পাড়ায় বা রাস্তা-ঘাটে বখাটে ছেলেদের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়নি, এমন কিশোরী বাংলাদেশে বোধহয় কমই আছে। গ্রাম আর মফস্বলের অবস্থা শুনেছি ভয়াবহ। কত কিশোরীর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেছে এদের যন্ত্রণায়, কত কিশোরীকে স্কুল না পেরোতেই বিয়ে দিয়ে দেয়া হয়েছে, কত মেয়েদের শুধুমাত্র এদের হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্যই বোরকার নীচে লুকোতে হয়েছে, তার ইয়ত্তাও নেই। আমার ধারণা বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব হবে না, যদি না এই সব বখাটেদের নিয়ন্ত্রণ করা না যায়।
বখাটেদের পাল্লায় পরে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়া একটি মেয়ে সেদিন কেঁদে কেঁদে আমাকে বলছিল তার দুঃখের কাহিনী। বোরকা পরে কলেজে গিয়েও বেচারির শেষ রক্ষা হয়নি। এক পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বোরকার ঢাকনি কয়েক ঘণ্টার জন্য তোলার চরম মাশুল দিতে হয়েছে ওই ফুটফুটে মেয়েটিকে। বখাটের উৎপাতে অতিষ্ট হয়ে প্রথমে কলেজ বন্ধ, তারপর পরীক্ষার আগে আগে অচেনা এক বয়স্ক পুরুষের সাথে বিয়ে। মেয়েটিকে বললাম পড়াশুনা চালিয়ে যেতে, আমি তার পাশে থাকব। মেয়েটির কান্না তবু থামছিল না। তখন তাকে বহু বছর আগে আমার দেখা কিছু ঘটনা বলেছিলাম।
বলেছিলাম, আমাদের কৈশোর বেলায়ও পাড়ার বখাটে ছেলেদের উৎপাত ছিল। রাস্তার ধারে ল্যাম্পপোস্টের গায়ে হেলান দিয়ে এরা সিগারেট ফুকতো, মিঠুন চক্রবর্তীর মত লম্বা লম্বা চুল কায়দা করে ঝাঁকিয়ে, ঘাড় ইষৎ বাঁকা করে এরা মেয়েদের দেখত। আর যারা আরের্কটু ‘সাহসী’, তারা আবার বিভিন্ন রকম কমেন্টস করত।
তখন তো ফেসবুক চালু হয়নি, তাই বেচারাদের কষ্ট করে সারাদিন রাস্তায় দাড়িয়ে থেকে মেয়েদের উত্তক্ত করা ভিন্ন গত্যন্তর ছিলনা। স্বভাবে এরা ‘রাস্তার ছেলে’ হলেও, বাস্তবে এরা ছিল এলাকার ‘বড়লোক’ ব্যবসায়ী (পড়ুন স্মাগলার/ঠিকাদার)-এর বখে যাওয়া ছেলেপিলে।
যাহোক, আমরা আর আমার খালারা পাশাপাশি বাড়িতে থাকতাম। খালাত বোন তিন জন, আর আমরা দুই বোন — পরিবারে এই পাঁচটি মেয়ে। বড় দুই বোন কলেজে আর আমরা তখন স্কুলে (আমি ক্লাস সিক্স বা সেভেনে)। আমার ছোটবোন একদমই ছোট। আমরা বোনরা তো বটেই, এইসব বখাটেদের হাত থেকে আমাদের ছোট ভাইগুলোও রেহাই পেতো না, ওদেরকেও বিভিন্ন রকম টিটকিরি শুনতে হতো, যেহেতু ওদের কিশোরী বোন রয়েছে সেই অপরাধে।
তখনও রাস্তায় বেশি রিক্সা বা গাড়ি চলত না, তাই বিকেলের দিকে আমরা সাইকেল চালাতাম। দেখা গেল বখাটেরাও সাইকেল চালনায় উৎসাহী হয়ে উঠেছে। সুতরাং আমাদের সাইকেল চালানো বন্ধ। আমরা ছাদে গেলে ওরাও ওদের বাড়ির ছাদে ওঠে, সুতরাং আমাদের ছাদে ওঠাও বন্ধ। এরপর দেখা গেল বারান্দায় যাওয়া যায় না, জানালার পাশে যাওয়া যায় না, ফোন ধরা যায় না– এই অবস্থা। আমাদের আর খালার বাড়ির মাঝে একটা খালি প্লট ছিল, যেখানে এখন আমাদের বাড়ি। জায়গাটা উচু দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হলো। তখন আমরা ওখানে শান্তি মত ব্যাডমিন্টন খেলতে পারতাম। দেখা গেল সরস্বতী তেমন সহায়তা না করলেও লক্ষ্মীদেবীর কৃপায় এক বখাটের বাবা অতি দ্রুত একখানা পাঁচ তলা বাড়ি তুলে ফেললেন, এবং অচিরেই এলাকার যাবতীয় রোমিও ওই বাড়ির ছাদকে তীর্থস্থান বানিয়ে দুরবিন সহযোগে সকাল বিকাল পুণ্য কামাই করতে লাগলো। সুতরাং আমাদের খেলাধুলাও বন্ধ। আমার একটা জার্মান শেফার্ড কুকুরছানা ছিল, নাম স্পিনা, অনেক ভালবাসতাম ওকে। একদিন বখাটেরা ওকে তুলে নিয়ে গেল, আর ফেরৎ পাওয়া যায়নি।
আরেকবার বন্যার পানিতে ঢাকার অর্ধেক তলিয়ে গেল, আমাদের সেকি আনন্দ! আমরা ভাই-বোনরা পাশের এলাকায় বেড়াতে গেছি, পিছু নিল বখাটের দল। আমরা একটা নৌকায় উঠেছি, আরেকটি নৌকায় উঠলো ছেলেগুলো। হঠাৎ দেখি কয়েকটি ছেলে তাদের নৌকা থেকে পানিতে ঝাঁপিয়ে পরে সাঁতরে আসছে আমাদের দিকে। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের বিচক্ষণ মাঝি চট-জলদি নৌকা তীরে ভেড়ালো। পরে শুনেছি, ওদের প্লান ছিল আমাদের নৌকা ডুবিয়ে দেবার। আমরা ভাই বোনরা কেউ সাঁতার জানতাম না। সেদিন নৌকা ডুবিয়ে দিলে আমরা কেউ আজ বেঁচে থাকতাম না।
এবার অতীত থেকে বর্তমানে আসি। আমরা ওই এলাকারই স্থায়ী বাসিন্দা। এখনো খালার বাড়ি আর আমার বাবার বাড়ি ওখানেই। ওই সেই প্রাক্তন রোমিওবৃন্দও কিন্তু ওই একই এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা, এবং আমাদেরই নিকট প্রতিবেশী। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখন তাদের আমরা কখনো দেখতে পাই না।
কেন দেখতে পাই না, তার কারণটি আমি খুঁজে বের করেছি। ক্ষমা করবেন যদি শুনতে খারাপ শোনায়। আমাদের সেই পাঁচ বোনের মধ্যে আমরা চারজনই থাকি দেশের বাইরে। আমরা বোনেরা কিন্তু বৈবাহিক সূত্রে বিদেশে যাইনি, আমরা নিজ নিজ যোগ্যতা এবং কর্মসুত্রেই বিদেশে থাকি। আমার কাজিন, যাকে বড়’পা বলি, কমনওয়েলথ স্কলারশিপ পেয়ে কানাডায় পিএইচডি করেছেন, এখন অস্ট্রেলিয়া সরকারের চাকরি করছেন। মেজ’পা ডাক্তার, জাতিসংঘের একটি সংস্থায় আছেন, এখন পোস্টিং নেপালে। ছোটাপা স্থপতি, বুয়েটের শিক্ষক ছিলেন। এখন বিদেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। এরপর আমি অভাজন। আমার ছোটবোন দেশে থাকে, সেও ডাক্তার হয়েছে, একটি মেডিকেল কলেজে পড়ায়।
আমাদের কৈশোর-এর আনন্দ কেড়ে নেয়া সেইসব রোমিও ভায়েরা শুনেছি কেউ পাড়ার লন্ড্রির দোকান চালায়, কেউ ফোন-ফ্যাক্স এর দোকান। কেউ আবার নিজে কিছুই করেনা, বাবার করে দেয়া বাড়ির ভাড়া তোলে আর পান খায়, বিড়ি ফোঁকে। এরা আজ আমাদের সামনে আসতে লজ্জা পায়। একদিন যে রাস্তায় তাদের ভয়ে আমাদের চলাচল থেমে গিয়েছিল, সেখানে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেলে তারা আজ আমাদের পথ ছেড়ে দিয়ে ঘুপচিতে লুকিয়ে পরে, চোখ নামিয়ে ফেলে।
আমি সেই ভয় পাওয়া, কাঁদতে থাকা মেয়েটিকে এই গল্পটিই বলেছিলাম। বলেছিলাম, যারা মেয়েদের উত্যক্ত করে, তারা বেশি দূর যাবে না। হয়ত পয়সাওয়ালা হবে, বড়জোর নেতা-ফেতা হবে, অমুক ভাই তমুক ভাই হবে, ‘বস’-ও হতে পারে, কিন্তু ভদ্রলোক হবে না। বলেছিলাম, নিজেকে এমনভাবে গড়ে তোল, যাতে যে রাস্তায় তোমাকে ওরা উত্যক্ত করত, ওই রাস্তা একদিন তোমারই হয়, যেন ওই রাস্তায় মুখোমুখি হয়ে গেলে তোমাকে দেখে ওদের মাথা হেঁট হয়ে যায়, যেন ওদের সটকে পড়তে হয়।
মেয়ে, তুমি নিজেকে তেমন করেই গড়ে তোল।
শাহনাজ গাজী: পেশাদার কূটনীতিক, চীনের কুনমিংয়ে বাংলাদেশের কনসাল জেনারেল।
বিডি-প্রতিদিন/ ৩০ জুলাই, ২০১৫/ রশিদা