বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, বিএনপি আছে, বিএনপি থাকবে। দেশের সব গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষই চায় যতদিন আমাদের দেশে প্রায় দ্বিদলীয় ব্যবস্থা টিকে আছে ততদিন প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল- আওয়ামী লীগ ও বিএনপি শক্তিমত্তা নিয়েই টিকে থাক। তা না হলে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। ইতিমধ্যে সে লক্ষণ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ আছে যে, তারা দেশ শাসনে গণতন্ত্রের সব শর্তই একে একে লঙ্ঘন করে চলেছে। এবার তাদের সরকার গঠন প্রতিক্রিয়াটাই দেশে-বিদেশে মহাবিতর্কের ঝড় তোলে। প্রত্যক্ষ কোনো নির্বাচন ছাড়াই তারা সরকার গঠন করার মতো স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন করায়ত্ত করে নেয়। বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সদস্য সংখ্যা ৩০০-এর মধ্যে ১৫৩ আসনেই কোনো নির্বাচন হয়নি। এরা অটো এমপি। বর্তমান সরকার প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দ্বারা গঠিত নয় বলে বিরোধী দলসমূহ, দেশের অনেক বুদ্ধিজীবী অভিযোগের যে তীর ছুড়ছেন তা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। প্রতিদ্বন্দ্বী-প্রতিপক্ষ যদি অতিশয় দুর্বল হয়, পরিস্থিতি গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের তীব্রতা দিয়ে যদি প্রতিহত করতে না পারে তখন শক্তিশালী সক্ষম পক্ষ যা খুশি তা করার সুযোগ পায়। বর্তমান ক্ষমতাসীনরা সে সুযোগ নিয়েছে। বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং আওয়ামী লীগের ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং মোকাবিলার মোক্ষম কৌশল নির্ধারণে ব্যর্থতার কারণেই বর্তমান পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। তো, বিএনপি তো ছিলই, এখনো আছে- অন্তত পত্রিকার পাতায় এবং টিভি পর্দায় তো আছে। এমন থেকে লাভ কী?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিএনপির টিকে থাকার মতো থাকাটা নির্ভর করে প্রথমত দলটির সঠিক রাজনৈতিক লাইন পুনঃনির্ধারণ এবং দ্বিতীয়ত সাংগঠনিক পুনর্বিন্যাসের ওপর। রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণের ক্ষেত্রে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়টিকে যথাযথভাবে অ্যাড্রেস করতে হবে। সাংগঠনিক পুনর্বিন্যাসের ক্ষেত্রে 'কর্মচারীনির্ভর' প্রক্রিয়া পরিহার করতে হবে। বিএনপির থাকার মতো থাকার রাজনীতিটা কী হবে? এ ব্যাপারে নতুন করে কষ্টসাধ্য কিছু করার প্রয়োজন নেই। দলের প্রতিষ্ঠাতা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান বিএনপির ঘোষণাপত্রের শুরুটা প্রথম যে বাক্য দিয়ে শুরু করেছিলেন, স্খলনের জন্য তওবা করে আবার সেই ঘোষণার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ, তার যথার্থ অনুসরণ এবং তা বাস্তবায়নের প্রতি বিএনপি নেতৃত্বকে সৎ ও আন্তরিক হতে হবে সর্বাগ্রে। বিএনপির ঘোষণাপত্রে সেই বাক্যটি এখনো লিপিবদ্ধ আছে। কী আছে তাতে? বাক্যটি হুবহু এমন, 'ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামের সোনালি ফসল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব আমাদের পবিত্র আমানত এবং অলঙ্ঘনীয় অধিকার। প্রাণের চেয়ে প্রিয় মাতৃভূমি এই স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুদৃঢ় এবং সুরক্ষিত করে রাখাই হচ্ছে আমাদের কালের প্রথম ও প্রধান দাবি।' জিয়াউর রহমান কোন বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সুরক্ষার কথা বলেছেন তা অত্যন্ত পরিষ্কার 'ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামের সোনালি ফসল'- এই শব্দ চতুষ্টয় উচ্চারণের মধ্যে। মুক্তিসংগ্রাম বা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশকে তিনি অবিচ্ছিন্ন, অবিচ্ছেদ্যভাবে দেখেছেন। এ অবস্থান থেকে বিচ্যুত হলে বিএনপি আর জিয়াউর রহমানের প্রতিষ্ঠিত বিএনপি থাকে না। শহীদ জিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী বিএনপির রাজনীতি ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটকে বাদ দিয়ে চিন্তাই করা যায় না। বেশি ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই যে, মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই হবে বাংলাদেশের আজ, কাল ও আগামীর রাজনীতির ভিত্তি। জিয়ার জীবদ্দশায় বিএনপি সেই রাজনীতি-ই করেছে। শাহ আজিজ-আবদুল আলীমরা বিএনপিকে সাম্প্রদায়িক-মৌলবাদী বা পাকিস্তানপন্থি রাজনীতির ধারায় নেওয়ার কোনো চিন্তার সুযোগই পাননি। তারপরও বহুদিন এই সমালোচনাও থাকবে যে, এদের সঙ্গে না নিলে কি চলত না?
কিন্তু এখন বিএনপি কী করছে? জিয়াউর রহমানের অনুসৃত পথে কি তারা অটল আছে? নেই তো। যদি থাকত তাহলে বাংলাদেশের 'ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামের' প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামী কী করে তাদের ঘনিষ্ঠতম মিত্র হয়? জোটের নামে কেমন করে তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা হয়? সমালোচনার জবাবে বলা হয়, এই জোট (২০ দলীয় জোট) নাকি ভোটের জোট। প্রায় দুই দশক ধরে দেশে কি প্রতিদিন ভোটই হচ্ছে যে, জামায়াত-বিএনপি বাঁধন টুটাই যাচ্ছে না! 'বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানোর' মতো এসব কথা বলে লাভ নেই। মানুষ বোঝে এবং বলেও যাচ্ছে যে, বিএনপির চরম দক্ষিণপন্থি বিচ্যুতি হয়েছে। সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী রাজনীতি দক্ষিণপন্থি প্রতিক্রিয়াশীলতার নগ্ন ও উগ্র প্রকাশ। এই রাজনীতি গণতন্ত্র ও সমাজ- প্রগতিবিরোধী। এরা আধুনিক বিজ্ঞানমনস্কতার বিপরীতে পশ্চাদপদতার অনুসারী। আলোর ভুবন থেকে এরা মানুষ ও সমাজকে নিয়ে যেতে চায় কষকালো অন্ধকারে। ধর্মানুরাগ ও ধর্মাচারকে এরা ভয়ঙ্কর ধর্মনির্মান্ধতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। গণতন্ত্রের সঙ্গে এবং সমাজপ্রগতির সঙ্গে ধর্মের কোনো বিরোধ নেই, সংঘাত নেই। কিন্তু গণতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মান্ধতা কখনোই সমানে যায় না। জামায়াতে ইসলামী এবং এই ধরনের প্রকাশ্য ও গোপন সংগঠনগুলো ধর্মান্ধ বলেই চিহ্নিত ও সমালোচিত। এই শক্তি কখনো, কোথাও গণতন্ত্রের বন্ধু হয় না। বাংলাদেশে এরা আবার আমাদের ঐতিহাসিক মুক্তিসংগ্রামের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী রাজনৈতিক শক্তি। কেউ কেউ ইদানীং এমন ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন যে, এখন যারা জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যুক্ত, তাদের অধিকাংশের বয়সই ৫০-এর নিচে। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে এদের কারও জন্মই হয়নি অথবা তাদের নেতাদের মতো ভূমিকা রাখার বয়স ছিল না। কথাটা সত্য। এখানে দুটি বিষয় বিবেচ্য; এক. আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকেও অভিযুক্ত করার বিষয়টি এসেছে এবং তার ভিত্তিতে দলটি নিষিদ্ধ করার জোরালো দাবি আছে সারা দেশে। জামায়াত-শিবিরের বর্তমান নেতা-কর্মীদের অধিকাংশের বয়স ৫০-এর কম হলেও তারা এই 'যুদ্ধাপরাধী' সংগঠনের সঙ্গেই জড়িত। দুই. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্মকালীন 'প্রসববেদনা'। সেই মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারী এবং হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠনসহ নানাবিধ মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত দলটি এখনো একটিবার উচ্চারণও করেনি যে, একাত্তরে তারা অন্যায় করেছে এবং সে জন্য জাতির কাছে তারা ক্ষমাপ্রার্থী। বরং তারা বিভিন্ন সময়ে এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ উচ্চারণও করেছে যে, একাত্তরে তারা যা করেছে ঠিক করেছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরকালে 'খালেদা-মোদি' একান্ত বৈঠকের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে একটা ধারণা ছড়িয়ে পড়ে যে, বিএনপি বোধহয় শিগগিরই জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করবে। ধারণাটা এ কারণে যে, নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনাকে বেগম খালেদা জিয়া 'খুবই ফলপ্রসূ' বলে চিত্রিত করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী যদি পূর্ববর্তী কংগ্রেসী সরকারের মতো শেখ হাসিনার সরকারকে সহযোগিতার এবং তিনি যা বলেন সেভাবে কাজ করার কথা বেগম জিয়াকে বলতেন, তিনি নিশ্চয়ই আলোচনা 'ফলপ্রসূ' হয়েছে তেমন কথা বলতেন না। বেগম জিয়া চান একটি আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচন। ভারত সেই নির্বাচন করে দিতে পারবে না ঠিক, কিন্তু সবাই বিশ্বাস করে, এ ব্যাপারে প্রভাব খাটাতে পারবে। পৃথিবীর প্রায় সব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র এবং জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশে তেমন একটি অংশগ্রহণমূলক বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন চায়। ভারতও যদি চায়, সরকার তেমন একটি নির্বাচনের কথা ভাববে এমন একটা ধারণা এদেশে অনেকটাই বদ্ধমূল। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ভিতরে ভিতরে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। সব দেখেশুনেই মনে হচ্ছে, খালেদা-মোদি আলোচনা সত্যিই 'ফলপ্রসূ' হয়েছে। বাংলাদেশে ভারতের যে সব স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে সেসব বাস্তবায়নের জন্য বাংলাদেশে জনগণের ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত একটা সরকার প্রয়োজন- ভারতের নেতৃত্ব এটা অবশ্যই বোঝেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনটি কেমন হয়েছে সেই খবরও অবশ্যই আছে তাদের কাছে। বেগম খালেদা জিয়া তার কাঙ্ক্ষিত ইস্যুতে পজিটিভ একটা ইঙ্গিত না পেলে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনাকে নিশ্চয়ই 'ফলপ্রসূ' বলতেন না। বেগম জিয়ার আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচনের শর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যদি অনুকূল মনোভাব দেখিয়ে থাকেন, তা কি কোনো শর্ত ছাড়াই? রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সহযোগিতার শর্তের বাইরে একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত থাকার কথা স্বাভাবিক এবং তা জামায়াত ত্যাগ। ভারত তার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার স্বার্থেই জামায়াতবিরোধী হওয়ার কথা।
বিএনপির শুভানুধ্যায়ীরা মনে করেন, বিএনপি এখনো বিপুলভাবে জনসমর্থিত একটি দল। ভোটের হিসাবে প্রায় আওয়ামী লীগের সমান সমান। কিন্তু জনগণের এই সমর্থন রাজনীতি বর্জিত নয়। বেগম খালেদা জিয়া দলের নেতৃত্ব গ্রহণের পর এরশাদ-বিরোধী আন্দোলনে এবং শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের (৯৬-২০০১) অগণতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে সাহসী আন্দোলনে এই জনগণ দলের সঙ্গে মাঠে ছিল। সেই জনগণ দলের পক্ষে এখনো আছে, কিন্তু আন্দোলনের মাঠে নেই। কেন নেই? ১. জামায়াত 'ঘষাঘষি' মানুষ পছন্দ করে না। মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রক্রিয়া শুরুর পর বিএনপি সমর্থক বিপুল জনগোষ্ঠীও এর পক্ষে দাঁড়িয়েছে। জামায়াত-হেফাজতকে নিয়ে নেতাদের 'খেলার' সঙ্গে সমর্থক জনগোষ্ঠী নেই বলেই আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নেয় না। গণতন্ত্র আর মৌলবাদতন্ত্র একসঙ্গে যেতে পারে না। গদির লোভে নেতৃত্ব রাজনীতি বিসর্জন দিলেও যে রাজনীতি নিয়ে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা কাজ শুরু করেছে তারা সে রাজনীতি বর্জন করতে পারে না, করেনি। বিএনপিকে লক্ষ্য অর্জন করতে হলে রাজনীতির সঠিক লাইন গ্রহণ করতে হবে। জামায়াতের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা না রাখার বিষয় বিএনপির রাজনীতির এক বড় অধ্যায়। গণতন্ত্র ও সুশাসন চাইলে এটা পরিষ্কার করতে হবে। ২. দলের জনসমর্থন কাজে লাগাতে হলে উপযুক্ত সংগঠন লাগবে। উপযুক্ত নেতৃত্ব কাঠামোই নিচ থেকে ওপর সর্বত্র দলের একটি উপযুক্ত ও সক্ষম কাঠামোও নির্মাণ করে। বিএনপিতে বর্তমানে তা একেবারেই নড়বড়ে। সরকারি নিপীড়ন, জেল, জুলুম, মামলা-মোকদ্দমায় দলটি জর্জরিত এ কথা সত্য। কেন্দ্রের কজন নেতা জেলে আছেন? স্থায়ী কমিটির সদস্য ১৯ জন, সহ-সভাপতি ১৬ জন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ৩৮ জন, সম্পাদকমণ্ডলী, নির্বাহী কমিটি মিলে নেতার সংখ্যা চার শতাধিক। জেলে তো আছেন কেন্দ্রের ১৫-২০ জন। বাকিরা কোথায়? কী করেন? আসলে কোনো কাজ নেই অনেকের। অনেকের 'ওজন' নানাভাবে এত ভারী হয়ে গেছে যে, এরা কিছু করার কোনো সাহস বা ক্ষমতা কোনোটাই রাখেন না। অধিকাংশই সুপারইম্পোজিশনের মাধ্যমে পদাধিকারী। স্টাফ অফিসারের মতো। দলের যারা মালিক-মোক্তার তাদের সন্তুষ্টি অনুযায়ী কাজ করাটাই এদের কাজ। অসন্তুষ্ট হলেই চাকরি নেই। অধিকাংশের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট নিয়েই প্রশ্ন আছে। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় দু-একজনের ইচ্ছায়। সিনিয়র নেতারাও দলের অনেক সিদ্ধান্ত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকেন না। নীতিনির্ধারণী কমিটির অনেক সদস্যের সঙ্গে দলের চেয়ারপারসনের দেখা সাক্ষাৎ, কথাবার্তা হয় না মাসের পর মাস। বার্তা বা নির্দেশ যায় কর্মচারীদের মাধ্যমে। ওপর কাঠামোতেই আস্থার সংকটের কথা শোনা যায়। আছে পারস্পরিক অবিশ্বাস। দলের জন্য যারা খাটে, কষ্ট ভোগ করে, পুলিশের লাঠি-গুঁতো খায়, তারা চেয়ারপারসনের সঙ্গে দেখা করে কষ্টের কথাও বলতে পারে না ওনার অতি ক্ষমতাধর কয়েকজন কর্মচারীর বাধার কারণে। বেগম খালেদা জিয়া সরকারকে গণবিচ্ছিন্ন বলেন। কথাটা মিথ্যা নয়। কিন্তু তিনি দলবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন, কিছু লোক যে কৌশলে তা করছে তিনি সে সম্পর্কে অবগত বলে মনে হয় না। সরকার প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করছে বলেও তিনি অভিযোগ করছেন; কিন্তু চক্রান্তকারী স্বার্থান্বেষীরা তাকে এ ধরনের 'কারাগারে' বন্দী রেখে বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান যে ধ্বংস করছে সেদিকেও বোধহয় তার নজর নেই। গণতন্ত্রে বিরোধী দলের ভূমিকাও খুব জরুরি। বিএনপির কাছ থেকে জনগণের প্রত্যাশা অনেক। সেই প্রত্যাশা পূরণের জন্য বিএনপি পুনর্গঠনের ডাক বাত-কা-বাত হলে চলবে না। বিএনপির যে রোগ হয়েছে সে রোগ হোমিও চিকিৎসায় সারবে না। মেজর অপারেশন দরকার। আজেবাজে 'পদার্থ' (লুটেরা, সন্ত্রাসী, জালিয়াত, সামাজিক দুর্বৃত্ত, দলের বোঝা, দল করে খায়, স্পাই) সব সাফ করে ফেলতে হবে। দাগি-দোষীদের বাদ দিয়ে নতুন প্রজন্মের সৎ ও আদর্শবাদীদের হাতে তুলে দিতে হবে দলের ঝাণ্ডা। সমন্বয় ঘটাতে হবে নবীন-প্রবীণের। দলের শুভানুধ্যায়ীরা ইদানীং বলতে শুরু করেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার বয়স হয়েছে। তিনি অসুস্থও। দলকে তিনি যদি সুনির্দিষ্ট আদর্শের ওপর দাঁড় করিয়ে একটা গণতান্ত্রিক সিস্টেমে চলার ব্যবস্থা করে না যান, বিএনপি ভবিষ্যতে আরও বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। বিলাতে বসে তারেক রহমানের পক্ষে লক্ষ্যহীন, অগোছালো বিএনপি চালানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। একটি আগাম বা মধ্যবর্তী নির্বাচন যদি অবশ্যম্ভাবী হয়, তার ফসল ঘরে তুলতে চাইলে যে বিএনপি আছে সে বিএনপি দিয়ে হবে না, অধ্যাপক বদরুদ্দোজা চৌধুরীর ভাষ্য অনুযায়ী জিয়ার বিএনপি লাগবে। এখনো সে সময় ও সুযোগ আছে। সুযোগ কাজে না লাগালে মধ্যবর্তী নির্বাচনের ফসলও উঠবে আওয়ামী লীগের ঘরে। বিএনপি পরিণত হবে 'মরহুম মুসলিম লীগের' মতো দলে।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট।
ই-মেইল : [email protected]