অবশেষে পয়লা বৈশাখের নারী লাঞ্ছনার মতো কলঙ্কিত ঘটনার এক মাস পর পুলিশ দুর্বৃত্তদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করল। এতদিন পর পুলিশ জানিয়েছে, সিসিটিভি ভিডিও ফুটেজ থেকে আটজন দুষ্কৃতকারীকে শনাক্ত করা গেছে। কিন্তু এখনো তাদের পরিচয় জানা যায়নি।
এর আগে পুলিশ কেন নিষ্ক্রিয় ছিল, কেনই বা আসামিদের ধরতে উৎসাহ বোধ করেনি, সেই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে উঠে আসে। ঘটনাটি পুরনো। খবরের কাগজে বিস্তারিত বিবরণ উঠেছে। তবু পাঠককে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য পুনরায় উল্লেখ করা দরকার। গত পয়লা বৈশাখের উৎসবের মধ্যে একাধিক নারীকে লাঞ্ছিত করার যে ঘটনাটি ঘটেছিল তা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই ঘটেছিল। একদল দুর্বৃত্ত পথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া মেয়েদের লাঞ্ছিত করেছিল। রিকশা থেকে নামিয়েও নানাভাবে সম্মানহানি করেছিল। এমনকি প্রকাশ্যেই পুলিশের উপস্থিতিতে কাউকে কাউকে বিবস্ত্র করারও চেষ্টা করেছিল। এ রকম ঘটনা এক ঘণ্টার উপর চলেছিল। এটা দেখে সহ্য করতে পারেননি ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি লিটন নন্দী। তিনি আক্রান্ত নারীদের রক্ষা করতে গিয়ে নিজেও আহত হয়েছিলেন। দুবর্ৃৃত্তরা তার একটা হাত ভেঙে দিয়েছিল। তিনি এখনো চিকিৎসাধীন আছেন। নারী নির্যাতনকারীদের সঙ্গে লিটন নন্দী ও ছাত্র ইউনিয়নের অন্য কর্মীদের সংঘর্ষ চলে তাও প্রায় ঘণ্টা খানেক ধরে। এই পুরো সময়টাজুড়ে পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল। অথবা হয়তো তামাশা দেখছিল। পুলিশের এই মনোভাব বোঝা যায় পুলিশ প্রধান আইজিপির এক দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য থেকেও। নারীকে লাঞ্ছিত করার ঘটনাকে তিনি বলেছেন, 'কিছু ছেলেদের দুষ্টমি'।
পুলিশের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ, ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা একজন দুষ্কৃতকারীকে হাতেনাতে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করলে পুলিশ তাকে ছেড়েও দেয়। এদিকে পুলিশ সাফাই গাইছে এই বলে যে, একমাত্র লিটন নন্দী ছাড়া নাকি কোনো সাক্ষী পাওয়া যায়নি। এ কথা পরিষ্কার যে, পুলিশ পুরো ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে চেয়েছে বা এড়িয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু কেন? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ, দীর্ঘ সময় ধরে চলা এই ন্যক্কারজনক ঘটনা প্রক্টরকে জানানো হলে তিনিও নির্লিপ্ত ছিলেন। 'পুলিশকে ফোন করছি।' এই বলে তিনি আর কোনো উদ্যোগ নেননি। পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের এই রহস্যজনক ভূমিকার কারণ কি?
যে পুলিশের বর্বরতা ও হিংস্রতা আমরা বহুবার দেখেছি, তারা এত নির্লিপ্ত ছিল কেন? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষই বা কেন এত উদাসীন ছিল? পুলিশ প্রধানই বা কেন 'ছেলেদের দুষ্টমি' বলে হালকা করে দেখেছেন? তাহলে কি সেই 'ছেলেরা' আসলে সরকারের আশ্রয়প্রাপ্ত সেই 'আদরের ছেলেরা' যাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কাজে এবং নির্বাচনে ভোট কেন্দ্র দখল করার কাজে ব্যবহার করা হয়? সরকারি ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের জন্য তো সব ধরনের অপরাধ করার লাইসেন্স আছে। সেটা বিএনপি আমলেও ছিল। এই আমলেও আছে। কতবার খবরের কাগজে ছবি ছাপা হয়েছে, টেলিভিশনে ছবি দেখানো হয়েছে, ছাত্রলীগের চিহ্নিত নেতারা পুলিশের সামনেই পিস্তল ব্যবহার করছেন। পুলিশ না দেখার ভান করেছে। সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, পয়লা বৈশাখের ঘটনার সঙ্গে তারা জড়িত রয়েছে বলেই পুলিশ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ উভয়েই নির্বিকার ছিলেন।
পুলিশ কিন্তু অন্য সময় নিশ্চুপ বা নির্বিকার ছিল না। পয়লা বৈশাখ নারী নির্যাতনের সময় পুলিশ নীরব থাকলেও, ছাত্র ইউনিয়নের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের সময় তারা কিন্তু হিংস্র হয়ে উঠেছিল। পয়লা বৈশাখের ঘটনার বিচার চেয়েছিল ছাত্র ইউনিয়ন। পায়নি। তখন তারা বাধ্য হয়ে 'পাল্টা আঘাতে'র কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল। পাল্টা আঘাত কিন্তু সরকার বিরোধী ছিল না। আপাত দৃষ্টিতে তা কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিও ছিল না। নারীকে যারা লাঞ্ছিত করে (যা পুলিশ প্রধানের ভাষায় 'কিছু ছেলের দুষ্টমি') তাদের প্রতিহত করার কর্মসূচি। এরই নাম পাল্টা আঘাত। কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত ১০ মে তারা পুলিশ কর্মকর্তার অফিসের সামনে যেতে চেয়েছিলেন তাদের বিক্ষোভের কথা জানাতে। পুলিশ বাধা দিল। অজুহাত ছাত্র ইউনিয়নের মিছিল নাকি যানজট সৃষ্টি করেছে। বলাই বাহুল্য, ছাত্রলীগ রাস্তা বন্ধ করে সভা মিছিল করলে পুলিশ তাতে বাধা না দিয়ে বরং পাহারা দেয়। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচির ক্ষেত্রে পুলিশ তার স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হলো। বর্বর লাঠিপেটা করল। নারী কর্মীরাও আহত হলেন।
দুই নেত্রী ইসমত জাহান জো ও ফারহানা আখতার গুরুতরভাবে আহত হলেন। ফারহানা আখতারের পা ভেঙে দিয়েছে পুলিশ। ছবিতে দেখা গেছে, এক ছাত্রী গাছের পাশে আশ্রয় নিলেও পুলিশ পেছন থেকে তাকে বুট জুতা দিয়ে লাথি মারছে। নারীরা দুভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছেন, প্রথমবার দুর্বৃত্তের দ্বারা (পয়লা বৈশাখ), দ্বিতীয়বার পুলিশ কর্তৃক। দেখা যাচ্ছে পুলিশের দুর্বৃত্তায়ন ও নারীর প্রতি সহিংসতা কিন্তু কম ভয়াবহ নয়। ড. কামাল হোসেন তাই যথার্থই এই পুলিশকে 'বদ' বলে আখ্যায়িত করেছেন। হয়তো সর্বনিম্ন পর্যায়ের কোনো পুলিশকে কিছু শাস্তি দেওয়া হতে পারে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস যথার্থই আশঙ্কা করেছেন যে, পার পেয়ে যাবেন উপরের পুলিশ কর্মকর্তারা। যে অফিসার সেদিন ঘটনাস্থলে ডিউটিতে ছিলেন, যার সামনে নারীর গায়ে লাথি মারল পুলিশ, তার বিচার হবে কি? না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। নারী নির্যাতন ও পুলিশি নির্যাতনকে ধীরে ধীরে ভুলিয়ে দেওয়াই বোধহয় সরকারের কৌশল। দৈনিক কালের কণ্ঠের সম্পাদকীয়তে (১২ মে ২০১৫) যে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে তা অমূলক নয়। 'পুলিশ বরাবর ক্ষমতাসীনদের ঠ্যাঙ্গারে বাহিনী হিসাবেই ব্যবহৃত হয়েছে।... পত্রপত্রিকায় যাদের ছবি ছাপা হয়েছে, নিপীড়ক পুলিশ সদস্যদের হয়তো বেছে বেছে পুরস্কৃত করা হবে।'
এমন নজির নিকট অতীতেও ছিল। শেখ হাসিনার গত মেয়াদকালের একটি ঘটনা। বিএনপি আহূত এক হরতালের দিনে পুরান ঢাকায় কিছু স্থানীয় ছাত্রলীগ নেতা বিশ্বজিৎ নামে নিরীহ দোকান কর্মচারীকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল। তখনো সেখানে ডিউটিরত যে পুলিশ অফিসার দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছাত্রলীগ নেতাদের কীর্তি দেখছিলেন, কোনো বাধা দেননি, সেই পুলিশ অফিসারকেই পরে রাষ্ট্রীয় পদক দেওয়া হয়েছিল।
প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার জন্য পয়লা বৈশাখের ঘটনাটি অন্যভাবে চিত্রিত করার চেষ্টাও হয়েছে। প্রথমে মৌলবাদীদের দিকে অঙ্গুলি উত্তোলন করা হয়েছিল। এ কথা সত্য যে, ধর্মীয় মৌলবাদীরা হচ্ছে চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও নারীবিদ্বেষী। তারা বাঙালি সংস্কৃতির বিরোধীও বটে। পয়লা বৈশাখের আনন্দ উৎসবকে তারা ইসলাম বিরোধী বলে প্রচার করে। একই কারণে তারা কয়েক বছর আগে পয়লা বৈশাখে রমনা বটমূলে বোমা ফাটিয়ে মানুষ হত্যা করেছিল। এই মৌলবাদীরা বাঙালি নারীর স্বাভাবিক পোশাককেও ইসলাম সম্মত নয় বলে প্রচার করে। অতএব পয়লা বৈশাখের নারী নির্যাতনকারীরা মৌলবাদী হতে পারে, এমন সম্ভাবনা অমূলক নয়। তবে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, পুলিশ প্রধানের বক্তব্য, ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আচরণ থেকে মনে হয়, এই ক্ষেত্রে মৌলবাদীরা নয়, বরং সরকারের আশ্রিত 'কিছু আদরের দুষ্ট ছেলেরাই' এই ঘটনা ঘটিয়েছে।
নারীর প্রতি অপমানজনক আচরণ যে শুধু মৌলবাদীরা করেন, আর কেউ করে না, এমনটা নিশ্চয়ই বলা যায় না। এমনকি নারীবিদ্বেষী মনোভাব তথাকথিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের মধ্যেও পাওয়া যাবে। বাইরে প্রগতিশীল অথবা সংস্কৃতিবান অথবা জাতীয়তাবাদী, কিন্তু সংসার ও সমাজ জীবনে নারীকে পদে পদে অসম্মান করে, এমন উদাহরণ কম নেই। গত শতাব্দীতে নব্বইয়ের দশকে ইংরেজি নববর্ষের উৎসবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে 'বাঁধন' নামে এক তরুণী লাঞ্ছিত হয়েছিলেন। ওই ঘটনায় ফেনী থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারী বাঁধনকে দোষারোপ করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, সন্ধ্যার পর বাঁধন ওখানে গেছে কেন। বাঁধনকে অভিযুক্ত করে তিনি একটি নাটকও লিখেছিলেন। বাঁধন বলেছিলেন, 'আমি তো অন্য কোথাও যাইনি। গিয়েছিলাম সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে।' আমার উত্তর অবশ্য অন্যরকম। যেখানে পুরুষরা যেতে পারবে, সেখানে রাত হোক বা দিন হোক, নারী কেন পারবে না। নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে প্রশাসনকে।
জয়নাল হাজারীর মতো নারীবিদ্বেষী আওয়ামী লীগ বিএনপি উভয় দলেই অনেক আছেন। সেই সময়কার আরেকটি ঘটনা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের এক নেতা (মানিক তার নাম) শততম ধর্ষণ উদযাপন করেছিল। এ জন্য কোনো শান্তি পেতে হয়নি। বিএনপির শাসনামলেও ছাত্রদলের 'হিরোদের' মাস্তানির অনেক ঘটনা আছে।
দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলের প্রধান নেত্রী, সংসদের বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার নারী। কিন্তু এর দ্বারা সমাজের চিত্র বোঝা যাবে না। রাষ্ট্র ও প্রশাসন হাড়ে হাড়ে নারীবিদ্বেষী। পুরুষতান্ত্রিকতা আমাদের মজ্জায় মজ্জায় মিশে আছে। তার সঙ্গে যদি সরকারের প্রশ্রয় যুক্ত হয়, তাহলে তো সেটা হবে আরও ভয়ঙ্কর। ঠিক তা-ই হয়েছে।
তবে আনন্দের খবর এই যে, এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে উঠছে। ছাত্র ইউনিয়ন সর্বত্র 'প্রীতিলতা ব্রিগেড' গঠন করতে চলেছে। বীর নারী প্রীতিলতার মতোই সাহস নিয়ে এগিয়ে আসুক নতুন প্রজন্মের তরুণ-তরুণী। মেয়েরা ধরবে সংগ্রামের পতাকা 'পাল্টা আঘাত হানার' জন্য। ছেলেরাও থাকবে একই সঙ্গে একই মঞ্চে। জন্ম দেবে নতুন প্রগতিশীল সংস্কৃতি ও মানসিকতার। প্রতিরোধের সংগ্রামে এই সাহসী তরুণ-তরুণীদের স্বাগত জানাই।
""লেখক : রাজনীতিক।