বাংলা বর্ষবরণের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারী লাঞ্ছনায় জড়িতদের গ্রেফতারের দাবি জানাতে গিয়ে ১০ মে পুলিশের হাতে উল্টো ছাত্রীরা লাঞ্ছিতসহ আন্দোলনকারীরা নির্যাতনের শিকার হয়। এ ঘটনায় নারীনেত্রী, শিক্ষক, আইনজীবীসহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন- এ লেখায় আমি সেগুলো বোঝার ও ব্যাখ্যার চেষ্টা করছি। কেউ কেউ বলছেন, পুলিশের লোকজন মাঝে মাঝে অতি উৎসাহী হয়ে যে অতিরিক্ত কিছু করে ফেলে এটা তার বড় প্রমাণ। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা খুবই যৌক্তিক দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছিল। পুলিশের কাজ পুলিশকে করতে হবে। কিন্তু এভাবে নয়। বলা হচ্ছে, ছাত্র ইউনিয়নের আন্দোলনের জন্য যানজটের সৃৃষ্টি হয়েছিল। নানা কারণেই রাস্তায় ব্যাপক যানজটের সৃষ্টি হয়। এ জন্য ছাত্রীদের ওপর এ ধরনের হামলা ভয়াবহ। অবিশ্বাস্য। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ছাত্র ইউনিয়নের এক ছাত্রীকর্মী গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছেন, আক্রান্ত হওয়ার পর রাস্তা থেকে সব ছাত্রছাত্রী ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছেন, রাস্তা পরিষ্কারও হয়ে গেছে। তারপরও পুলিশ ওই ছাত্রীকে টেনেহিঁচড়ে সামনে এনে পেটাচ্ছে। এই চিত্র এক ধরনের পশুশক্তিকেই তুলে ধরে, মনুষ্যত্বকে নয় কখনই।
নারীনেত্রীরা বলতে চেয়েছেন, নারীর অবস্থা দেখে বিচার করা যায় সমাজ কতটা গণতান্ত্রিক। যে সমাজে মানুষ হিসেবে নারীর মর্যাদা নেই, সে সমাজ, সে রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হতে পারে না। বহু বছরের চেষ্টায় বাংলাদেশের নারীরা ক্ষমতায়নের পথে অনেকদূর অবধি এগিয়েছেন। মুখে গণতন্ত্রের ফেনা তুলছে যে সরকার তারা ঘরে-বাইরে-কর্মস্থলে-শিক্ষাঙ্গনে নারীর নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। উপরন্তু নিজেদের বাহিনী দিয়ে নারীদের ওপর আক্রমণ করিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে, সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়েছে নারীর কারণেই। কিন্তু এসব ঘটনা আমাদের এত বছরের সুনাম নষ্ট করে দেয়। পুলিশ এই সাহস কোথা থেকে পাচ্ছে? এখনই যদি তাদের বিচার করা না যায়, তাহলে এটা চলতেই থাকবে। পয়লা বৈশাখে নারীরা হামলার শিকার হয়েছেন। যারা অন্যায় করেছিল পুলিশ তাদের এখনো ধরতে পারেনি। বাংলাদেশে মন্ত্রিপরিষদে নারী আছেন, নারী সংসদ সদস্যও আছেন। শুধু বললেই হবে না নারীরা বড় বড় অবস্থানে আছেন। তাদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। পয়লা বৈশাখের ঘটনায় পুলিশ প্রথম থেকেই সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করে আসছে। তাদের বক্তব্য 'কেউ তো অভিযোগ করতে এগিয়ে আসেনি', 'আমরা সাক্ষী পাব কোথা থেকে' ইত্যাদি। কিন্তু এ কথা নিশ্চয়ই সবাই স্বীকার করবেন যে, ছবিগুলো মিথ্যা নয়। আর এসব ক্ষেত্রে সেই হামলার শিকার মেয়েটি যদি সাহস করে আজ অভিযোগ করতে এগিয়ে না আসেন, তাহলেও আমরা সেটাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করতে পারি না। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন ঘটনায় নারীর প্রতি পুলিশ অত্যন্ত উগ্র ও অসংযত আচরণ করেছে। তা রীতিমতো বাড়াবাড়ি। এ ধরনের ঘটনা নারীর গতিশীলতাকে থামিয়ে দেওয়া ও দেশের উন্নয়নের গতিকে ব্যাহত করার অপপ্রয়াস। পুলিশের একাংশের পৈশাচিক তাণ্ডব ও জেন্ডার অসংবেদনশীল আচরণ মর্মাহত করে।
পয়লা বৈশাখে যখন দুর্বৃত্তরা নারীদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছিল, তখন সেখানে পুলিশ এগিয়ে আসেনি। বিচারপ্রার্থীদের লাঠিপেটা করতে পুলিশের উৎসাহের কমতি নেই। অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ খুব যৌক্তিভাবেই বলার চেষ্টা করেছেন যে, আসলে মনুষত্ববিরোধী লজ্জাকর ওই ঘটনাকে আস্তে আস্তে ভুলিয়ে দেওয়ার, সহনীয় করার বা চাপা দেওয়ার চেষ্টা থেকেই পুলিশ এমন আচরণ করছে। এমনকি বিশেষ একটি প্রতিক্রিয়াশীল মহল এ রকম কথাও বলতে থাকে, পয়লা বৈশাখে 'ইসলামী পোশাক' বর্জিত এই নারীদের ওপর হামলার জন্য তারা নিজেরাই দায়ী। আবার আরেকটি মহল মনে করে, 'ছাত্রলীগের কর্মীরাই' এসব ঘটনা ঘটিয়েছে বলে পুলিশ এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিষ্ক্রিয় থেকেছে। সরকারকে তাই অনতিবিলম্বে প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করতে হবে, শাস্তি দিতে হবে। সীমা ছাড়াচ্ছে পুলিশ। পুরুষ পুলিশ সদস্যদের দ্বারা প্রতিবাদী ছাত্রীদের লাঞ্ছনা ও প্রহার অসভ্যতারই নামান্তর। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ করি। একই ঘটনায় ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা দুভাবে প্রহৃত হলেন : একবার টিএসসিতে নারীদের বাঁচাতে গিয়ে, আরেকবার নারী লাঞ্ছনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে। প্রথম ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা এখনো 'অজ্ঞাত' রইলেও দ্বিতীয় ঘটনায় অভিযুক্ত স্বয়ং পুলিশ! কতিপয় পুলিশ সদস্য যেভাবে ছাত্র ইউনিয়নের এক প্রতিবাদী ছাত্রীর শরীরে বুটের লাথি ও লাঠি চালনা করেছেন, তা ভয়াবহ। অধ্যাপক আকাশের পর্যবেক্ষণ : গণমাধ্যমে প্রচারিত ছবি ও সংবাদ থেকে স্পষ্ট যে, পুলিশ শান্তিপূর্ণ মিছিলের পেছন থেকে সাঁজোয়া যান ও ট্রাক চালিয়ে দিলে শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হন। এর পরই পুলিশ ছাত্রছাত্রীদের ওপর নির্বিচার হামলা চালায়। একজন নারীকর্মী গাছের আড়ালে আশ্রয় নিয়েও পুলিশের নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি। বর্ষবরণে নারী লাঞ্ছনাকারীদের প্রতিহত করা কিংবা ঘটনার ২৭ দিন পরও একজন অভিযুক্তকেও আটকে ব্যর্থ যে পুলিশ, তারাই প্রতিবাদীদের ওপর ষোল আনা 'বীরত্ব' দেখাতে দ্বিধা করেনি।
রাজনৈতিক শিখণ্ডী হিসেবে পুলিশকে ধারাবাহিক ব্যবহার করার ফলে একদল পুলিশ নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে ভাবতে শুরু করেছেন- এ প্রশ্ন তুলেছেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। এটি আইনের শাসন ও গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য অশনি সংকেত। এ আচরণ সাংবিধানিক সুরক্ষাগুলোর সরাসরি লঙ্ঘন ও সভ্য সমাজে অনভিপ্রেত। পুলিশের কার্যক্রম সুষ্ঠু ও নিয়মতান্ত্রিকভাবে চলছে না। একাত্তরের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা থেকে দূরে সরতে সরতে এখন একটি কলঙ্কজনক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। পুলিশ নারীর নিরাপত্তা দেবে, আর সে নিজেই নিপীড়কের ভূমিকা নিচ্ছে। রক্ষকই এখানে ভক্ষক সাজছে।
আর কেবল আওয়ামী লীগ বা বিএনপি নয় সব আমলেই পুলিশের এই বাড়াবাড়ি লক্ষণীয়। নারীনেত্রীদের আরেকজনের পর্যবেক্ষণ : বিএনপির সময়ও পুলিশ অনেক নারীকর্মীকে পিটিয়ে শাড়ি-কাপড় পর্যন্ত খুলে ফেলেছে। যুব মহিলা লীগের কর্মীর পেটে একবার এমন লাথি মারে যে, তার পেটের বাচ্চা মরে যায়। সভ্যসমাজে কেউ কখনো কোনো নারীর গায়ে হাত তুলবে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। এটা অচিন্তনীয়। পুলিশের আচরণ আগের চেয়ে আরও নেতিবাচক হয়ে যাচ্ছে। অপরাধ দমনে নিয়োজিত পুলিশ বাহিনীর উচিত নিজস্ব কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করা। একদিকে আমরা 'ক্রসফায়ার' দেখছি, অন্যদিকে আবার অপরাধীকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার পর ছেড়ে দেওয়ার ঘটনাও দেখছি।
এসব ঘটনায় আমরা যারপরনাই উদ্বিগ্ন, ক্ষুব্ধ এবং বিচলিত। রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অজুহাতে এভাবে শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে মেয়েদের মারতে হবে? পুলিশের কি কোনো জবাবদিহি নেই? তারা কি কারও দ্বারা আদিষ্ট হয়ে কাজটি করেছে? নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে সরকারের আইন আছে, নীতি আছে। প্রশাসন বা সরকার কোনো ধরনের কর্ণপাত করছে না। সে ঘটনায় পুলিশ প্রশাসনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। পুলিশ আবার একই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে মনে করিয়ে দিতে চাইছে, চারপাশ থেকে এত প্রতিবাদ, অভিযোগ আসা তারা পছন্দ করছে না। কেউ কেউ মনে করছেন ভয় দেখানোর জন্যও তারা এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে। আশার দিক হচ্ছে, বিভিন্ন নারী সংগঠন, সংস্কৃতি কর্মীরা নারী লাঞ্ছনার বিষয়টি ভুলতে দেয়নি। ছাত্র ইউনিয়নের তরুণ বন্ধুরা সরকার ও প্রশাসনের নিশ্চুপ ভূমিকার প্রতিবাদ জানাতে মিছিল বের করেছেন রাজপথে। ডিএমপি কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়েছেন এবং ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি সেখানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন, 'এখানে যতসংখ্যক পুলিশ আমাদের বাধা দিচ্ছে, বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে তারা থাকলে নারী লাঞ্ছনার ঘটনা ঘটত না'।
প্রকাশ্য দিবালোকে এমন উন্মুক্তভাবে সহিংস আচরণ কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এমন অধিকার লঙ্ঘনকারী আচরণের দায় সরকার এড়াতে পারে না। আমরা মনে করি, সনাতনী পদ্ধতিতে তথাকথিত ক্লোজড করা বা লোক দেখানোর জন্য সাময়িক বরখাস্ত করা কোনো সমাধান নয়। জেনেছি, এ ঘটনায় পুলিশের নিম্নস্তরের কর্মী বরখাস্ত হয়েছে, তদন্তের জন্য দুটি কমিটিও হয়েছে। অল্প কয়েকজনের বিক্ষোভ ঠেকাতে গিয়ে পুলিশ যে বর্বরতা চালিয়েছে, তা নিয়ে পুলিশের মধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে। বলা হচ্ছে, 'আর কতকাল কর্মস্থলে সবচেয়ে শেষ ধাপের কর্মীর ওপর দায় চাপিয়ে বড় কর্তারা পার পেয়ে যাবেন? ওই অঞ্চলের দায়িত্বে কোন কর্মকর্তা ছিলেন? যারা যৌন হয়রানির প্রতিকার চাইতে গেলেন তারাই অপরাধী হয়ে গেলেন? যদি কোনো নারী ঢিল ছুড়েই থাকেন তাকে লাথি মারতে হবে? রাস্তায় ফেলে পেটাতে হবে? এটা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।' গণফোরামের নেতা ড. কামাল হোসেন তার উষ্মা আর ধরে দেখতে পারেননি; তিনি বলেছেন এরা 'বদ' পুলিশ।
কেন পুলিশ এরকম করে। এর কারণ, আমার প্রতীতি- এক. নিয়োগ ও পদোন্নতির সময় ঘুষ-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি করে চাকরি পাওয়া, দুই. অন্য সরকারি চাকরির মতো পুলিশ বাহিনীতে নির্লজ্জ দলীয়করণ হওয়া, তিন. পেশাদারি মনোভাবের অভাব, চার. বিশেষ জেলার পুলিশদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা-ক্ষমতা দেওয়া, পাঁচ. দায়িত্ব ও কাজের জবাবদিহিতা না থাকা, ছয়. আধুনিক পুলিশিংয়ের প্রশিক্ষণ না থাকা, সাত. ঔপনিবেশিক মানসকাঠামো থেকে জনগণকে শত্রু মনে করা, মানুষকে ভয় দেখিয়ে কাজ হাসিলের পুরনো বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে না পারা। এ থেকে বেরিয়ে আসতে যা করতে হবে : ক . ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় তদন্ত করতে হবে; খ. পাশাপাশি যে ঘটনার জন্য ওই বিক্ষোভ, সেই পয়লা বৈশাখের নারী লাঞ্ছনাকারীদের অবিলম্বে আটক করে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে; গ. দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির মাধ্যমে পুলিশ বাহিনীতে শৃঙ্খলা, পেশাদারিত্ব, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতা তৈরি করতে হবে; ঘ. পুুলিশের প্রশিক্ষণে জেন্ডার সংবেদনশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে; ঙ. পুলিশ বাহিনীতে আরও নারী সদস্য বাড়াতে হবে। সর্বোপরি রাষ্ট্র ও সমাজে গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।