বিএনপি দাবি করে ২৫ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরু এবং ১৬ ডিসেম্বর তার পরিসমাপ্তি। প্রকারান্তরে আওয়ামী লীগও সে পথেই হেঁটেছে। অথচ একটি দীর্ঘ ও ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের ফসল স্বাধীনতা।
সম্প্রতি ক্ষমতাসীন নেত্রী জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনের বক্তৃতায় বলেছেন- 'আন্দোলনের বিস্তৃত পথপরিক্রমণে যারা আমার বাবার পাশে ছিলেন তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।' তার এই বক্তৃতা আমাকে আরও নিশ্চিত করেছে যে, ইতিহাস একদিন প্রকৃত সত্যকে প্রতিষ্ঠিত করবেই। এবং আমি সচেতন চিত্তে আওয়ামী লীগ নেত্রীকে স্মরণ করিয়ে দিতে চাই- পদবি, স্থাপনা বাংলাদেশে যা কিছুই হয়েছে, সবই ৯ মাসের যুদ্ধকালীন সময়ে অস্ত্রধারণের জন্য হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য যারা পদক পেয়েছেন (বীরশ্রেষ্ঠ, বীরোত্তম, বীরবিক্রম, বীরপ্রতীক), তারা ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে অস্ত্রচালনার বদৌলতে পেয়েছেন। মূল রাজনৈতিক নেতৃত্বকে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক কোনো স্বীকৃতি এখন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। পৃথিবীর সব সভ্য দেশ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এমনকি ভারতেও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রবর্তকদের বেসামরিক সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে (বিশেষ করে অবদানের গুরুত্ব অনুসারে ভারতের বেসামরিক রাষ্ট্রীয় সম্মান ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রীর কথা উল্লেখ করা যেতে পারে)। কিন্তু বাংলাদেশই এক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম। এক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা যেতে পারে। বিলম্বে হলেও ক্ষমতাসীন নেত্রীর আজকের এই উপলব্ধি মন্দের ভালো। তার বক্তৃতা, বিবৃতি, কথনে ও বচনে এর কোনো ইঙ্গিত-আভাস আগে কখনো প্রতিভাত হয়নি।
স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু, ছাত্রলীগ একটা অদৃশ্য রাখিবন্ধনে বাঁধা। বাঁধনটি এতই নিবিড় ও অটুট যে, বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ, বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার বিস্তীর্ণ কণ্টকাকীর্ণ পথ অতিক্রম করতে, অজেয়কে জয় করতে, পরাধীনতার বক্ষ বিদীর্ণ করতে কোনো জায়গায় কোনো প্রতিবন্ধকতাই এর গতিকে রুদ্ধ করতে পারেনি। আর পারেনি বলেই বঙ্গবন্ধু তার দূরদর্শিতা, দেশপ্রেম এবং মাটি ও মানুষের নিগূঢ় ভালোবাসায় সিক্ত ছিলেন বলেই ছাত্রলীগ নেতৃত্ব তাকে হৃদয়ের নিভৃত কন্দরে প্রতিস্থাপিত সিংহাসনে মুকুটহীন সম্রাটের মর্যাদায় বসায়। এই আন্দোলনের সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন না, এই কণ্টকাকীর্ণ বন্ধুর পথ অতিক্রম করতে এবং বঙ্গবন্ধুর একক নেতৃত্বকে প্রতিস্থাপিত করতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ছাত্রলীগ যে বিরামহীন প্রচেষ্টায় ব্যাপৃত ছিল- বর্তমান ক্ষমতাসীন জোটের অনেক শক্তিধর নেতৃত্ব যারা সেদিন বিভিন্নভাবে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিলেন- আজ তারা শেখ হাসিনাকে মানিপ্লান্টের মতো শুধু জড়িয়ে ধরেননি, অক্টোপাসের মতো গ্রাস করেছেন। স্বায়ত্তশাসন থেকে স্বাধিকার, স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার উত্তরণে বঙ্গবন্ধুকে সিআইএ-এর দালাল, ভারতের অনুচর, সংকীর্ণতাবাদী মানসিকতার প্রতিবিম্ব হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। কেউ কেউ তার হাড্ডি দিয়ে ডুগডুগি বাজানো, চামড়া দিয়ে জুতা বানানোর স্পর্ধা ব্যক্ত করেছেন- তারা পালতোলা নৌকায় মৃদু হিল্লোলে আজ কী সুখেই না ক্ষমতা ভোগ করছেন! এখানে জনান্তিকে জানিয়ে রাখি, বঙ্গবন্ধু ও তার চেতনা আমাদের- বিশেষ করে আমার হৃদয়ের সব ক্যানভাসজুড়ে শাশ্বত সত্য হিসেবে বিরাজ করেছে। রাজনীতির দীক্ষা নেওয়ার পর থেকেই বিশেষ করে আজকে এই জীবনসায়াহ্নে ক্ষমতার প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণ বা প্রলোভন আমার নেই, কখনো ছিলও না। জীবনসায়াহ্নে এসে ক্ষমতা আমার চেতনার আবর্তের সম্পূর্ণ বাইরে। তাই কোনো ক্ষমতাসীনের প্রতি বিন্দুমাত্র ঈর্ষাও আমার নেই। যারা আমাকে চেনেন, আমার রাজনীতি সম্বন্ধে যাদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে, শত মতপার্থক্য সত্ত্বেও এ কথাটি তারা অকপটে স্বীকার করেন। এটি আমার হৃদয়কে পরিতৃপ্ত করে বলেই বঙ্গবন্ধুর আদর্শের অকৃত্রিম উত্তরাধিকার হিসেবে নিজেকে প্রতিভাত করতে আমি গর্ববোধ করি।
আমি ব্যথিত হই এটি অবলোকন করে যে, বঙ্গবন্ধুর বিরোধীরা জোটবদ্ধ হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতই শুধু নয়, বরং তার প্রাণের চেয়েও প্রিয় সংগঠন আওয়ামী লীগকে আজ ভিন্ন ও বিপরীতমুুখী ধারায় প্রবাহিত করতে সফল হয়েছেন। এটি শুধু আমি নই, ছাত্রলীগের শুরু থেকে স্বাধীনতার প্রদীপ্ত সূর্যকে ছিনিয়ে আনা পর্যন্ত বিস্তৃত পথপরিক্রমণে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা সবাই উপলব্ধি করেন। এই দীর্ঘদিনের অকুতোভয় নেতৃত্বের প্রায় সবাই আজ উপেক্ষিত, নিষ্প্রভ। জীবিত ও মৃতদের অনেকেই আজ স্বীকৃতি তো দূরে থাক বরং ধিকৃত। এটাও সাইবেরিয়ান পাখিদের আওয়ামী লীগে স্থায়ী আস্তানা গড়তে সহায়তা করেছে। অনুপ্রবেশকারীরা গৃহের নির্মাতা ও স্বত্বাধিকারীদের গৃহছাড়া করেছে। মুজিব ভাইয়ের প্রাণের সংগঠন, হৃদয়ের স্পন্দন ছাত্রলীগকে সুপরিকল্পিতভাবে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অতলান্তে নিমজ্জিত করেছে। যে ছাত্রলীগ মুজিব ভাইকে বঙ্গবন্ধু ও জাতির জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, যে ছাত্রলীগ ৬ দফা কর্মসূচিকে (তৎকালীন সভাপতি সৈয়দ মাযহারুল হক বাকী ও সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক) আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর বাংলার মুক্তিসনদ হিসেবে গ্রহণ করে (তা না হলে আঁতুড়ঘরেই ৬ দফার মৃত্যু হয়ে যেত, আলোর মুখ দেখত না), এটিকে সমগ্র মানুষের চেতনার পরতে পরতে, রক্তের কণায় কণায়, অনুভূতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকিয়ে না দিলে স্বাধীনতার সোপানটি তৈরি হতো না। যে ছাত্রলীগ (আবদুর রউফ, খালেদ মোহাম্মদ আলী ও তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে) অপূর্ব রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় ১১ দফার সঙ্গে ৬ দফা সংযুক্ত করে '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান না ঘটালে মুজিব ভাইকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত করা সম্ভব হতো না। হয়তো তাকে পাকিস্তানি পৈশাচিক শক্তি ফাঁসিকাষ্ঠেই ঝুলিয়ে দিত। শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ ফজলুল হক মণি, এনায়েতুর রহমান, কে এম ওবায়দুর রহমান- '৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনে এদের অবদান ইতিহাসে একদিন স্বীকৃতি পাবেই।
৭ মার্চে ৩২ নম্বরের বাসায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা বঙ্গবন্ধু রেসকোর্সে উপস্থিত হওয়ার আগেই উপস্থিত জনতাকে উজ্জীবিত করে এবং আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো বিস্ফোরিত করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুসরণ করার জন্য প্রতিটি মানুষকে ইস্পাতকঠিন প্রতীতির আওতায় নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই এক থেকে সোয়া ঘণ্টা আগে এসেই স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ মূল মাইকের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। খণ্ড খণ্ড অগ্নিঝরা বক্তৃতা ও স্লোগানে রেসকোর্সকে প্রকম্পিত করে তুলে তাদের চেতনাকে শাণিত করে অবশ্যম্ভাবী যুদ্ধের জন্য সেদিন প্রস্তুত করে। ১৯৭১-এর ১ মার্চ ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হওয়ার মুহূর্ত থেকে স্বাধীনতাপূর্ব ও স্বাধীনতা-উত্তরকালে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সব সভায় সভাপতিত্ব করার বিরল গৌরব ছাত্রলীগ সভাপতির। তখন প্রতিটি সভার শুরুতে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শপথবাক্য পাঠ করত। ২৩ মার্চ ১৯৭১-এ প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলনের সময় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃচতুষ্টয় আনুষ্ঠানিক অভিবাদন গ্রহণ করার পর সামরিক কুচকাওয়াজের মতো মার্চ করে ৩২ নম্বরে গিয়ে ছাত্রলীগের সভাপতি সেই পতাকাটি স্বগৌরবে বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন। কিন্তু সেসব গৌরবের ইতিহাস আজ বিস্মৃতপ্রায়।
সেই ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্ব ও অযুত কর্মী আজ শুধু গুরুত্বহীনই নয়, নিষ্প্রভ, নিস্তব্ধ এবং দল হতে অনেকেই বিতাড়িত। ৬০ দশকের প্রয়াত এবং জীবিত ছাত্রলীগ শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর কেউ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের অগ্রভাগে আসতে পারেননি (আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ ছাড়া। পরবর্তীতে তাদের প্রতিও নিদারুণ অসম্মান ও তাচ্ছিল্য অবলোকন করা গেছে)। প্রাসঙ্গিকভাবে একটি কথা অবশ্যই উল্লেখ্য, যারা '৭০-এর নির্বাচনের বিরোধী ছিলেন, বন্দুকের নলই যাদের বিশ্বাসের একমাত্র আঙ্গিক ছিল, ভোটের কথা বলে যারা ইয়াহিয়া খানের দালাল তারা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, নির্বাচন বর্জন কর- এই চেতনায় বিশ্বাসী ছাত্রলীগের একটা বিশাল গোষ্ঠীকে মোকাবিলা করে '৭০-এর নির্বাচনটি করা শুধু দুঃসাধ্য সাধনই নয়, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে স্বাধীনতা অর্জনের একটা অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত। তখন বিশ্বজুড়ে সমাজতন্ত্রের বিপ্লবের ঝড় বইছিল। সমগ্র বিশ্বের রাজনীতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমাজতন্ত্রের উদগ্র উন্মাদনা। তার মাঝেই বাংলার সব ছাত্র, যুবক ও তারুণ্যকে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে একটি মিলনের মোহনায় একত্রিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনা সহজ ছিল না।
১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে গঠিত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের প্রতিধ্বনি ছিল। যে কথাটি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কারণে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বলা সম্ভব হতো না, সেই কথাটিই স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ নেতৃত্বের কণ্ঠে উচ্চারিত হতো। বলাবাহুল্য, নির্বাচনের আগে যারা সশস্ত্র বিপ্লব করতে চেয়েছিলেন, তারাও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও স্বাধীনতার প্রশ্নে ব্রতী ছিলেন। '৭১-এর ১ মার্চে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও জাতির জনক হিসেবে ঘোষণা দিয়ে শপথগ্রহণের মধ্যদিয়ে।
স্বাধীনতা-পূর্বকালেও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রীরা নির্বাচন বর্জন করে সশস্ত্র সংগ্রাম চেয়েছিলেন, যদিও সেটি প্রচণ্ডভাবে আত্দঘাতী হতো। আল্লাহর অশেষ রহমতে এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নিবিড় সংশ্লিষ্টতার কারণে ওই চেতনাটিকে মোকাবিলা করে '৭০-এর নির্বাচনটি সংঘটিত করার সফলতার মধ্যদিয়ে আমরা স্বাধীনতার পাদপীঠ ও স্বাধীনতার প্রতি বিশ্বজনমতের নিঃসংশয় সমর্থন লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমি নিঃসংশয়চিত্তে এই বাস্তবতাকে স্বীকার করি, সমাজতান্ত্রিক চেতনার ধারকদের সঙ্গে স্বাধীনতার কৌশল ও পদ্ধতি নিয়ে বিস্তর দূরত্ব থাকলেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ও স্বাধীনতার প্রতি ছাত্রলীগের দুটি ধারাই ছিল অবিচল আপসহীন ও নিঃসংশয়চিত্ত। স্বাধীনতা-পূর্বকালে দুটি ধারায় ছাত্রলীগ বিভক্ত হলেও '৭০-এর নির্বাচনের অভূতপূর্ব ফলাফল বিশেষ করে '৭১-এর ১ মার্চের ইয়াহিয়া খানের ঘোষণার পর ছাত্রলীগের প্রতিটি কর্মী সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত তরঙ্গমালার মতো একাকার হয়ে যায়। তার বাস্তব দৃষ্টান্ত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে গঠিত।
আমি লোক-পরম্পরায় অবহিত হয়েছি যে, এই রাজনৈতিক পথপরিক্রমণের মধ্যদিয়ে যারা স্বাধীনতার চেতনাটিকে উজ্জীবিত করলেন, তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় দ্বিধাগ্রস্ত এই কারণে যে, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভাজন, স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের দুই নেতা বিশেষ করে আ স ম আবদুর রবের বঙ্গবন্ধুর হাড্ডি দিয়ে ডুগডুগি বাজানো, চামড়া দিয়ে জুতা বানানো- এসব অশালীন, অমার্জিত ও অরাজনৈতিক বক্তব্যে আওয়ামী লীগ ও দেশবাসীর চাপা ক্ষোভকে মূল অন্তরায় মনে করছেন। কিন্তু আমার যুক্তি হলো, '৯৬-এর নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় আ স ম রব স্থান পেয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি কটূক্তির দায়ভার থেকে ইতিহাস সম্ভবত তাদের মুক্তি দেবে না। কিন্তু ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে গঠিত স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ যে বঙ্গবন্ধুর চেতনার মূল উত্তরাধিকার ছিল, সেটা অস্বীকার করা অযৌক্তিক।
ব্যক্তিগতভাবে আমি পদ-পদবির প্রতি নিরাসক্ত ও নির্বিকার। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর বড় খলিফার স্বীকৃতি পাওয়ার বিরল সম্মানের জন্য আমি আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞ। আমি এও বিশ্বাস করি, জনগণের দেওয়া এই সম্মানটি ইতিমধ্যেই ঐতিহাসিক সত্যের রূপলাভ করেছে। ক্ষমতাসীন ও বিরোধী জোটের কোনো শক্তিই ইতিহাস থেকে এটাকে মুছে দিতে পারবে না। এটা আমার কোনো অহমিকা বা দাম্ভিকতা নয়; এ ব্যাপারে আমি বদ্ধপরিকর যে, দায়সারাগোছের কোনো পদবির প্রণোদনা আমার কাছে পরিত্যাজ্যই হবে। এবং আমি বিশ্বাস করি, ইতিহাস আমার এই মানসিক প্রত্যয়বোধকেই একদিন সম্মান করবে।
এই নিবন্ধটি আজ আমার কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, আমি মনে করি বিষয়টির গুরুত্ব যত শিগগির ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব অনুধাবন করবেন, ইতিহাসের সুতীক্ষ্ন প্রশ্নবাণ থেকে ততই তারা পরিত্রাণ পাবেন। কারণ দেরিতে হলেও ইতিহাস তার প্রকৃত সত্যকেই প্রতিস্থাপিত করে।
লেখক : স্বাধীনবাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা।