারছেন না অথবা ইতিমধ্যে দেরি হয়ে গেছেূ বুঝে লাভ নেই। এরা মেকি; এদের 'বুদ্ধিবৃত্তিক জালিয়াতি চক্র' বললে অত্যুক্তি হবে না। এই 'সুশীলদের ঐকমত্য' মানেই গণমানুষের স্বার্থরক্ষাকারী মতাদর্শের মৃত্যু। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে এখন সুশীলদের উদ্দেশ্যে 'মনষা পূজা' করে বলা দরকার 'বাবা উপকার দরকার নেই আমার ক্ষতি কর না!'
সুতরাং, প্রকৃত বিচারে 'সুশীল সমাজ' প্রত্যয়টি শুধু ভ্রান্তই নয় তা হীনউদ্দেশ্যে বিনির্মিত প্রত্যয়; রাষ্ট্রের সমান্তরাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে এদের সৃষ্টি করা হয়েছে; আর যে অসীম শক্তিধর বিশ্বপ্রভু-শক্তি এটা করেছে তাদের নিজ দেশে (বা দেশসমূহে) 'সুশীল সমাজ' বলে কিছু নেই! ইদানীং কেউ কেউ আবার বেশি সমাদর অথবা ভিন্নতা প্রদর্শনে 'সুশীল সমাজকে' 'নাগরিক সমাজ' বলে আখ্যায়িত করেন। এসব একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ।
অর্থনীতি শাস্ত্রের চাহিদা সরবরাহের বিধিটি সুশীলদের ক্ষেত্রে পুরোদস্তর প্রযোজ্য : দেশে অস্থিরতা বাড়লে অথবা অস্থিরতা বাড়ানোর প্রয়োজন হলে অথবা দেশের মানুষকে অন্য দেশে সংঘটিত ঘটনাবলি সম্পর্কে বিভ্রান্ত করার প্রয়োজন হলে সুশীলদের বাজার মূল্য বাড়ে তবে সামাজিক মূল্য আসলে বাড়ে না, কমে। আর দেশ সুস্থ-সুস্থির-শান্ত থাকলে এদের দাম কমে তবে সামাজিক মূল্য বাড়লেও বাড়তে পারে যদি 'সুশীল বাজারে' প্রতিযোগিতা কম হয় এবং/অথবা সুশীলরা যে কোনো কারণেই হোক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আপাতদৃষ্টিতে জনগণের পক্ষাবলম্বন করতে বাধ্য হন (সেটাও প্রধানত স্ব-স্বার্থে)। আবার কখনো কখনো কৃত্রিমভাবে এদের দাম বাড়ানো হয়ূ এটা বলা যায় 'রাজনৈতিক মূল্যবিধি'। মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতায় 'সুশীল বাজারে' নষ্ট-ভ্রষ্ট-বুদ্ধিবৃত্তিক জালিয়াতি পটিয়সী এসব সুশীলের প্রয়োজন হয় বিভিন্ন সভা-সমিতিতে প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, সভাপতি, 'সর্বজ্ঞানে জ্ঞানান্বিত' বক্তা হিসেবে; আর তা প্রচার-সম্প্রচারে বিশ্বপ্রভুদের স্বার্থে পরিচালিত দেশি-বিদেশি প্রোপাগান্ডা সিস্টেম সদাপ্রস্তুত থাকে যা মানুষের চিন্তাভাবনা-চেতনা-বুদ্ধি-বিবেক-আচরণ নিয়ন্ত্রণ ও তা নির্দিষ্ট দিকে পরিচালনে যথেষ্ট কার্যকর ভূমিকা পালন করে।
'সুশীল' ভাই ও বোনেরা! আপনারা অনেকেই ধনী-দরিদ্রের 'সমান অধিকারের' কথা বলেন, বলেন 'সুযোগের সমতার' কথা, বলেন 'আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান'। কিন্তু একথা কেন বলেন না যে লঞ্চ টার্মিনালের উন্মুক্ত এলাকায়-ফেরিঘাটে-দূরপাল্লার বাসস্ট্যান্ডে-রেলস্টেশনে-গ্রাম-শহরের হাটবাজারে-বস্তিতে ধনী-গরিবের রাতে ঘুমানোর সমান অধিকার আছে? আপনারা কেন দার্শনিক রুশোর 'বৈষম্য-অসমতা-অবিচার' সৃষ্টির উৎস ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংশ্লিষ্ট যুক্তি যে 'সম্পদ-সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানায় হলো উৎসের উৎস' অথবা 'সম্পত্তি হলো চুরি'ৱ এসব খণ্ডন করেন না? আপনারাূ 'সমাজ-আইন' এসব বলে প্রকৃতির বিধি থেকে গরিব-দুর্বল মানুষের স্বাধীনতা ভোগকে চিরতরে উচ্ছেদে ব্যাকুলূ কেন? সমাজ শ্রেণিবিভক্ত অথচ এখানেই আপনারা বলছেন 'ধনী ও গরিবের সমাজের প্রতি সমান দায়িত্ব, সমদায়িত্বের কথা।'
সুশীল ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ! আপনারা শিক্ষিত ও জ্ঞানী। তাহলে একথা তো আপনারা নিশ্চিতভাবেই বোঝেন যে শ্রেণিবিভক্ত সমাজে ধনীর আছে সব কিছু আর গরিবের গায়ের চামড়া ছাড়া আর কিছুই নেই; ধনীরাই গরিবের শ্রমে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত শোষণকারী এবং ধনীরা মানবসভ্যতাকে অধীনস্থ করেছে এবং সমাজকে 'শৃঙ্খলাবদ্ধ' রাখতে ক্ষমতার স্বেচ্ছাচারী প্রয়োগ করে, যে ক্ষমতা প্রকৃতিগতভাবেই অবৈধ। তাহলে কেন বলেন না যে, সুলতানকে সিংহাসনচ্যুত করাটাই 'প্রকৃতিগতভাবে বৈধ'? আসলে শেষ বিচারে গরিব ও দুর্বলকে ঘুম পাড়ানির গান পরিবেশনে আপনারা ওস্তাদ বড়ে গোলাম আলী খাঁ। আপনারা 'ন্যায়বিচার-সমানাধিকার'-এর ঘুুম পাড়ানির গান পরিবেশন করে গরিব-দুর্বলকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ রাখতে বদ্ধপরিকর।
'সুশীল' ভাই ও বোনেরা! আপনারা হলেন সেই মধ্যযুগীয় বিচারক যে বলে 'দাসের ঘরে জন্ম নেওয়া শিশু জন্মসূত্রেই দাসূ মানুষ নয়।' বুঝতে কি পারছেন আসলে আপনারা কী বলছেন, কী ভাবছেন! আপনাদের বোঝা দরকারূ মানুষ তখনই স্বাধীন ও মুক্ত যখন সে শোষণ-বঞ্চনা-নির্যাতন ও এসব সৃষ্টির উৎস থেকে মুক্ত।
'সুশীল' ভ্রাতা ও ভগ্নিগণ! সব কিছু যুক্তিসিদ্ধ বিচার-বিশ্লেষণ করে জেনে-বুঝে সজ্ঞানভাবে এখন যদি বলি আপনারা যেসব কর্মকাণ্ড করেন-করছেন, বলেন-বলছেন এবং প্রচার করেন-করছেন সেসব আমাদের দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দরিদ্র-বঞ্চিত মানুষের স্বার্থানুকূল তো নয়ই তাদের স্বার্থবিরোধীূ কী উত্তর দেবেন? আমি আরও একটু এগিয়ে যদি বলি যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বপ্রভুত্বের লক্ষ্যে যে নতুন মহাকৌশল বা গ্রান্ড-স্ট্রাটেজি বিনির্মাণ করেছে যে কৌশল প্রয়োগে তারা বিশ্বের তিন মৌল-কৌশলিক সম্পদ যথা- পানি সম্পদ, প্রাকৃতিক জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ এবং মহাশূন্য-মহাকাশ সম্পদে থুকোডাইডেস ও মনরো নীতি-মতবাদ অবলম্বনে গায়ের জোরে তাদের নিরঙ্কুশ মালিকানা ও একচ্ছত্র কর্তৃত্ব-আধিপত্য বিস্তার করতে চায়ূ বিশ্বব্যাপী এ মহাকৌশল প্রয়োগ ও বাস্তবায়নে আপনারা হলেন আঞ্চলিক দোসর, 'প্রক্সি' এজেন্ট বা বাংলাদেশি দোসরূ কী উত্তর দেবেন?
উপরোলি্লখিত বিচার-বিশ্লেষণ করে আমি যুক্তিসঙ্গত কারণেই 'সুশীল সমাজ' প্রত্যয়, প্রপঞ্চ বা ধারণাটি বাতিল ঘোষণা করছিূ কেউ তা গ্রহণ অথবা বর্জন করুন তাতে আমার খুব এসে যায় না; আমি এটা করছি নিজের বিবেকের কাছে নিজে পরিষ্কার-স্বচ্ছ থাকার স্বার্থে। যৌক্তিক বিধায় আমি এও ঘোষণা করছি যে যদি এদের 'সুশীল' বলতেই হয় তাহলে বলতে হবে 'সুশীল শ্রেণি' 'সুশীল সমাজ' নয়। কারণ সমাজে শ্রেণি কাঠামোর মই-এ উপর থেকে নিচে যেমন ধনী, মধ্যবিত্ত (উচ্চ, মধ্য, নিম্ন) ও দরিদ্র-গরিব শ্রেণি আছে তেমনি দৃশ্যমান 'সুশীল সমাজের' বেশির ভাগই প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে বিদেশি-দেশি ধনিক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষা করেন, একটা অংশ মধ্যবিত্তদের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করেন, আর অতি নগণ্য হাতেগোনা কয়েকজন দরিদ্র-নিম্নবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের স্বার্থ রক্ষার চেষ্টা করেন। তবে শেষোক্তরা অসংগঠিত এবং 'ভালো মানুষ'(!) বিপদে পড়লে বা একটু রিস্ক দেখলেই সুড়সুড় করে ঘরে ঢুকে পড়েন। তাহলে শেষ বিচারে 'সুশীল শ্রেণি' সমাজের আর্থ-সামাজিক শ্রেণি পিরামিডের মতোই একটি কাঠামো। আর 'সুশীল শ্রেণির' এ কাঠামোতে সমাজ প্রগতির বিভিন্ন প্রশ্নে বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন 'সুশীল' ভিন্ন ভিন্নভাবে সাড়া দেবেূ এটাই স্বাভাবিক।
লেখক : অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ই-মেইল : [email protected], [email protected]