আমার এক বন্ধু থাকেন সুইডেনে। কিছু দিন আগে ফোন করলেন। বললেন, তার বড় ভাই জীবনের শেষ দিনগুলোতে ছিলেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেলে। কিন্তু বড় কষ্ট পেয়েছেন হাসপাতালে। অনেকগুলো রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন চিকিৎসার জন্য। কিন্তু হাসপাতালে ভালো সেবা পাননি। মৃত্যুর আগে তিনি আক্ষেপ করেছেন। হতাশা ব্যক্ত করেছেন। বলেছিলেন, আমি অসুখ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলাম। বের হচ্ছি লাশ হয়ে। বন্ধুটি আরও বললেন, ডাক্তার-নার্স ঠিকমতো থাকত না। সরকারি ছুটি হলে তো কথাই ছিল না। কাউকে পাওয়া যেত না। আয়া-নার্সদের সেবা পাওয়া ছিল দুষ্কর। ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বললে তারা গুরুত্ব দিতেন না। রোগীর কথা শুনতে চাইতেন না। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা নেই। কী সরকারি কী বেসরকারি- সবখানে একই চিত্র। বেসরকারি খাতে চিকিৎসা সেবা মেলে মোটা অর্থে। তারপরও মাঝে মাঝে পাঁচতারকা হাসপাতালের বিরুদ্ধেও অভিযোগের শেষ নেই। দেশের চিকিৎসা সেবার বেহাল দশা কবে ঠিক হবে কেউ জানে না। বিদেশে টাকা দিলে চিকিৎসা মেলে। বাংলাদেশে তাও মেলে না। সিঙ্গাপুর, ব্যাংককে আমি দেখেছি একজন চিকিৎসক গল্প করতে করতে রোগী দেখেন। আমাদের এখানে করেন খারাপ ব্যবহার।
শুধু চিকিৎসা নয়, বাংলাদেশের মানুষের পদে পদে ভোগান্তি। পরিকল্পনা নেই। সেবা খাতগুলোতে এক ধরনের নৈরাজ্য, স্বেচ্ছাচারিতা চলছে। সাধারণ মানুষের চিন্তা কারও নেই। হাসপাতালে গেলে চিকিৎসা নেই। আদালতে গেলে বিচার নেই। থানায় গেলে জিডি করতেও পয়সা লাগে। ঘর থেকে বের হলে ট্রাফিক জ্যাম। বিটিসিএলের সরকারি টেলিফোনের সেবা নেই। সন্ধ্যা হলে মশার অত্যাচার। খাবারে ভেজাল। দুনিয়াজুড়ে খাবারকে সবাই ভেজালমুক্ত রাখে। মানুষের যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। বুড়িগঙ্গার পানি দূষিত। ওয়াসা, ডেসা, তিতাস গ্যাস, বিটিসিএল, রাজউকে সেবা নেই। বিমানের শিডিউল নেই। বৈশাখী উৎসবে গেলে যৌন নিপীড়ন। ফুটপাথ দিয়ে হাঁটা যায় না। গণপরিবহনে ভোগান্তি। ছিনতাই লেগেই আছে। ঢাকার মাঠগুলো হারিয়ে গেছে। পার্কগুলো বেহাল। ঢাকার বিনোদন কেন্দ্র অস্তিত্ব সংকটে। সমাজ-সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সুস্থধারার চিন্তা। মুক্তচিন্তার পথ রুদ্ধ। কাঠিন্য গ্রাস করেছে সবকিছু।
আসলে আমরা এক অস্থির সময় পার করছি। কী রাজনীতি, কী অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতি- সবখানে এক চিত্র। এ পরিস্থিতিতে হলো তিন সিটির নির্বাচন। এ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ ও বর্জন দুটিই ছিল নাটকীয়। তার চেয়ে বড় নাটকীয় ঘটনা বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিনকে ফিরে পাওয়া। ভারতের মেঘালয়ের পুলিশ আটক করেছে সালাহউদ্দিনকে। তিনি নিজেকে পরিচয় দেন বাংলাদেশের সাবেক মন্ত্রী হিসেবে। পুলিশ তার কথায় প্রথমে বিশ্বাস করেনি। পরে তাকে পাঠানো হয় মানসিক হাসপাতালে। একজন চিকিৎসককে সালাহউদ্দিন নিজের পরিচয় দেন। বলেন, কথা বলতে চাই আমার স্ত্রীর সঙ্গে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা করলেন। সালাহউদ্দিন তার স্ত্রীকে বললেন, আমি বেঁচে আছি। ভারতের একটি হাসপাতালে আছি। আবেগে আপ্লুত স্ত্রী কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেন। খবরটি ভূমিকম্পের মতোই ছড়িয়ে পড়ে মিডিয়া অফিসে। রহস্য উপন্যাসের চরিত্রের মতোই একজন মানুষ হঠাৎ হারিয়ে গেলেন। কোনো খোঁজ নেই, খবর নেই। তারপর আবিষ্কার হলেন ভারতের মেঘালয়ের শিলংয়ে। ব্যক্তিগতভাবে সালাহউদ্দিনকে অনেক দিন থেকে জানি। সিভিল সার্ভিসে ছিলেন। এমপি ছিলেন। বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় ছিলেন প্রতিমন্ত্রী। তার নিখোঁজ রহস্য আমাকে বিস্মিত করেছিল। তার সন্ধান পাওয়া গোটা রাজনীতির জন্য শুভ লক্ষণ। আমি অনেক আওয়ামী লীগ নেতাকে দেখেছি স্বস্তি প্রকাশ করতে। উদ্ধারের পর সালাহউদ্দিন বলেছেন, তাকে উত্তরার একটি বাড়ি থেকে অপহরণ করা হয়। তারপর চোখ বেঁধে রাখত সারাক্ষণ। এ কারণে তিনি বুঝতে পারেননি কোথায় ছিলেন আর কী করে ভারত গেছেন।
সালাহউদ্দিনের পুরো ঘটনার তদন্ত করতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তার সব নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা। কারা সালাহউদ্দিনকে অপহরণ করেছে, কেন করেছে সব বের করতে হবে। অন্যথায় আইনের শাসন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একজন ইলিয়াস আলীর সন্ধান এখনো মেলেনি। আমরা নতুন করে এমন ঘটনা আর দেখতে চাই না। এ ধরনের ঘটনা খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। খারাপ নয়, ভালোর পথে এগিয়ে যেতে হবে সবাইকে। অন্ধকার নয়, আলোর পথে হাঁটতে হবে।
সমাজ ও সংস্কৃতিতে তৈরি করতে হবে পজিটিভ কিছু। ভালোকে গ্রহণ করতে হবে দলমত নির্বিশেষে। ব্রিটেনের নির্বাচনে তিন কন্যার জয় ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। রুশনারা আলী, টিউলিপ সিদ্দিক ও রূপা হকের বিজয় আমাদের আশাবাদী করে। উচ্চতার আসনে বাংলাদেশকে নিয়ে যায় সারা দুনিয়াতে। বঙ্গবন্ধুর নাতনির হাউস অব কমন্স জয় শুধু আওয়ামী লীগের বিজয় নয়, বাংলাদেশের সব মানুষের জন্যই মর্যাদার খবর। এর মধ্যে যোগ হয়েছে ভারতের সংসদে সীমান্ত চুক্তি পাস। মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি নিয়ে অনেক মিথ্যাচার হয়েছিল। বলা হতো বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা গোলামির চুক্তি করেছেন। কত বড় মিথ্যাচার। আওয়ামী লীগ জবাব দিত। কিন্তু মিথ্যাচারের কাছে সত্যের লড়াই নিয়ে সাধারণ মানুষও সংশয়ে পড়ত। এত বছর পর নরেন্দ্র মোদি মুজিব-ইন্দিরা ল্যান্ড বাউন্ডারি চুক্তি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন। এতে ভারতের সঙ্গে আমাদের ইতিবাচক সম্পর্কের দরজা আরেক দফা প্রসারিত হলো। বুঝতে হবে আমরা বন্ধু বদল করতে পারি। কিন্তু প্রতিবেশী বদল করতে পারি না। তাই শুধু ভারত নয়, সব প্রতিবেশীর সঙ্গে ইতিবাচক সম্পর্ক নিয়েই আমাদের সামনে যেতে হবে। মিয়ানমারের সঙ্গেও সম্পর্ক ধরে রাখতে হবে। যোগ করতে হবে নেপাল ও ভুটানকে। নতুন করে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনে এই উপমহাদেশকে যেতে হবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নতির ধারায়। পরস্পরের সংকটগুলো বোঝাপড়ার ভিতরে সমাধান করতে হবে। সস্তা ভারতবিরোধী প্রচারণার দিন শেষ করে দিয়েছে মোদি সরকার।
কয়েক দিন আগে ব্রেকফাস্ট টেবিলে একজন পশ্চিমা কূটনীতিকের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা হয়। সিনিয়র সাংবাদিক, সম্পাদক শ্যামল দত্ত, জাফর সোবহান এবং সৈয়দ বদরুল আহসানও ছিলেন। অনেক বিষয় নিয়ে কথা বলার এক পর্যায়ে আমি প্রশ্ন করলাম, তিন মাসের সহিংসতায় বিএনপির লাভ-ক্ষতি সম্পর্কে। পশ্চিমা কূটনীতিক বললেন, বিএনপির লাভ হয়নি। তারা লোকসান করেছে। আমিও তাই মনে করি। বিএনপিকে কারা এই ভুল পথে নিল তা চিহ্নিত করতে হবে বিএনপিকেই। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েই বেগম খালেদা জিয়াকে নতুন করে শুরু করতে হবে। অন্যথায় আবারও হোঁচট খাবে বিএনপি। সেই হোঁচট আর সামাল দেওয়া যাবে না। কারণ রাজনৈতিক মরুর তীব্র দাবদহনে বিএনপি কর্মীরা আজ বিপর্যস্ত। কারণে-অকারণে ভারতের বিরোধিতা অথবা তোষামোদী করার বিষয়টিও তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। জবাব মিলছে না তিন মাস কী কারণে কর্মীদের ঝুঁকির মুখে রাখা হলো। ফেলা হলো মামলা-হামলা আর ক্রসফায়ারে। কষ্টের উত্তাপে জ্বলছে সন্তান ও স্বামীহারা পরিবারগুলো। রাজনীতি করতে হলে দেশের প্রতি, দলের প্রতি ভালোবাসা থাকতে হয়। দায়িত্বশীলতাও বড় বিষয়। অসময়ে-অকারণে জেনে-শুনে নেতা-কর্মীদের ক্ষতিগ্রস্ত করা রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতা নয়। এতে লাভ হয় না। ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশ, দল, নেতা-কর্মী সবাই। শুধু বাস্তবতায় থেকে বিচক্ষণ সিদ্ধান্তই পারে একটি দলকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখতে অথবা ক্ষমতায় নিতে।
আমাদের সমস্যা আছে, থাকবে। প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী না করলে, আইনের শাসন না থাকলে কোনো কিছুই কাজে লাগবে না। রাজনীতিবিদদের উচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে মনোনিবেশ করা। কারণ অনেক সম্ভাবনার এই দেশটিকে আমরা উন্নত সমৃদ্ধ দেখতে চাই। জাতি হিসেবে স্বপ্ন দেখতে হবে। জাগাতে হবে। স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে হবে। গৃহযুদ্ধ চলাকালে ক্রিকেট বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। এখন অর্থনৈতিক উন্নতিতে রেকর্ড পরিমাণ ভালো করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আমাদের মাঝে অনেক হতাশা ছিল। নিরাশা ছিল। বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে এমনও অনেকে বলেছিলেন। কিন্তু অনেক দেশের মতো আমাদের অর্থনীতি সরকারনির্ভর নয়। আমাদের গ্রামের একজন সাধারণ চাষি যার পাঁচ গণ্ডা জমি আছে সেও স্বাবলম্বী। এই চাষি তার ছোট্ট ঘরের পাশে শাকসবজি-মুরগি উৎপাদন করছে। আছে একটি গাভী। বাড়ির সামনে একটি টঙঘরে সেই গাভীর দুধে চা বিক্রি করছে। চাষি যখন তার অন্য কাজে যায় তখন তার সাত বছরের ছেলে বা মেয়েটি দোকানে বসে। আর বাড়ির সব কাজ সামাল দিচ্ছে তার স্ত্রী। মাঝে মাঝে সেও এসে দোকান কিংবা অন্য কাজের খবর নেয়। এভাবেই আমাদের অর্থনীতি চলে। সাধারণ মানুষ জিডিপিতে ভূমিকা রাখছে। এই অর্থনীতি শেষ হয়ে যাবে এমন হতাশার কারণ নেই। বাংলাদেশ এগিয়ে চলছে। এগিয়ে যাবে।
সাবেক ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরী একবার আমাকে বলেছিলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি ঠিক থাকলে এই দেশটিকে পেছনে নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। অনেক দূর যাবে। সম্ভাবনা সব খাতে। পেশাদার এই কূটনীতিক ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন আবেগাপ্লুত দরদি মানুষ। ঢাকায় হাইকমিশনার থাকাকালে এক সন্ধ্যায় লন্ডনের সানু মিয়ার সঙ্গে তার বাড়িতে গিয়েছিলাম। ছিলেন বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমও। গান করলেন বাউল সম্রাট। এই পেশাদার কূটনীতিকের হৃদয়ের ভিতরে ছিল আরেক বাউল। তিনিও গান ধরলেন। বসে থাকলেন না সানু মিয়া। পরে একদিন বেইলী রোডে গিয়ে এই তিনজন গানের সিডিও রেকর্ড করলেন। বাংলাদেশের শেকড়ের টান ছাড়তে পারেননি এই ব্রিটিশ কূটনীতিক। তাই ব্যস্ততার মাঝেও শাহ করিমের খোঁজ নিতেন। শেকড়ের টানটাই হলো মূল। এই ভালোবাসাটুকু থাকলে বাংলাদেশ অনেক দূর যাবে। রাজনীতিবিদরা দেশকে অবশ্যই ভালোবাসেন। কিন্তু নিজেরা নিজেদের শ্রদ্ধা করেন না। পরমতের প্রতি তাদের শ্রদ্ধা-সম্মান নেই। আমার ভালো লাগত যদি দেখতাম বিএনপি টিউলিপ সিদ্দিককে অভিনন্দন জানাচ্ছে। কিন্তু রাজনীতির নিষ্ঠুরতা এমনই অন্যকে প্রশংসা করা যায় না। আমরা এই রাজনীতি দেখতে চাই না। শাহ করিমের 'আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম' গানের মতোই এক ইতিবাচক রাজনীতি চাই। সুন্দর-সুষুম আগামীর জন্য।
পাদটীকা : পাত্রপাত্রী দেখা নিয়ে বাংলাদেশে অনেক গল্প চালু আছে। পাত্রী পক্ষের পাত্র দেখে পছন্দ হলো। কিন্তু এর মধ্যে পাত্রীর এক মামা আছেন দুষ্ট। তিনি শেষমেশ জানতে চাইলেন, পাত্রের স্বভাব-চরিত্র কেমন। লেখাপড়া ভালো। চাকরিও অনেক বড়। কোনো বিষয়ে সমস্যা নেই। ঘটক বললেন, কোনো সমস্যা নেই। এমন পাত্র লাখে একটা। তবে মাঝে মাঝে একটু শুঁড়িখানায় যান। হালকা-পাতলা পিয়াজ খাওয়ার অভ্যাস আছে। আর কোনো সমস্যা নেই। তেমনই পাত্রী দেখা নিয়েও এক গল্প আছে। পাত্রী পছন্দ হয়ে গেল পাত্র পক্ষের। ভীষণ সংসারী। পড়াশোনা, জাত বংশ সব ভালো। কিন্তু সমস্যা একটাই একটু দেরি করে বাড়ি ফেরে। কারণ মাঝে মাঝে নাইট ক্লাবে যায়। ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে একটু গল্পগুজব বেশি করে। ফেসবুকে সবার সঙ্গে প্রেম-ট্রেম নিয়ে গল্প করে। কোনো যুবক কিছু বলার আগেই নিজেই বলে, আমি কিন্তু প্রেমে পড়ি।
লেখক : সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন