মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী নায়েক রাজ্জাককে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার প্রতিবাদে গত সপ্তাহে বাংলাদেশ প্রতিদিনে ‘নায়েক রাজ্জাকরাই আসল নায়ক’ শিরোনামে একটি লেখা লিখেছিলাম। সেই লেখায় উল্লেখ করেছিলাম, নায়করাজ রাজ্জাক আমার সবচেয়ে প্রিয়। গত রবিবার রাতে এক শুভাকাক্সক্ষী আমাকে ফোন করে বললেন, আপনার প্রিয় নায়ক তো লাইফ সাপোর্টে। তিনি একটি টিভি চ্যানেলের স্ক্রলের রেফারেন্স দিলেন। নায়ক রাজের যে বয়স, তাতে অবিশ্বাস করিনি। উৎকণ্ঠা নিয়ে দ্রুত খোঁজ নিলাম। নায়ক রাজের ছেলে সম্রাটের সঙ্গে কথা বললাম। তিনি জানালেন, তার বাবা রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে ভর্তি আছেন। তবে তার অবস্থা স্থিতিশীল। উৎকণ্ঠা একটু কমল। কিন্তু সোমবার রাতে আবার গুজব। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে অনেকেই নায়ক রাজের মৃত্যু সংবাদ দিয়ে দিলেন। তার শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়, তার পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনাও জানিয়ে ফেললেন কেউ কেউ। সামাজিক মাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল সে খবর। রীতিমতো হাহাকার শুরু হলো।
কিন্তু খোঁজ নিয়ে জানলাম, ঘটনা সত্য নয়। বরং রাজ্জাকের অবস্থার উন্নতি হয়েছে। দুয়েকদিনের মধ্যে তাকে আইসিইউ থেকে কেবিনে স্থানান্তর করা হবে। সামাজিক মাধ্যমের সেই গুজবের আগুনে ঘি ঢালল কয়েকটি অনলাইন। তারা ছবি-টবি দিয়ে জানিয়ে দিল, নায়ক রাজ আর নেই। এমনকি কয়েকজন দায়িত্বশীল সাংবাদিকও নায়ক রাজের মৃত্যুর খবরের স্ট্যাটাস দিয়েছেন। যাতে আরও অনেকের মতো আমিও বিভ্রান্ত হয়েছি। এটা ঠিক গণমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক। গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা আছে, জবাবদিহিতা আছে। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমের তা নেই। গণমাধ্যমে একজন রিপোর্টার যা লেখেন, চিফ রিপোর্টার, বার্তা সম্পাদক, কখনো কখনো সম্পাদকের হাত ঘুরে তা প্রেসে যায়। কিন্তু সামাজিক মাধ্যমে সবাই একেকজন সম্পাদক। তিনি যা লেখেন, তাই পোস্ট হয়। সামাজিক মাধ্যমের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় ফেসবুক। সামাজিক মাধ্যম আসলে আমাদের আগের রকের আড্ডার ভার্চুয়াল রূপ। রকের আড্ডার সব কথা যেমন ধরতে হয় না। তেমনি ফেসবুকের সব কথাও ধরতে হয় না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, তথ্যের অবাধ প্রবাহের এই যুগে ফেসবুক এখন তথ্যপ্রাপ্তি এবং জনমত গঠনের শক্তিশালী বিকল্প মাধ্যম হয়ে উঠেছে। গণমাধ্যমে যা বলা যায় না, সামাজিক মাধ্যমে তাই লিখে ফেলেন অনেকে। ফেসবুকে ট্যাগ করা একটি ছবির সূত্র ধরে রামুতে তুলকালাম কাণ্ড হয়ে গিয়েছিল। তাই ফেসবুককে নিছক আড্ডা বিবেচনা করে উপেক্ষা করার সুযোগ আর নেই। বরং গুজব ছড়ানোর ডিজিটাল মাধ্যম এখন ফেসবুক। এই সামাজিক মাধ্যমে এখন দ্রুত ধর্মীয় বিদ্বেষ, জাতি বিদ্বেষ, ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাই ফেসবুক ব্যবহারকারীদের আরও অনেক বেশি সতর্ক ও দায়িত্বশীল হওয়ার সময় চলে এসেছে।
একই সঙ্গে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা অনলাইনের ব্যাপারেও ভাবার সময় চলে এসেছে। সোমবার রাতে সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো রাজ্জাকের মৃত্যুর গুজবকে প্রায় ভিত্তি দিয়েছে কয়েকটি নামকাওয়াস্তের গণমাধ্যম। নিজের স্ট্যাটাসের পক্ষে অনেকেই বিভিন্ন অনলাইনের লিঙ্ক শেয়ার করেছেন। এই অনলাইনগুলো সামাজিক মাধ্যমের সঙ্গে গণমাধ্যমের পার্থক্য ঘুচিয়ে ফেলছে। প্রশ্নের মুখে ফেলছে, গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতাও। ভাগ্য ভালো, দুয়েকটি টিভি চ্যানেল আগের দিন রাজ্জাক লাইফ সাপোর্টে বা তার অবস্থা শঙ্কায়, এমন খবর প্রচার করলেও কেউই তার মৃত্যুসংবাদ প্রচার করেনি। মূলধারার কোনো পত্রিকা বা অনলাইনও এ ভুল করেনি। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের কাছে আরও সতর্ক থাকার অনুরোধ জানানো ছাড়া আর কিছু করার নেই। কিন্তু গণমাধ্যমের আবরণে সামাজিক মাধ্যমের চেয়েও দায়িত্বহীন আচরণ করা অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোর ব্যাপারে নিশ্চয়ই সরকারের কিছু না কিছু করার আছে। বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমের স্বাধীনতা আছে। কিন্তু তা সংবিধানে দেওয়া শর্তসাপেক্ষে। যা ইচ্ছা তাই করার, যা ইচ্ছা তাই লেখার নাম স্বাধীনতা নয়। স্বাধীনতার নামে এই স্বেচ্ছাচারিতা চলতে দিলে প্রশ্নবিদ্ধ হবে মূলধারার গণমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা। আমি খুব আশাবাদী মানুষ। সব খারাপ থেকেও একটা ভালো কিছু বের করে আনার চেষ্টা করি। ছেলেবেলায় শুনেছি, কারও মৃত্যুসংবাদ প্রচার হলে নাকি তার আয়ু বাড়ে। দুয়েকটি গণমাধ্যম আর সামাজিক মাধ্যমে মৃত্যুসংবাদের গুজব নিশ্চয়ই আমাদের প্রিয়তম নায়করাজ রাজ্জাকের আয়ু আরও বাড়িয়ে দেবে। শতায়ু হন নায়ক রাজ।