অর্থনীতিই আমাদের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু অর্থনীতি বিষয়টা আমি একদম বুঝি না। সম্মানজনকভাবে মধ্যবিত্তের জীবনযাপন করার মতো অর্থ পেলেই আমি খুশি, এর নীতি নিয়ে মাথা ঘামাতে চাই না, পারিও না। কিন্তু ১ জুলাই মধ্যরাতে একটি খবর দারুণ আনন্দ দিল। বিশ্বব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় উন্নীত হয়েছে। এর ফলে কী হবে না হবে, আমার-আপনার লাভ কি, ক্ষতি কি- এসব বিবেচনা ছাড়াই দারুণ একটা ভালো লাগার আবেশ ছড়িয়ে গেল শরীর-মনজুড়ে। পরে জানলাম, এই আবেশটুকুই লাভ। এটা নিছকই মর্যাদার ব্যাপার। সেদিন রাতে এটিএন নিউজের স্ক্রলে গিয়েছিল 'স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্নআয়ের দেশে বাংলাদেশ : বিশ্বব্যাংকের মূল্যায়ন' এক প্রিয় বড় ভাই সেই স্ক্রলের ছবি তুলে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন, এরা জানেও না, জানার চেষ্টাও করে না। সেই বড় ভাইকে ধন্যবাদ দিয়ে ভুলটা শুধরে দিলাম। তবে তিনি যত কষ্ট করে ছবি তুলে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, তার চেয়ে অনেক কম কষ্টে আমাদের কাউকে একটা ফোন করতে পারতেন। আমরা তো না জেনে ভুল করি, ভুল করলেও তা স্বীকার করি। কিন্তু অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান আছে দিনের পর দিন ভুল করে, জেনেশুনে ইচ্ছা করে ভুল করে, আদালতে জরিমানা দেয়, নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করে; তাদের ব্যাপারে সেই বড় ভাইয়ের কোনো স্ট্যাটাস দেখি না। আত্দসমালোচনা করা যাবে না, এমন কোনো শর্ত সেই বড় ভাইয়ের নিয়োগপত্রে লেখা আছে কিনা তাও জানি না।
সেই বড় ভাইয়ের পরামর্শে জানার চেষ্টা করতে গিয়ে দেখলাম, বিশ্বব্যাংকের তালিকায় বাংলাদেশ আসলে নিম্নআয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় প্রমোশন পেয়েছে। আর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা বিশ্বব্যাংক করে না, করে জাতিসংঘ। সে তালিকায় বাংলাদেশ এখনো স্বল্পোন্নত দেশ। এরপরের ধাপ উন্নয়নশীল দেশ, এরপর উন্নত দেশ। সেই তালিকার কথায় পরে আসছি। যেটা নগদে পেয়েছি সেটার কথা আগে বলে নিই। মাথাপিছু আয়ের হিসাবে বিশ্বব্যাংকের বিবেচনায় বাংলাদেশ নিম্নআয়ের দেশ থেকে নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে প্রমোশন পেয়েছে। বিশ্বব্যাংকের এই তালিকায়ও তিনটি ধাপ আছে। নিম্নআয়, মধ্যম আয় এবং উচ্চ আয়। তবে মধ্যম আয়ের ধাপে দুটি ভাগ আছে- নিম্নমধ্যম আয় এবং উচ্চমধ্যম আয়। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের ধাপে ঢুকেছে, তবে সেটা নিম্নমধ্যম আয়ের। বিশ্বব্যাংকের হিসাবটা হলো, মাথাপিছু আয় ১০৪৫ ডলার পর্যন্ত হলে নিম্নআয়ের দেশ। ১০৪৬ ডলার থেকে ৪ হাজার ১২৫ ডলার পর্যন্ত নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ। ৪ হাজার ১২৬ ডলার থেকে ১২ হাজার ৭৩৬ ডলার পর্যন্ত উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। এরপর উচ্চ আয়ের দেশ। বাংলাদেশের হিসাবে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ১৩১৪ ডলার। আর বিশ্বব্যাংকের হিসাবে তা ১০৮০ ডলার। এখন বিশ্বে নিম্নআয়ের দেশ আছে ৩১টি, নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ ৫১টি, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ৫৩টি এবং উচ্চ আয়ের দেশ ৮০টি। প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় নাম লেখানোটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং অনেক মর্যাদার অর্জন এবং অনেক কষ্টকরও। কারণ আমাদের মানুষ বেশি। তাই মাথাপিছু আয় বাড়ানোও কঠিন। ১৬ কোটি টাকা আয় করলে মাথাপিছু পড়বে মাত্র এক টাকা। আবার উল্টাটাও সত্যি। মানুষই আমাদের সম্পদ। গার্মেন্ট খাতে এত উন্নতি সে তো সস্তা শ্রমের কারণেই। তবে এই বিশাল মানবগোষ্ঠীকে সত্যিকারের মানবসম্পদে বদলে দিতে পারলেই বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার গতি ত্বরান্বিত হবে। সবাই এক টাকা করে আয় করলেও ১৬ কোটি টাকা, এভাবেও তো দেখা যেতে পারে।
এবার আসি স্বল্পোন্নত দেশের কথায়। যত সহজে বিশ্বব্যাংকের তালিকায় নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে প্রমোশন পাওয়া গেছে, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণ তত সহজ নয়। কারণ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ হতে শুধু মাথাপিছু আয় নয়, বিবেচনায় নেওয়া হয় অর্থনীতির নাজুকতার সূচক, মানব উন্নয়ন সূচকও। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ যেভাবে এগুচ্ছে, তাতে হয়তো ২০২১ সাল, মানে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের উন্নয়নশীল দেশ হিসেবেই পালন করতে পারব।
নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ হলে আমাদের লাভ কি- এই প্রশ্ন ঘুরেফিরে আসছে প্রথম দিন থেকেই। অন্য লাভক্ষতির কথা যদি বাদও দিই, এটা মর্যাদার, বিশ্বের মানুষ এখন আর আমাদের দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাতে পারবে না। সংকটটা আসলে আমাদের দেশের মধ্যবিত্ত মানুষের সংকটের মতোই। আমাদের দেশের নিম্নবিত্ত মানুষেরা চলে অন্যের দয়া-দাক্ষিণ্যে, ঋণে-করুণায়। কিন্তু সেই পরিবারটিই যখন শিক্ষায় উন্নয়ন ঘটিয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, তখন বদলে যায় তার দৃষ্টিভঙ্গি। নিম্ন মধ্যবিত্তের সংকটটা বড় জটিল। ঘরে চুলা না জ্বললে পানি খেয়ে থাকবে, তবু কারও কাছে হাত পাতবে না। অথচ এই পরিবারটিই যখন নিম্নবিত্ত ছিল, তখন কারণে-অকারণে মানুষের সাহায্য নিয়েছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারও ঋণ নেয়, ঋণ তো উচ্চবিত্তরাও নেয়। তবে নিম্নবিত্তের কাউকে ঋণ দেওয়ার সময় তাতে করুণা, সহানুভূতি, বাড়তি সুবিধা বা ফিরে না পাওয়ার শঙ্কা মিশে থাকে। কিন্তু নিম্ন মধ্যবিত্তের বেলায় সেটা থাকে না। সবার সহানুভূতি হারানোর ঝুঁকি নিয়েও মানুষ নিম্নবিত্তের তকমা ঝেড়ে ফেলে নিম্ন মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত হতে চায়; চায় ধাপে ধাপে উন্নতি। বাংলাদেশও তেমনি। সুবিধা-অসুবিধা যাই হোক, আমরা বিশ্বে মর্যাদার সঙ্গে বাঁচতে চাই, মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই। কষ্ট করব, তবু কারও করুণায় চলব না। নিম্নমধ্যম থেকে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়াটা অনেক দূরের পথ। কারণ এখন আমাদের মাথাপিছু আয় বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ১০৮০ ডলার, সেটিকে ৪ হাজার ১২৬ ডলারে উন্নীত করা অনেক কঠিন। তবে আমাদের সামনে নিকট সম্ভাবনা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়া। তবে উন্নয়নশীল দেশ হতে হলে ঝুঁকিটা অনেক বেশি, চ্যালেঞ্জও অনেক বেশি। স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমরা নানা প্রটেকশন পাই, রপ্তানিতে কোটা, শুল্কমুক্ত নানা সুবিধা পাই। উন্নয়নশীল দেশ হলে আমরা সেসব সুবিধা পাব না। আমাদের তখন অনেক বেশি প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। মাথাপিছু আয় ১২০০ ডলার ছাড়িয়ে গেলে আমাদের ঋণের সুদ হবে ৫ শতাংশ, এখন যেটা আমাদের দিতে হয় দশমিক ৭৫ ভাগ। ঋণ পরিশোধের সময়ও তখন কমে যাবে। এত যে ঝুঁকি সামনে তাহলে কি আমরা উন্নয়নের গতি কমিয়ে দেব? স্বল্পোন্নতই থেকে যাব? আমি জানি বাংলাদেশের একজন মানুষও এতে সম্মত হবেন না। ঝুঁকি যতই হোক, আমরা সামনেই এগুতে চাই। প্রতিযোগিতা বাড়লে আমাদের সক্ষমতাও বাড়বে। ২০ বছর আগেও বাংলাদেশে যা স্বপ্ন ছিল, এখন তা দারুণ বাস্তব। মানুষের হাতে হাতে মোবাইল, ঘরে ঘরে ইন্টারনেট। দুনিয়াটাই যেন হাতের মুঠোয়। যেখানে যেতে আগে তিন রকমের যান লাগত, এখন সেখানে অনায়াসে গাড়ি নিয়ে চলে যাওয়া যায়। দুই বছর আগেও কেউ ভাবেনি নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের মুখের ওপর নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণকাজ শুরু করে আমরা দেখিয়ে দিয়েছি আমাদের সক্ষমতা। পদ্মা সেতু নির্মাণের পর এটি হবে আমাদের সক্ষমতা আর আত্দমর্যাদার প্রতীক। ঢাকায় এখন নানা ফ্লাইওভারের প্যাঁচ। এতকিছুর পরও প্রশ্ন থেকেই যায়। আমরা নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের তালিকায় পৌঁছেছি বটে, তবে এখনো দেশের ধনী আর গরিবের মধ্যে প্রবল বৈষম্য রয়েছে। দারিদ্র্যের হার কমেছে বটে, তবে এখনো দেশের প্রায় চারভাগের একভাগ মানুষ মানে চার কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। আমরা যতই নিম্নমধ্যম আয়ের দেশ বা উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম লেখাই না কেন, তাতে যত মর্যাদাই আসুক না কেন, সেই চার কোটি মানুষের তাতে কিছুই যায় আসে না। তাছাড়া সংখ্যার হিসাবে আমাদের অনেক উন্নতি হলেও এখন গুণগত মানেও উন্নতি করতে হবে। পাসের হার ৯০ ছাড়িয়ে গেলেই শুধু শিক্ষার মান বাড়ে না। আগে আমরা পাসের হারেও সন্তুষ্ট থাকতাম, এখন পাসের মানেও সন্তুষ্ট হতে চাই। সব ক্ষেত্রেই কোয়ানটিটির পাশাপাশি কোয়ালিটিও নিশ্চিত করতে হবে। উন্নয়নশীল দেশ হলেই আমাদের দিকে সবার তাকানোর দৃষ্টিটাই বদলে যাবে। রাস্তায় অসহনীয় যানজট, নোংরা আবর্জনা, গার্মেন্ট শিল্পে কাজের পরিবেশ, শ্রমিকদের অধিকার, মানবাধিকার- এসব প্রশ্নে আমরা তখন কোনো ছাড় পাব না। আমরা ছাড় চাইও না।
আগেই বলেছি দৃষ্টিভঙ্গির কথা। আগের সরকার নাকি নানা সুবিধা পেতে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাতেই থাকতে উন্নয়নের গতি কমিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু বর্তমান সরকার যে কোনো মূল্যে উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। এই সরকারের বিরুদ্ধে আমার অনেক অভিযোগ- দেশের গণতন্ত্রহীনতা, নির্বাচন ব্যবস্থা প্রায় ধ্বংস করে দেওয়া, দুর্নীতি, সুশাসনের ঘাটতি, মানবাধিকারের অভাব ইত্যাদি ইত্যাদি। তবু আমাদের আত্দমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দেওয়ায়, তলাবিহীন ঝুড়িকে সমৃদ্ধির সোপানে তুলে নেওয়ায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন।