'এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান'। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করার প্রাসঙ্গিকতা হলো এই যে- চিন্তা-চেতনা মানসিকতার যোজন যোজন মাইল দূরত্ব সত্ত্বেও অনেকটা মননশীলতার গভীরে মিল খুঁজে পাই। মন ও মননশীলতার আঙ্গিক, চেতনার গভীরে অবহেলিত, প্রবঞ্চিত, অধিকারহারা মানুষের জন্য একটা গভীর মমত্ববোধ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে অকুতোভয় ও প্রতিবাদের প্রত্যয়বোধে উজ্জীবিত সত্তা রাজনীতিকের সঙ্গে যারা কবি-সাহিত্যিক, সংস্কৃতিমনা (যারা বিবেকবর্জিত স্তাবক, মোসাহেব নন), তারা রাজনৈতিক চেতনার আঙ্গিকের বাইরে একটা আবেগমিশ্রিত অনুভূতির জগতের অধিবাসী। তাই ভিন্ন ভিন্ন মতাবলম্বী এ গোষ্ঠীরা ক্ষমতায় পদাসিক্ত না হয়েও ইতিহাসে একদিন বরেণ্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকেন।
এখন মূল প্রতিপাদ্যে আসা যাক। আমার বহু নিবন্ধে আমি অসংখ্যবার উল্লেখ করেছি, সুপরিকল্পিতভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমণের স্থপতি ছিলেন বঙ্গবন্ধু, বাস্তবায়নের মূল কারিগর ছিল ছাত্রলীগ। স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু ও ছাত্রলীগ একটি আরেকটির পরিপূরক, একটি অদৃশ্য রাখিবন্ধনে বাঁধা। একটা দুর্জয় শক্তির প্রজ্বলিত দৃষ্টান্ত। বঙ্গবন্ধুও বারবার সগর্বে উচ্চারণ করতেন, 'ছাত্রলীগের ইতিহাস স্বাধীনতার ইতিহাস'। এবারে অনুষ্ঠিত ছাত্রলীগের সম্মেলনে ক্ষমতাসীন নেত্রী সেই সত্যটি বিলম্বে হলেও প্রকাশ্যে উচ্চারণ করায় অনেকের মতো আমিও বিশ্বাস করতে চলেছিলাম, অবক্ষয়ের অতলান্তে নিমজ্জিত ঘনঘোর অমানিশার মধ্যে নিক্ষিপ্ত ছাত্রলীগের সব অর্জন ও গৌরবের ইতিহাস বিস্মৃত এবং নামে-বেনামে ব্যক্তিস্বার্থের হলাহল পান করে সামাজিকভাবে অচ্যুত পরিবেশ থেকে টেনে বের করে তাদের সূর্যস্নাত, অকুতোভয় তেজোদ্দীপ্ত অবয়বে প্রতিষ্ঠিত করার সর্বাত্মক চেষ্টায় তিনি ব্যাপৃত হবেন। শুধু ইঙ্গিত নয়, তার ভাষণে এটি ব্যক্তও হয়েছিল। এটাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবার অবকাশও কম ছিল। তাই ছাত্রলীগের শুভাকাঙ্ক্ষী, শুভানুধ্যায়ীদের মনে ক্ষীণ হলেও একটা ইতিবাচক আশাবাদ প্রতিস্থাপিত হয়েছিল, ছাত্রলীগ মেধাবী, প্রগতিশীল, অকুতোভয় নেতৃত্বের মাধ্যমে ধীরে ধীরে তার অতীতের সোনালি ঐতিহ্যের আদলে নির্মিত হবে। কিন্তু নেতৃত্ব ঘোষণার অব্যবহিত পরে ইথারে ভেসে আসা ছাত্রলীগের অসংখ্য ত্যাগী নেতা-কর্মীর দীর্ঘ নিঃশ্বাসই শ্রুত হলো। যোগ্যতা-অযোগ্যতার প্রশ্নে আমার বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা আমি দেব না। তার কারণ সর্বজনজ্ঞাত। ইতিমধ্যে আমি যে কথাটি অবহিত হয়েছি সেটি হলো, কোটারি বা সিন্ডিকেটের আবর্তের বাইরে থেকে বা উলি্লখিত সিন্ডিকেটের আশীর্বাদপুষ্টদের বাইরে থেকে নেতৃত্ব পাওয়াটা এখনো দুঃস্বপ্নেরই নামান্তর বলে তারা মনে করছেন। অসংখ্য নেতা-কর্মী যে প্রত্যয়, প্রতীতি, মননশীলতা ও মানসিকতা নিয়ে সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত উর্মিমালার মতো সম্মেলনে সমবেত হয়েছিলেন, তারা হতাশার নির্দয় দহনে দগ্ধিভূত হয়েছেন।
আমি হতাশাবাদীদের পক্ষে নই। সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত না হলেও ছাত্রলীগের সফলতা আমাকে উজ্জীবিত করে, এর সুনাম আমাকে গৌরবান্বিত করে। ঠিক তেমনি এদের মূল্যবোধের অবক্ষয়ে ডুবতে দেখলে আমার বুকের পাঁজরটা টনটন করে ওঠে। একটা যন্ত্রণার ঢেউ আমার অনুভূতির সৈকতে নির্মমভাবে আঘাত করে। এত অভিযোগ শোনার পরও আমি ইতিবাচকভাবে নতুন নেতৃত্বকে প্রত্যয়দৃঢ় চিত্তে এ কথাটি শোনাতে চাই, তোমরা রাজনৈতিক সংগঠনের অঙ্গসংগঠন হইও না, বরং বর্তমান অবরুদ্ধ অবস্থার প্রাচীর ভেঙে তোমরা বেরিয়ে এসো। তোমাদের পূর্বসূরিরা বাঙালি জাতীয় চেতনার উন্মেষ, বিকাশ, ব্যাপ্তি ও সফলতার সূর্যস্নাত সৈনিক। তাদের রাজনীতির উপাদান ছিল আদর্শ এবং একান্তভাবেই আদর্শ। ব্যক্তিস্বার্থ, নেতিবাচক ধারণা, কী পেলাম, এটি তাদের চিন্তার আবর্তে কখনো আসেনি। বরং দেশকে কী দিতে পারলাম, কতটুকু দিতে পারলাম- শুধু এ চেতনাটি মরুভূমির নিষ্কলুষ সূর্যোদয়ের মতো তাদের চিত্তকে উদ্ভাসিত করত। স্তাবকতা, স্তুতি, বন্দনা, ভর্তিবাণিজ্য, হলে আসন বরাদ্দ, টেন্ডারবাজি এবং নানারকম অনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তোমাদের পূর্বসূরিদের কোনোরকম পরিচিতিই ছিল না। আর ছিল না বলেই তারা আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত ৬ দফাকে জাতির মুক্তিসনদ হিসেবে গ্রহণ করে সারা বাংলাদেশে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার সোপান অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছিল। ডান, বাম সব রাজনীতি যখন ৬ দফার প্রচণ্ড বিরোধিতা করছিল তখন ছাত্রলীগই এ মাটি ও মানুষের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের বন্ধনটি তৈরি করে। আজকে যারা নৌকায় চড়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়েছেন, আজকে যারা ক্ষমতাসীন নেতৃত্বের চারপাশে শুধু পরিবেষ্টিতই নন, অক্টোপাসের মতো গ্রাস করেছেন, যারা একদিন আমাদের মুজিব ভাই ও তাঁর প্রাণপ্রিয় সংগঠন ছাত্রলীগকে সিআইর দালাল, ভারতের অনুচর, সংকীর্ণতাবাদী এমনকি তার চামড়া দিয়ে জুতা বানানো, হাড্ডি দিয়ে ডুগডুগি বানানোর মতো স্পর্ধিত উক্তি করতে দ্বিধাবোধ করেননি, তাদের স্পর্ধিত উক্তির জবাবেই শুধু নয়, বাঙালির জাতীয় চেতনাকে রাজনীতির শাণিত অস্ত্র হিসেবে প্রস্তুত করার জন্য তোমাদের পূর্বসূরিদের সারা দেশে চারণ কবির মতো গাইতে হতো- 'এ মাটি আমার সোনা, আমি করি তার জন্মবৃত্তান্ত ঘোষণা', 'সে কবির বাণী লাগি কান পেতে আছি, যে আছে মাটির কাছাকাছি', 'বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর'।
আমাদের মুজিব ভাই ৬ দফা আন্দোলনের অগ্রদূত, হিমাচলের গিরিশৃঙ্গমালার মতো মাথা তুলে, মেরুদণ্ড খাড়া করে বলতেন, 'বুকের সব রক্ত উজাড় করে দেব, ৬ দফার একটি দাঁড়ি-কমার প্রশ্নেও আপস করব না।' ৭ মার্চে তার বজ্র নির্ঘোষিত ঘোষণা ছিল, 'আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, বাংলার মানুষের মুক্তি চাই'। তার হৃদয় থেকে উৎসারিত এ চেতনার আঙ্গিক ছিল তোমাদের পূর্বসূরি ছাত্রলীগ। বঙ্গবন্ধুর শক্তি, সাহস, উদ্দীপনা ও প্রেরণা সবটুকুরই কেন্দ্রবিন্দু ছিল ছাত্রলীগ।
ছাত্রলীগই বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে সত্তরের নির্বাচনের আগে সশস্ত্র বিপ্লবের ডাকের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে বাংলার আপামর মানুষের কাছে একক নেতৃত্ব হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে প্রতিস্থাপিত করতে সক্ষম হয়েছিল। তোমাদের পূর্বসূরিরা ছাত্রলীগের একক নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে পেরেছিল বলেই সব প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর চূর্ণবিচূর্ণ করে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অপ্রতিরোধ্য গণআন্দোলনের মাধ্যমে এমন একটি বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল, পাকিস্তানিদের কুটিল ষড়যন্ত্র ও ২৫ মার্চের পৈশাচিক সামরিক আক্রমণকে বাঙালি জাতি প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। পৃথিবীর ইতিহাসে একটি স্বাধীনতা আন্দোলনে জনগণকে সম্পৃক্ত করে গতানুগতিক সামরিক যুদ্ধে নয়, বাংলার জাগ্রত জনতার জীবনবাজি রাজনৈতিক প্রতীতির লড়াইয়ে বিজয়ী হয়েছিল।
সুপ্ত নির্লিপ্ত বিবেককে জাগ্রত করার জন্য তোমাদের আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি জন্মের পর থেকে এই বাংলার সব রাজনৈতিক অর্জনের সঙ্গে ছাত্রলীগ সবচেয়ে অগ্রণী ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে। জিন্নাহর উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর স্পর্ধিত উক্তির বিরোধিতা করেছিলেন তোমাদেরই পূর্বসূরি তৎকালীন ছাত্রলীগের আহ্বায়ক মঈনুদ্দীন আহমদ। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয় তার পুরোধা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও মওলানা ভাসানী (উদ্যোক্তা ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী)। শেরে বাংলার মতো বলিষ্ঠ নেতৃত্বকে এর সঙ্গে সংযুক্ত করার ক্ষেত্রে ওই সময় ছাত্রলীগ বিশাল ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। সেই নির্বাচনে খালেক নেওয়াজ, মরহুম কামরুজ্জামানসহ অনেক ছাত্রলীগ নেতা যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন লাভ করেন ও বিজয়ী হন। ৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যার নির্দেশে মিছিলের ওপর গুলিবর্ষিত হয়, সেই মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনকে ছাত্রলীগ নেতা খালেক নেওয়াজ নির্মমভাবে পরাজিত করেন। '৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর রাজনৈতিক নেতাদের EBDO করা হলেও ছাত্রলীগ সন্তর্পণে তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত রাখে। '৬১ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হলে শিক্ষা আন্দোলনের আড়ালে সামরিক শাসন প্রত্যাহার ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তির মূল প্রবক্তা ছিল ছাত্রলীগ।
তারই উত্তরাধিকারিত্বের আলোকচ্ছটায় তোমাদের চিত্ত হোক, এটা আমি আল্লাহর কাছে কামনা করি। তোমরা কেন রাজনৈতিক সংগঠনের লেজুড়বৃত্তি করবে। আমি আগেও বলেছি, আজও পুনরাবৃত্তি করছি- সেদিনের লড়াই ছিল রাজনৈতিক। রাজপথের বজ্র নির্ঘোষিত স্লোগান মানুষের মননশীলতাকে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত করেছিল। আজকের ছাত্রসমাজের চেতনার আঙ্গিক ভিন্ন। আজকে তাদের জ্ঞানসমৃদ্ধ, আদর্শের সূর্যস্নাত সৈনিক হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। আর তার জন্য প্রথম প্রয়োজন- মন ও মননশীলতা, নিষ্কলুষতা, আত্মসিদ্ধ চিত্তের বিকাশ। রাজপথের মিছিল নয়, মোসাহেবি, অর্চনা, বন্দনা নয়; আজকের রাজনীতির প্রতিপাদ্য বিষয় হওয়া উচিত আদর্শচিত্ত, জ্ঞানগরিমায় ভরপুর একটি নতুন প্রজন্মের বিকাশ। তোমাদের চক্ষু উন্মোচিত করে দেখতে হবে, যারা তোমাদের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে, তাদের সন্তানেরা তোমাদের মতো মিছিলে হাঁটে না, বিদেশে পড়াশোনা করে। আর তোমরা তাদেরই ক্রীড়নক হয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হও! ছাত্র রাজনীতিকে এ দৈন্য থেকে বের করে শিক্ষাঙ্গনের পরিমণ্ডলকে বিশুদ্ধ করার দায়িত্ব তোমাদের, ছাত্রলীগের। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো তোমাদের হৃদয়ে ধ্বনিত হোক- 'চির উন্নত মম শির'। স্তাবকতার প্রাচীর ডিঙিয়ে সত্য ও আদর্শের অনুগামী হও। তোমাদের প্রতিজ্ঞা হোক- 'সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম'।
তোমাদের জন্য আল্লাহর কাছে এ আমার ফরিয়াদ, তোমরা আগ্নেয়গিরির গলিত লাভার মতো প্রজ্বলিত হয়ে সব নৈতিকতাবিরোধী দুর্নীতি, দুর্বিচার, অগণতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারী মানসিকতার আবর্জনাকে পুড়িয়ে ভস্মীভূত করার উদ্যোগ নাও। ইনশাল্লাহ, পূর্বসূরিদের মতোই তোমরাও গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত হবে। এ মৌনশপথ হৃদয়ে ধারণ করে তোমরা প্রাণের স্বদেশকে বাসযোগ্য করে তোলার লক্ষ্যে ব্রতী হও- 'চলে যাব তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ/ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাবো জঞ্জাল'।
লেখক : স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের অন্যতম নেতা