আমার মতো অনেকের জীবনেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক মাতৃসম প্রতিষ্ঠান। আমাদের প্রিয় alma mater। যেমনি প্রিয় তেমনি শ্রদ্ধেয়। মাতৃস্নেহের পরশমণি সন্তানকে যেমন আদর-যত্নের সজীব স্পর্শে পরিণত ব্যক্তিতে রূপান্তরিত করে, আত্মপ্রত্যয়ে সুদৃঢ় করে মর্যাদাসিক্ত করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের জীবনে তেমনি এক পরশমণি। আমার প্রয়াত মা এখনো যেমন আমার চারপাশ ঘিরে বর্তমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও তেমনি আমার এবং আমার মতো হাজারো মনের সচেতনতাকে ঘিরে প্রতি মুহূর্তে বিদ্যমান। এই প্রিয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি আজ (১ জুলাই) ৯৪ বছর পূর্ণ করবে। ২০২১ সালের ১ জুলাইয়ে ১০০ বছরে পা দেবে। সেই স্মরণীয় মুহূর্তকে মনে রেখে এই ছোট্ট লেখাটি।
১৯২১ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু করে তার জয়যাত্রা। মাত্র তিনটি অনুষদে কলা, বিজ্ঞান এবং আইন- মাত্র ১২টি বিভাগে ৮৭৭ জন ছাত্রছাত্রী ও ৮৪ জন শিক্ষক নিয়ে। একটি বিভাগীয় শহরে প্রতিষ্ঠিত এ মহতী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান তখন প্রভাব এবং অবয়বে ছিল ছোট্ট একটি চারাগাছ। দীর্ঘ ৯৪ বছরে হাজারো চড়াই-উৎরাই অতিক্রম করে, অনেক অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়ে এখন পরিণত হয়েছে এক বিরাট মহীরুহে। পরিণত হয়েছে একটি জাতি-রাষ্ট্রের জাতীয় প্রতিষ্ঠানে, সমগ্র জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় অর্জনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পর্শ। জাতীয় পর্যায়ে কল্যাণমুখী প্রতিটি উদ্যোগের উৎসও এই মহতী প্রতিষ্ঠানটি। এর কুশলী পরিচর্যায় এবং সস্নেহ স্পর্শে বেড়ে উঠেছেন এ দেশের অধিকাংশ রাজনীতিক, প্রশাসক, সংস্কৃতিসেবী, ব্যবহারবিদ এবং বিভিন্ন পেশার শীর্ষস্থানীয়দের অধিকাংশই। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষ গবেষকদের গবেষণায় সক্ষম হয়েছে জ্ঞানভাণ্ডারে অসংখ্য মণিমাণিক্য সংযোজনে। সফল হয়েছে জ্ঞানভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯২৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত প্রথম সমাবর্তনে বাংলার গভর্নর এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর লর্ড লিটন বলেছিলেন, 'জনসমক্ষে আমি এই ঘোষণা দিয়েছি, আমার মতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলো ঢাকার সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ এবং অন্যসব কিছুর ঊর্ধ্বে এই বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার খ্যাতি বৃদ্ধি করবে এবং তা বাংলা, এমনকি ভারতের সীমারেখা ছাড়িয়ে যাবে।' [‘I have already stated in public that in my opinion this University is Dacca’s greatest possession, and will do more than anything else to increase and spread the fame of Dacca beyond the limits of Bengal or even India itself’] তার ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতিচর্চা এবং গবেষণা ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদানের স্বীকৃতি ঢাকা ছাড়িয়ে বাংলা কেন, ভারতের বিস্তৃত পরিধি ছাড়িয়ে বিশ্বময় বিস্তৃত হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম : অন্যান্য স্বাধীন জনপদে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির মান উন্নয়নকল্পে বিশ্ববিদ্যালয় যেমন স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্ম কিন্তু সেভাবে হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর পি জে হার্টগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের প্রথম সভায় (১৯২১ সালের ১৭ আগস্ট) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'রাজনৈতিক জন্মের কথা' (‘Political origin’) সবাইকে স্মরণ করিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে পরিচালিত হবে তার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। লর্ড লিটনও সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, এ বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বরে দিলি্ল দরবারে বঙ্গভঙ্গ রদের ফলে ১৯০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ বিলুপ্তির কারণে এ অঞ্চলের বৃহত্তর জনসমষ্টি মুসলমানদের যে ক্ষতি হয় তার এক খেসারতস্বরূপ- লর্ড লিটনের কথায় 'এক চমৎকার রাজকীয় ক্ষতিপূরণ' [‘a splendid Imperial compensation’]
লেখক : সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়