২৪ মার্চের আগেই আমার শুভাকাঙ্ক্ষীরা অর্থাৎ ছাত্র, বন্ধু-বান্ধব, অভিভাবক শ্রেণির লোকজন, সিনিয়র এবং জুনিয়র অনেকেই আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করতে লাগলেন, ২৪ মার্চের পরে আমি কী করব? উপাচার্য হিসেবে এটা আমার ছয় বছরের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ দিন। ২৪ মার্চ দিনটা আমার খুব ব্যস্ততার মধ্যেই কেটেছে। এমনকি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিতে যোগদানও এ কর্মসূচির মধ্যে ছিল। সেখানে যাওয়ার আগে অসংখ্য কাগজপত্র দেখতে হয়েছিল। সংসদীয় কমিটি থেকে ফিরে আমি আর বিশ্ববিদ্যালয়ে যাইনি তবে বিকালেই দায়িত্ব ভার হস্তান্তর করে দিই। যারা আমাকে জিজ্ঞাসা করেছে- এখন আমি কি করব? আমি কি তা চিন্তা করেছি? আমি কি আমার নাক-কান-গলা বিভাগে ফিরে যাব? নাকি সক্রিয় জীবন থেকে অবসর নেব? আমাকে যারা অন্তরঙ্গ ভাবে চেনে এবং জানে, তারাই বলেছে তুমি বসে থাকার লোক না। তোমার কাজ আরও বেড়ে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে (১৯৯৬ থেকে ৯৮ দুই বছর বাদ দিয়ে) ১৯৮৯ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ২৪টি বছর কেটেছে। উপাচার্য হিসেবে ৬টি বছর আমার অনেক কাজের মধ্যে কেটেছে।
আমি আগেই বলেছি, আমি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে ভালোবাসি। কাপুরুষ চ্যালেঞ্জ নিতে ভয় করে। 'সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, তারুণ্যে উজ্জীবিত কিংবা সাধনায় মগ্ন থেকে এ সময় আমার পার করতে হয়েছে। নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ছাড়া, যখনই যে আসতেন আমার অফিস রুমে তাদের সবার পেছনে একটা স্বার্থ ছিল। যে কোনো কাজের আগে তারা ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, নিজেদের দুর্বলতা স্বীকার করতে কার্পণ্যতা করতেন না। কাজটি শেষ হলে তারা অসুরের ভাব ধারণ করতেন।
সুস্থ-ছাত্ররাজনীতি নেতৃত্ব সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন। ছাত্ররাজনীতি আজ কলঙ্কিত হয়ে গেছে। ১৯৭৫-এর পরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না, তাই নতুন নেতৃত্বও সৃষ্টি হচ্ছে না। ফলাফল সংসদে ব্যবসায়ীদের আধিক্য। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ছাত্ররাজনীতি কলুষিত করার সব চেষ্টা করা হয়। এ জন্য ছাত্ররা দায়ী নয়। সুবিধাভোগী অগণতান্ত্রিক সরকার সম্পূর্ণভাবে দায়ী। ফরিদপুর ও বরিশাল মেডিকেল কলেজ ছাড়া সব কয়টি মেডিকেল কলেজে উপাচার্য হিসেবে আমি গিয়েছি, ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলেছি। ছাত্রদের সঙ্গে ক্লাস নিয়েছি। এতে করে আমি এক অনন্য অভিজ্ঞতার আস্বাদ নিয়েছি। সবার সঙ্গে মেলামেশা করে তাদের চাওয়া-পাওয়া, আকাঙ্ক্ষা আমি হৃদয়ঙ্গম করেছি। বুঝেছি দেশে কত ভালো কাজ হয়েছে। মনে হচ্ছিল আমি তারুণ্যের অপরিসীম শক্তি উপভোগ করেছি। অনেকগুলো বেসরকারি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়েও আমি গিয়েছি। কোনো কোনো সরকারি মেডিকেল কলেজে একাধিকবার গিয়েছি। এ এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা। যেখানেই গিয়েছি, সেখানেই ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে, রোগী, চিকিৎসক এবং হাসপাতাল যে যথাক্রমে দেবতা পূজারী আর মন্দির সেটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। ডাক্তারদের মানবতাবোধ হওয়া উচিত প্রথম গুণ, সেটা বুঝানোর চেষ্টা করেছি। আমি তাদের উদ্দেশ্যে বলেছি, ডাক্তার হিসেবে আমি-আপনি একটা পরিবারের সদস্য। আসুন আমরা সবাই মিলে এ দেশের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্য সেবার উন্নতি করি এবং রোগীর প্রতি দুর্ব্যবহার থেকে বিরত থাকি এবং নিজেদের পেশার মান বাড়াই।
প্রশ্নটি ছিল আমি এখন কি করব? মাত্র দুই মাস পার হলো ছুটিতে আছি। এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে সমসাময়িক বিষয়ের উপর বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছি। সচরাচর যা করতাম ভোর ৫টায় উঠে প্রাইভেট অপারেশনগুলো করা-ঠিক তাই করছি এবং আগের মতো ৮টার মধ্যে শেষ করছি। কখনো আমি যেমন অফিসে যাইনি ৮টার পরে। এখনো আমাকে ৮টার মধ্যেই শেষ করতে হয়, কেননা আমার অ্যানেস থেসিউলজিস্ট অধ্যাপক খলিল ভাইকে ৮টার মধ্যে তার কর্মস্থল হার্ট ফাউন্ডেশনে পেঁৗছতে হয়। উনি আমার চেয়েও বেশি নিয়মানুবর্তী।
বর্তমানে বিশেষ করে PATC তে Foundation course, ACAD course যেখানে উপসচিবদের প্রাধান্য, SSC (সিনিয়ার স্টাফ কোর্স) যেখানে যুগ্ম সচিবরা অংশগ্রহণ করে থাকেন, তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখতে পারি। আসলে 'সবার কথা শুনুন। সবার কাছ থেকে শিখার চেষ্টা করুন, সবাই সব জানে না এবং সবাই কিছু না কিছু আপনাকে দেওয়ার মতো জানে।' এটাই চরম সত্য। ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজের অংশগ্রহণকারীরা অত্যন্ত জ্ঞান সমৃদ্ধ। সেখানে ২০-২৫টি দেশের কর্নেল এবং ব্রিগেডিয়াররা অংশগ্রহণ করেন। সরকারের সিনিয়র যুগ্ম সচিবরাও থাকেন। তাদের সামনে কথা বলা এবং তাদের প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া বিশাল এক সৎ সাহসের শক্তি জোগায়। এছাড়াও ডাক্তারদের বুনিয়াদী প্রশিক্ষণে বিয়াম নীলক্ষেত, আইসিএমএইচ এবং বগুড়া একাডেমিতেও ক্লাস নিতে যাই। এতে অপার আনন্দ ভোগ করি। আয়কর বিভাগের প্রবেশনারী অফিসারদের সঙ্গে কথা বলি। জাতীয় গণমাধ্যম ইনস্টিটিউটে মাঝে মাঝে ক্লাস নেওয়ার সৌভাগ্যও হয়।
আমি ছাত্ররাজনীতি করেছি। ছাত্ররাজনীতিতে তখন সততা শিক্ষা দিত। আদব-কায়দা চর্চার একটি ভালো জায়গা ছিল। কেননা ৫ম বর্ষের কোন ছাত্র, দলের সভাপতি হলেও ১ম বর্ষ পর্যন্ত প্রত্যেক বর্ষের ছেলেরা কোনো না কোনো পদে থাকতেন। তাতে করে সিনিয়রের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো এবং জুনিয়রের প্রতি স্নেহ বৎসল হওয়ার সুযোগ থাকত। আমার কাছে এখনো অবাক লাগে ভাবতে যে, ২য় বর্ষের ছাত্র হয়ে ছাত্র সংসদের পরিচিতি সভায় অর্থাৎ ছাত্রলীগ মনোনীত মাহবুব-মিজান পরিষদের পক্ষে আমাকে বক্তব্য দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছিল, যেখানে অন্য সব দলের ভাইয়ারা ছিলেন ৪র্থ বা ৫ম বর্ষের ছাত্র।
এটা আমার সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত মতামত, 'ছাত্ররাজনীতি এবং বছর বছর ছাত্র সংসদ নির্বাচন চলমান থাকুক।' গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় এর বিকল্প নেই। একই সঙ্গে পেশাজীবী রাজনীতির আমি ঘোর বিরোধী। কেন? আমার পূর্বসূরি অর্থাৎ অধ্যাপক এমএ হাদী স্যারের যে প্রশাসন ছিল এবং যেহেতু সবাই রাজনীতির সুবাদে প্রশাসনে এসেছিলেন, তাই তাদের ড্যাব এবং ছাত্রদলের রাজনীতির কাছে নতজানু হয়ে প্রশাসন চালাতে হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে বিজ্ঞপ্তি ছাড়া, বিজ্ঞপ্তিসহ নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা না করে ৮২১ জন ডাক্তার মেডিকেল অফিসার নিয়োগ দিতে হয়েছিল। সহকারী, সহযোগী এবং অধ্যাপকদের কথা, আমি আলোচনায় না-ই-বা আনলাম।
আমি যখন দায়িত্বে ছিলাম, তখন আমার দল স্বাচিপ থেকে একটা দাবি উঠল ড্যাব ৮২১ জন ডাক্তার অর্থাৎ নেতা নিয়োগ দিয়েছে। আমাদেরও সমান সংখ্যক দিতে হবে নতুবা Power Balance
হবে না। আমি যতই বুঝাতে চাইলাম, ড্যাব-এর আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত আমাদের কিছু নেতা আছেন যারা খোলস বদল করেছেন এবং কিছু কিছু নেতার স্ত্রীও আছেন। এভাবে ডাক্তার নিয়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়টা ধ্বংস করতে পারব না। নেতাদের দাবি ৫ বছর পর পুনরায় বিএনপি ক্ষমতায় আসবে। আপনারা চলে যাবেন। আমাদের থাকতে হবে। ৩১ মার্চ ২০০৯ থেকেই আমি বলতে শুরু করলাম, '২০১৪ সালের নির্বাচনে আবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে'। সুতরাং ভয়ের কিছু নেই। আর ড্যাবের অনেকেই এর মধ্যে খোলস বদল করে আওয়ামী লীগ হয়ে যাবেন। আমার দলের কাউকে আমি এ কথা বিশ্বাস করাতে পারিনি। তবে এখন সবাই বলেন, 'আপনি সব সময়ই বলেছেন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসবে' মজার ব্যাপার হলো ২০১৩-এর শেষের দিকে যখন বিএনপি ধ্বংসাত্দক কাজ কর্ম চালাচ্ছিল নির্বাচন বানচালের জন্য, তখন আমাদের দলের অনেকেই ছাত্রাবাস ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথার অবতারণা করছি। অধ্যাপক তাহির স্যার তখন উপাচার্য ২০০৬ সালের গোড়ার খবর। উনি এখনো সুস্বাস্থ্য নিয়ে বেঁচে আছেন। বিএনপি সরকারের মেয়াদ শেষ আওয়ামী লীগের নির্বাচন প্রস্তুতি। তাহির স্যার অনেকের সামনে জিজ্ঞাসা করলেন, উপাচার্যের চেয়ারে বসা অবস্থায়, এই 'মালাউন' তুই বলত কে জিতবে। এর আগে চিকিৎসকরা কেউ বিএনপিকে ২০০, আওয়ামী লীগকে ১০০, কেউ উভয়কে ১৫০-+ অর্থাৎ যার যা খুশি আসন দিয়ে যাচ্ছেন। আমি চুপ, তারপরেও বললেন, এই তুই বল। 'মালাউন' শব্দের অর্থ আমি উনার কাছ থেকেই শিখেছি। যার অর্থ হলো অভিশপ্ত। অবশ্যই অনস্বীকার্য উনি আমাকে স্নেহ করতেন। অনেক পীড়াপীড়ির পর বললাম 'নির্বাচন হবে এটা আপনাদের কে বলল?' সবাই থ বনে রইলেন এবং একটু হাসলেন। কথা কিন্তু আমারটাই সত্যি হলো। আমি জ্যোতিষী নই এবং এতে আমার বিশ্বাসও নেই। আসলে রাজনীতির অনেক বিভাজন আছে। বড় Political Situation, বিশ্বরাজনীতির বিশ্লেষণ করেই আমি তা বলেছি। কারণ অতীতে দেখেছি ৭৫-এর পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগকে কিভাবে ত্রিধাবিভক্ত করে রাখা হয়েছিল। আবার কিভাবে, এক করা হলো ইত্যাদি।
যাই হোক পরিশেষে আমিও স্বল্প সংখ্যক মেডিকেল অফিসার নিয়োগ দিয়েছি। চাহিদার ওপর ভিত্তি করে, যার প্রথমটাই হলো : অ্যানেস থেসিয়া বিভাগে। প্রথম শর্তই হলো বিভাগ বদল করা যাবে না। কারণ হাদী স্যার যাদের ওই বিভাগে চাকরি দিয়েছিলেন তারা পরে সবাই বিভাগ পরিবর্তন করে চলে যায়। সার্জারি বন্ধ হওয়ার উপক্রম। প্রায়ই তরুণ অধ্যাপক সমৃদ্ধ এই বিভাগের সঙ্গে, বিভিন্ন সার্জারি বিভাগগুলোর ঝগড়াঝাটি হতো। বলেছিলাম আমি পেশাজীবী রাজনীতির বিরোধী, কারণ আমি দেখেছি ডাক্তারদের সংগঠন বিএমএ পেশাজীবী সংগঠন হিসেবে, ড্যাব-স্বাচিপের চেয়ে অনেক সম্মানজনক স্থান দখল করেছিল অতীতে। পাঠক এখনো বলা হলো না এবং দেওয়া হলো না আমি কি করি, এসবের ফিরিস্তি। শুধু এটুকুই বলি, শিক্ষকতার পরিধি বেড়েছে, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণার কাজ শুরু করেছি, বিভিন্ন হাসপাতাল বা জায়গায় বিনামূল্যে রোগী দেখার পরিধি বাড়ছে, সব মিলে ব্যস্ততা অনেক বেড়েছে। যদিও ২০১৮ সাল পর্যন্ত আমার চাকরি আছে, তারপরও নিজ বিভাগে ফিরে যাব না, কারণ আমার প্রিয় ছাত্র অধ্যাপক কামরুল হাসান তরফদার কিছুটা সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হবেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি চাই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং উনার সরকার যদি আমাকে কোনো দায়িত্ব দেন, তা সততা, নিষ্ঠা এবং পরিশ্রমের সঙ্গে সম্পন্ন করার জন্য জীবনের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করব। সেটা যে কোনো কাজই হোক না কেন। আমার নিত্য শুভার্থীরা, আপনাদের সবাইর কাছে দোয়া চাই, যেন মানুষের সেবা দেওয়ার জন্য বেঁচে থাকতে পারি। ডা. বিধান রায় হওয়ার মতো সাহস বা ধৃষ্টতা নেই, তবে পুরান ঢাকার ডা. নন্দীর মতো একজন সেবক চিকিৎসক হতে পারলেই কৃতজ্ঞ থাকব স্রষ্টার কাছে।
লেখক : সাবেক উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।