বিএনপিতে পরিচিত বন্ধু-বন্ধুবররা আমার একটা লেখা নিয়ে বেশ অসন্তুষ্ট হয়েছেন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে বেড়াতে এসেছেন আমাদের এক বড় ভাই আতিকুর রহমান সালু। পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সর্বশেষ সভাপতি তিনি। একজন মুক্তিযোদ্ধাও বটে। তার আরও একটা পরিচয় তার দেশপ্রেমেরই সৌরভ ছড়ায়। সুদূর আমেরিকায় থেকেও দেশের কথা ভাবেন। ফারাক্কার 'নীল দংশনে' উত্তরবঙ্গের বিবর্ণ চেহারা সেখানেও তাকে কাঁদায়। সমমনা বন্ধুদের নিয়ে ফারাক্কা বাঁধের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়ার লক্ষ্যে তৈরি করেছেন 'আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি।' তিনি সে কমিটির চেয়ারম্যান। বললেন, আমেরিকায় বসেও তিনি আমার লেখা পড়েন অনলাইনে। শুনে ভালো লাগল। কিন্তু একটু পরেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। তিনি এখন আবার বিএনপির অনুরাগী। দেশে এলেই ম্যাডাম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করেন। বিএনপি নিয়ে আমার সাম্প্রতিক কিছু লেখার ওপর আলোচনা করে একপর্যায়ে বললেন, আমার একটা লেখা নাকি তিনি মিস করেছেন; শুনেছেন তাতে আমি নাকি বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে বাদ দিয়ে বিএনপি করতে বলেছি। অনেকটা কৈফিয়ত চেয়েই বললেন, আমি সরকারি এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছি কেন? দেশেও কিছু বন্ধু একই ধরনের অভিযোগ করেন লেখাটা না পড়েই। বুঝলাম, লেখাটা যত পাঠক পড়েছেন, তা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি প্রচার হয়েছে তার চেয়ে বেশি।
দেশের রাজনীতি এবং রাজনৈতিক দল সম্পর্কে মূল্যায়নের ব্যাপারে কারও কারও মধ্যে একটা ধারণা আছে যে, রাজনীতিবিজ্ঞানে অগাধ পাণ্ডিত্য ছাড়া বুঝি এ কাজটা করা যায় না। সেদিক বিবেচনা করলে তো আমাদের মতো 'কলম শ্রমিক'দের এ বিষয়ে কলমই ধরা উচিত নয়। আমি এ ধারণাটার সঙ্গে মোটেও একমত নই। রাজনীতি একটি বিশেষ কর্ম, তবে বিশেষায়িত কোনো বিষয় নয়। সমাজ, রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণ চিন্তা এবং সে চিন্তা বাস্তবায়নের জন্য সততা ও ত্যাগের মনোভাব নিয়ে আত্দনিবেদন করার নামই রাজনীতি বলে আমার ধারণা। বিদ্বান, পণ্ডিত হলে বাড়তি সুবিধা আছে; কিন্তু তা না হলে রাজনীতি করা যবে না বা বোঝা যাবে না- তা সত্য নয়। আবার বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের ওপর নির্ঘুম গবেষণা করে ডক্টরেট ডিগ্রি হাসিল না করলে কিংবা ওই দলের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে জড়িত থেকে বড় পদ-পদবির অধিকারী না হলে ওই দল সম্পর্কে বলা যাবে না, লেখা যাবে না তেমনও মনে করি না। বিদ্বান-অবিদ্বান নির্বিশেষে চোখ-কান খোলা অনুসন্ধিৎসু যে কোনো মানুষই দেশের রাজনীতি, এর প্রকৃতিসহ বিশেষ বিশেষ দল বা দলসমূহ সম্পর্কে অবশ্যই বলতে পারেন, লিখতে পারেন। আমি আপনিও পারি। আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে কারও এখন সাংগঠনিক সম্পর্ক আছে কি নেই সেটা বড় কথা নয়; আগ্রহ আছে কিনা সেটাই বড় কথা। সে আগ্রহ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বা নিঃস্বার্থও হতে পারে। ৩০ জুলাই দৈনিক যুগান্তরে 'সিন্ডিকেটকবলিত ছাত্রলীগের গন্তব্য কোথায়' শিরোনামে আমার একটা লেখা প্রকাশিত হয়েছে। আওয়ামী ঘরানারই কেউ কেউ লেখাটি 'নির্মোহ' লেখা বলে প্রশংসা করেছেন, আবার দুয়েকজন অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় বলেছেন, ছাত্রলীগ সম্পর্কে লেখার ও 'জ্ঞান দেওয়ার' উনি কে? বাংলাদেশ প্রতিদিনে 'খালেদা-তারেক ছাড়া বিএনপি কি চলতে প্রস্তুত' লেখাটা নিয়েও তেমন সমালোচনার মুখে পড়েছি। কিন্তু যে সব বন্ধু সমালোচনামুখর, তাদের যখন জিজ্ঞাসা করি, লেখাটা কি পড়েছেন? তখন জবাব পাই, না পড়লে কি হবে, শুনেছি। তখন একটা কথা আমার মনে পড়ে যায়। আমি তখন দৈনিক দিনকালের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী তখনো বিএনপি করতেন। তারেক রহমান দলের নেতৃত্বে না এলেও আস্তে আস্তে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছেন। সাকা চৌধুরীকে নিয়ে দলে বিতর্ক ছিল শুরু থেকেই। মুক্তিযুদ্ধকালে তার বিতর্কিত ভূমিকা কারও অজানা ছিল না। শাহ আজিজুর রহমানের সঙ্গে সাবেক মুসলিম লীগ থেকে যোগদানকারী মুষ্টিমেয় লোক ছাড়া দলে তাকে পছন্দ করার লোক ছিল না। তার চট্টগ্রামে অনেক ভক্ত বলে যা প্রচার করা হতো, তা নিতান্তই গালগল্প। তবে তার টাকার জোর ছিল। টাকায় কী না হয়! বিএনপিতে সাকার ক্ষেত্রেও টাকাই বোধহয় কথা বলেছে। কিন্তু বিপদে পড়ে গেলেন অভ্যাস দোষে বেফাঁস এক মন্তব্য করে। বললেন, 'আগে জানতাম কুকুর লেজ নাড়ায়, এখন দেখি লেজ কুকুর নাড়ায়'। কুকুর ও লেজ বলতে তিনি বেগম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে 'মিন' করেছিলেন। তার আগে বেগম জিয়া সম্পর্কে আরও কিছু বাঁকা কথা বলেছিলেন উদ্ধত সাকা চৌধুরী। বেগম জিয়া ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখেছেন। কিন্তু 'কুকুর ও লেজ' বিষয়ক তত্ত্বের পর আর সহ্য করা হলো না। তাকে বহিষ্কার করা হলো দল থেকে। তার বহিষ্কারের পর আমি দৈনিক দিনকালে একটি মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছিলাম স্ব-নামে। সম্ভবত শিরোনাম ছিল, 'সাকা চৌধুরীর বহিষ্কার, অতঃপর'। তখন থেকেই আওয়ামী লীগ এবং তাদের নামধারী বাম মিত্ররা বিএনপিকে মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক বলে তুমুল প্রচারণা চালিয়ে আসছে। লেখাটির এক জায়গায় আমি লিখেছিলাম, 'সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে বিএনপি থেকে বহিষ্কারের পর দলটির বিরুদ্ধে মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক বলে যে প্রচার বা অপপ্রচারটি আছে তা আর হালে পানি পাবে না।' দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে এক বৈঠকে একজন খুব প্রভাবশালী সিনিয়র নেতা দিনকালের ওই লেখাটির 'মৌলবাদের পৃষ্ঠপোষক' শব্দ দুটি মার্কার দিয়ে চিহ্নিত করে ম্যাডামকে দেখান এবং বলেন, আমি নাকি বিএনপি জামায়াতকে পৃষ্ঠপোষকতা করছি এবং জামায়াতকে মৌলবাদ বলে ক্ষেপিয়ে দেওয়ার জন্য দলের মুখপত্র দৈনিক দিনকালে তা লিখেছি। ওই নেতাকে আমি সম্মান করতাম, এখনো করি। কিন্তু বিশেষ একটি কারণে তিনি চাইতেন না আমি 'দিনকালে' ওই পজিশনে থাকি। তিনি যে জামায়াতপ্রিয় তাও নয়। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া তখন বিএনপির মহাসচিব। তিনিও ছিলেন সে বৈঠকে। বগুড়ার হেলালুজ্জামান তালুকদারের ছেলে জয় তখন হাওয়া ভবনের কর্মচারী। সে আগে দিনকালের সাধারণ বিভাগের এক 'অসাধারণ' কর্মচারী ছিল। তার ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ সম্পর্কে অবহিত হয়ে তারেক রহমান তাকে দিনকাল থেকে সরিয়ে নেন। সে আমার মোবাইল ফোন নম্বর জানত। ম্যাডামকে ধরিয়ে দিল। আর যাই কোথায়! একনাগাড়ে পাঁচ-ছয় মিনিট বকলেন। জানতে চাইলেন কেন আমি জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক নষ্ট করতে চাইছি। আমার কোনো কথাই শুনতে চাইলেন না। বুঝলাম দিনকালে আমার দিন শেষ। তারেক রহমান তখন ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরে। বাইরে গেলেও ২-১ দিন পরপর দিনকালের খবর নিতেন। পত্রিকার দেখভাল করতেন তিনিই। আমার কি ভাগ্য, ওই রাতেই তিনি ফোন করলেন। তাকে ঘটনাটা জানালাম। তিনি লেখাটা সম্পর্কে জেনে নিয়ে সে রাতেই ম্য্যাডামের সঙ্গে কথা বলেন। ম্যাডামের ভুল ভাঙে। তারেক রহমান বেশ হিউমার করতে জানেন। দেশে ফেরার পর একদিন আমাকে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে কিনা জানতে চেয়ে বলেন, আপনাকে ওই 'বকাঝকা রজনীতে' আপনার সাবেক নেতাও তো ওখানে ছিলেন। তিনি কিছু বললেন না কেন? আমি বুঝলাম, তিনি মান্নান ভাইর কথা বলছেন। আমি বললাম, তিনি কিছু বলার সুযোগ পেলে তো! ঘটনাটা উল্লেখ করলাম ওই কারণে যে, ম্যাডাম যদি আমার পুরো লেখাটা আগে পড়ে দেখতেন বা তাকে লেখাটা পড়তে দেওয়া হতো, তাহলে ওই রাতে অকারণে বকাটা খেতাম না।
আমি বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে বিএনপি থেকে মাইনাস করার কথা বলিনি। একজন সংবাদকর্মী ও কলাম লেখক হিসেবে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান-বুদ্ধি অনুযায়ী দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগ সম্পর্কে আমার পর্যবেক্ষণ পাঠকদের সামনে তুলে ধরি। আমার বক্তব্য-মন্তব্যের সঙ্গে সবাই একমত হবেন এমন কোনো কথা নেই। কিন্তু আমি, আপনি, আমরা কথা বলতে তো পারি, আমাদের বলতে তো দেওয়া উচিত। বিএনপি প্রকৃত অর্থেই বর্তমানে একটি মহাসংকটকাল অতিক্রম করছে। এ বছরের প্রথম তিন মাসের আন্দোলন হঠকারী পথে বাঁক নিয়ে সম্পূর্ণ ব্যর্থ না হলে দলটি মাথা তুলে দাঁড়াতে পারত। লীগ সরকার বিচক্ষণতার সঙ্গে কঠোরপন্থায়, ক্ষেত্রবিশেষে নিষ্ঠুরভাবে সে আন্দোলন গুঁড়িয়ে দিয়েছে। বিএনপি তাদের ব্যর্থতার কারণগুলো খতিয়ে দেখলে ভবিষ্যতের জন্য ভালো হতো। পৃথিবীর সব দেশে দায়িত্বশীল দল এমন বিপর্যয়কর পরিস্থিতি সৃষ্টির কারণ অনুসন্ধানের জন্য আলোচনা-পর্যালোচনা, সমালোচনা এবং আত্দসমালোচনার আয়োজন করে। বিএনপিতে এই সংস্কৃতি শহীদ জিয়ার আমলে ছিল, এখন নেই। জিয়াউর রহমান ছোটখাটো সভা নয়, দস্তুরমতো দল-অঙ্গ দলের বর্ধিতসভা ডেকে সবার কথা শুনতেন, নিজে বলতেন না। প্রয়োজনে কোনো অভিযোগের জবাব দিতেন, ব্যাখ্যা দিতেন। এখন কোনো কথা বলতে চাইলে নাকি বেগম খালেদা জিয়া ধমক মারেন। দল ছেড়ে চলে যেতে বলেন। মনে হয়, দলটাকে মৌরুসি-পাট্টামূলে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পত্তি বলে ভাবা হয়। যারা কথা-বার্তা বলতে চান, দলকে ভালোবেসেই বলতে চান। কিন্তু যদি ভাবা হয়, কারও জমিদারিতে বা খাসমহলে এরা প্রজা-রায়ত অথবা স্টাফ অফিসার-কর্মচারী, এরা ভালো-মন্দ কোনো কথা বলার হকদার নন, তাহলেই একমাত্র বলা যায়, 'দলে থাকতে বলেছে কে? চলে যান।' কিন্তু একটা রাজনৈতিক দলে এমন কথা বলা যায় না, এমন কথা বলার হক কারও থাকা উচিত নয়। একটা দল গঠিত হয় রাষ্ট্র ও জনগণের কল্যাণের জন্য। দলের সুনির্দিষ্ট একটা রাজনীতি, আদর্শ ও কর্মসূচি থাকে। দল হয় সব নেতা, কর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ীর; দল হয় জনগণের। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলের বিএনপিতে জনগণের দলের চরিত্র ছিল। কোনো কোটারি, স্তাবক, তোষামোদকারী ছিল না। দলে কর্নেল (অব.) আলাউদ্দিন-রুস্তমরা তখনো ছিল; কিন্তু বিএনপি চেয়ারপারসনের বর্তমান গুলশান অফিসের কর্মচারীদের মতো তারা মহাপ্রতাপশালী, উদ্ধত ও দুর্বিনীত ছিল না। দলের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের চেয়ে এসব 'হালে বিএনপি চেনা' কর্মচারীদের বেগম খালেদা জিয়ার কাছে যত দাম, কর্নেল (অব.) আলাউদ্দিন-মাজেদ-রুস্তমরা জিয়াউর রহমানের কাছে তেমন দামি ছিল না। জিয়া তাদের দিয়ে কখনো দল চালাননি।
ঢাকা মহানগর কমিটি পুনর্গঠনে হাত দেওয়া হয়েছিল। ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকা ছিলেন মহানগর সভাপতি। খোকা একজন চৌকস মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ঢাকা মহানগরীতে অনেক দুঃসাহসী অভিযানের অন্যতম নায়ক। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি করছেন। দেখতে ছোটখাটো হলেও বয়স ষাট পেরিয়েছে। প্রকৃত একজন কেরিয়ার রাজনীতিবিদ। ঢাকায় আরেকটা 'মুক্তিযুদ্ধ' করে দিতে পারছেন না বলে তাকে পছন্দ হচ্ছিল না ম্যাডাম খালেদা জিয়া এবং তদীয় পুত্র তারেক রহমানের। মির্জা আব্বাস-গয়েশ্বর রায়দের নেতৃত্বে বিপক্ষ গ্রুপ তো ওঁৎ পেতেই ছিল। বাদ দেওয়া হলো সাদেক হোসেন খোকা ও খোকা-কমিটিকে। ম্যাডামরা বোধহয় ধারণা করেছিলেন, এবার 'বিপ্লব' হয়ে যাবে। হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ ঘিরে সাদেক হোসেন খোকা যা করতে পারেননি বা করেননি, নতুন মহানগর কমিটি ২০১৫ সালের জানুয়ারি-মার্চ তিন মাসে তা পুষিয়ে দেবে। কিন্তু পুনর্গঠিত ঢাকা মহানগর কমিটি আরও লজ্জা দিল বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানকে। অর্থাৎ, যা ছিল তাও গেল। তিন মাসের আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার পরও দল পুনর্গঠনের কথা বলছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। বলছেন দল গুছিয়ে আবার আন্দোলনে যাবেন; তবে এবার গণসংশ্লিষ্ট আন্দোলন করবেন। আন্দোলনে গণসংশ্লিষ্টতার যে প্রয়োজন সে উপলব্ধিটা অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু কাদের নিয়ে দল পুনর্গঠন করবেন? আবার ঢাকা মহানগরীর 'পুরান' কমিটি বাদ দিয়ে 'নতুন কমিটি করার মতো? কী লাভ হবে তাতে? বিএনপিকে যারা কাছে ও দূরে থেকে পর্যবেক্ষণ করছেন, তারা বলতে চান, বিএনপিকে সত্যিকার অর্থে পুনর্গঠন করতে হলে পার্টি চেয়ারপারসনকে প্রথম 'ফায়ার' করতে হবে তার গুলশান অফিসে। সে অফিসের 'কর্ণধার' নামের যারা বেগম খালেদা জিয়াকে সারাক্ষণ ঘিরে রেখে দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতা-কর্মী ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, 'সিএসএফ-টিএসএফ' ইত্যাদির খাপছাপ সৃষ্টি করে এখনো 'পিএম-পিএম' ভাব জাগিয়ে তাকে আচ্ছন্ন করে রেখে নানা মহলের নানা স্বার্থ হাসিল করছে, ওই 'কর্ণধারদের' কবল থেকে মুক্ত না হয়ে কিছুই করা যাবে না।
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন বিএনপির পুনর্গঠন দরকার আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে। সরকার মুখে উপরে উপরে যতই বলুক ২০১৯ সালের আগে কোনো নির্বাচন হবে না, তা কর্মী-সমর্থকদের সাহস জোগানোর কথা, শতভাগ মনের কথা নয়। তারা আসলে একটা মধ্যবর্তী বা আগাম নির্বাচনের কথা ভাবছে বলে অনুমান করা যায়। বঙ্গবন্ধুর শোকাবহ হত্যাদিবস ১৫ আগস্ট উপলক্ষে এবার দেশব্যাপী ৪০ দিনের কর্মসূচি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। শুধু শোকসভা আর কাঙালি ভোজ করার জন্য এ কর্মসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে বলে মনে হয় না। এটা আগাম নির্বাচন-প্রস্তুতির সাংগঠনিক কার্যক্রমের সূচনা বলেই ধরে নেওয়া যায়। বিএনপি পথ হাতড়াতে হাতড়াতেই আওয়ামী লীগ 'দৌড় প্রতিযোগিতায়' এগিয়ে থাকতে চাচ্ছে। এসব বোঝার লোকও বেগম জিয়ার আশপাশে নেই বলে বলতে চান দলের সুহৃদরা। যারা এসব বোঝেন, গুলশান অফিসের 'সিন্ডিকেট' ডিঙিয়ে তারা ঠিক জায়গায় পৌঁছতেও পারেন না। আর সারাক্ষণ কানের কাছে এদের বিরুদ্ধে কূটনামি তো লেগেই আছে। সরকার একদিকে কৌশলে নিজেদের সাংগঠনিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করে নিচ্ছে অপরদিকে বিএনপিকে হীনবল করার জন্য মামলা-মোকদ্দমা, জেল-জুলুম, গুম-অপহরণ ইত্যাদি পথও অব্যাহত রাখতে পারে। কারণ বিএনপির বিশাল যে ভোট ব্যাংক বা সমর্থক গোষ্ঠী তাতে এখনো কোনো ফাটল ধরেনি, দীর্ঘদিন ধরে তা অটুট বা স্থিতাবস্থায় আছে। সাংগঠনিক ভিত্তিটাকেই তছনছ, লণ্ডভণ্ড করে দিতে চাইবে সরকার। দলের এখন ঘোষিত দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক রহমান। শোনা যাচ্ছে তাকে কো-চেয়ারম্যান করা হচ্ছে। কিন্তু চেয়ারম্যান বানালেও লাভ কি? তিনি তো বিএনপি ক্ষমতায় যেতে না পারলে দেশে আসতে পারবেন না। বিলাত থেকে 'আগে বাড়াও, আক্রমণ কর, বিচ্ছিন্ন করে দাও রাজধানী'- এ জাতীয় হুকুমনামা জারি করে দেশে সফল কোনো আন্দোলন গড়ে তোলা যাবে না। বেগম জিয়াই এখন ভরসা বিএনপির। কিন্তু সরকার তার ব্যাপারেও খুব কঠোর বলে মনে হয়। তাকে শুধু নির্বাচন থেকে দূরে সরিয়ে রাখা নয়, তিনি যাতে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিয়ে শাসক লীগের সর্বনাশের 'শিঙায়'ও ফুঁ দিতে না পারেন, সে ব্যাপারে আইনি সুযোগও কাজে লাগাতে পারে। তিনি যদি নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হন এবং কারারুদ্ধ হন, তখন বিএনপির কী হবে? তখনকার কথাটাই এখন ভাবার কথা বলেছি আমি, লিখেছি। বিপুল জনসমর্থনকে ভোটের বাক্সমুখী করার জন্য একটি যোগ্য ও যৌথ রাজনৈতিক নেতৃত্ব কাঠামো নির্মাণের কথা ভাবতে বলেছি বিএনপির কমিটেড ও নিবেদিতপ্রাণ শক্তিকে। বলেছি অন্যের বায়বীয় শক্তি নয়, জামায়াতের ওপর অকারণ নির্ভরতা নয়, আপন শক্তিতে বলিয়ান হতে হবে। পেট ব্যথা আপনার, আরেকজন ট্যাবলেট খেলে আপনার ব্যথা সারবে? নিজের ভালো পাগলও বোঝে। বিএনপি বুঝবে কবে? বিএনপির উচিত ভুল-ভ্রান্তি শুধরে হঠকারিতা পরিহার করে নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিক কার্যক্রমের ওপর জোর দেওয়া। শহীদ জিয়ার প্রকৃত অনুসারীদের ঐক্যবদ্ধ করা। দলে বিভেদ নয়, ঐক্যের ঝাণ্ডা ঊর্ধ্বে তুলে ধরা। 'ছাগল দিয়ে হাল চাষ' করার পরিকল্পনা থাকলে এখনই সময় তা পরিহার করার।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
ই-মেইল : [email protected]