আমি তখন স্কুলে পড়ি। ভাসা ভাসা মনে পড়ে। আমার বাড়ির সাথেই আমাদের প্রাইমারি স্কুল। সকাল থেকে স্কুলের মাঠে মাইক বেঁধে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বাজানো হত। আমরা সমবয়সীরা মিলে কে কতটা মুখস্থ বলতে পারি তার প্রতিযোগিতা করতাম। সেই সময়ে পুরো ভাষণটা মুখস্থ ছিল আমার।
গ্রামের সবাই চাল ডাল আর চাঁদা তুলে কাঙালিভোজ রান্না করতো। এখনকার মত মোড়ে মোড়ে বড় বড় গরু ছাগল জবাই হতো না। কিন্তু খুব প্রাণ ছিল তাতে। পার্টি তখন বিরোধীদলে। সারাগ্রামের মানুষের অংশগ্রহণ থাকতো। কোন জোরজবরদস্তি নয় গ্রামের মানুষ ভালোবেসে তাদের শেখ সাহেবের জন্য চাল ডাল টাকা দিতো। নিজেরাই রান্না করতো। গরীব দু:খীদের সাথে একসাথে পাত পেড়ে খেতো। আমার গ্রামের সেই ১৫ আগস্টই আমার কাছে সবচেয়ে বড় সমর্পণ, বড় শ্রদ্ধা।
শোক জানাতে গেছেন নাকি টিভি ক্যামেরায় চেহারা দেখাতে গেছেন? ভোর থেকে এই নির্লজ্জতা দেখতে দেখতে ক্লান্ত। আরে ভাই যার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গেছেন এটা যে তাঁর চূড়ান্ত অসম্মান। সিনিয়র নেতাদের ঠেলাঠেলি ধাক্কাধাক্কি খুবই দৃষ্টিকটু। কে সামনে দাঁড়ালো, কে পেছনে পড়লো, কে অনুপস্থিত -এগুলো দেখার মত মানসিক অবস্থায় নিশ্চয়ই আজ জননেত্রী শেখ হাসিনা থাকেন না? তাহলে আপনাদের চাঁদবদনটা কাকে দেখাতে চান? পাবলিক কে? পাবলিক আপনাদের চেহারা দেখলেই রিমোট হাতে নিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করে। চেহারা দেখানোর অসুস্থ প্রতিযোগিতার এই নির্লজ্জ বেহায়াপনা আজকের দিনে না করলেই কি নয়!
কোনটা রেখে কোনটা বলি! সংগঠনের ভেতরে বাইরে যা চলছে তা মোটেই সুখকর নয়। বিভিন্ন ভুঁইফোড় সংগঠন এবং উপকমিটি গুলো নিয়ে না বললেই নয়। আওয়ামী লীগের ভুঁইফোড় সংগঠন; অভিযোগের তীর কেন্দ্রীয় নেতাদের দিকেই।
দলের সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনা এবং দলের দুঃসময়ে অবদান রেখেছেন এমন সাবেক ছাত্রনেতাদের মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি সংগঠিত রাখতেই উপ-কমিটি গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। আওয়ামী লীগের অংগ ও সহযোগী সংগঠনের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের দলের কাছে রাখতেই মূলত এই উদ্যোগ।
তবে নির্মম সত্য হলো বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধার বিনিময়ে মেলে উপ কমিটির পদ। অতীতে আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও আর্থিক খাতের বিতর্কিত, ব্যাংক খাতের নিষিদ্ধ, ধর্ষণ মামলার আসামি, বিতর্কিত ব্যবসায়ী, রাজাকার পুত্র, প্রবাসী কমিউনিটি নেতা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা মামলার প্রধান আসামি, ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রিধারী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী না হয়েও সাবেক ছাত্রনেতা পরিচয়ে অনেকে কেন্দ্রীয় উপ-কমিটিতে জায়গা করে নিয়েছে।
এছাড়াও সংগঠনের নামের সাথে ‘আওয়ামী’ ও ‘বঙ্গবন্ধু’ ও ‘লীগ’ যুক্ত করে গড়ে উঠা ভুঁইফোড় সংগঠনের নেতারাও বাগিয়ে নিয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপ কমিটির পদ। আবার আওয়ামী লীগের উপ কমিটির পদের প্রভাব খাটিয়ে বিস্তৃতি ঘটিয়ে চলেছে শত শত ভুঁইফোড় সংগঠনের।
টানা তিন মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে দেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক সংগঠন আওয়ামী লীগ। আর এ সুযোগে বঙ্গবন্ধু, বঙ্গমাতা, শেখ রাসেলসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের নামে গড়ে উঠেছে নতুন নতুন ‘রাজনৈতিক দোকান’। মূল দলের নামের সঙ্গে মিল রেখে অর্থাৎ ‘লীগ’ শব্দটি যোগ করে সংগঠন গড়ে চাঁদাবাজি বা সরকারি সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করে এসব ভুঁইফোড় সংগঠন। দেশজুড়ে এসব সংগঠনের ছড়াছড়িতে ক্ষুন্ন হচ্ছে বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি। বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে কেউ ধরা পড়লে দুই চার দিন হৈচৈ তারপর যা তাই।
ক্ষমতাসীন দলের উপ-কমিটিতে থেকে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন শাহেদ, হেলেনার মতো ব্যক্তিরা। আর এসব কারণে শুরু থেকেই কম-বেশি বিতর্কে পড়েছে আওয়ামী লীগের বিষয়ভিত্তিক এসব উপ-কমিটি। ছদ্মবেশে আওয়ামী লীগে প্রবেশ করে সুবিধাবদীরা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে। কোন যোগ্যতা না থাকলেও চেয়ারম্যান ও সদস্য সচিবের নিজ এলাকার লোক হিসেবে জায়গা পেয়েছে অনেকে। এইসব উপ কমিটি গুলোতে এমন অনেককেই রাখা হয়েছে, অতীতে যাদের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ছিল না। তাদের জীবনের প্রথম রাজনৈতিক পদ এই উপকমিটির সদস্য।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে বুকে ধারণ করে, জননেত্রী শেখ হাসিনাকে ভালোবেসে যারা রাজনীতিটা করতে চান তাদেরকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে। পদ পদবিকে যারা উপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করবে না। সংগঠন বিতর্কিত হয় এমন কোন কাজের সাথে জড়াবে না। বরং শ্রম, ঘাম, মেধা ও ডেডিকেশন দিয়ে দলকে সার্ভ করবে তাদেরকেই বঞ্চিত করা হচ্ছে। দূরে সরিয়ে রাখা হচ্ছে।
ঘুরে ফিরে সৈয়দ আশরাফ ভাইকে মনে পড়ে আমার। উনি বঙ্গবন্ধুকে সার্বজনীন করেছিলেন। কোন পকেট লীগ চালু করেননি। দেশরত্ন শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করেছিলেন। জেলায় জেলায় ওমুক লীগ তমুক লীগের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগটা ছিল উনি যখন সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
টানা এক যুগের ক্ষমতা দল আওয়ামী লীগের চরম সর্বনাশ করেছে। সরকারে বিলীন হওয়ার পথে ঐতিহ্যবাহী দলটি। কেন্দ্রের সাথে তৃণমূলের দূরত্ব এতটাই প্রকট যেটা সংগঠনকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। জেলা কমিটি গুলোর দিকে তাকালে দেখতে পাবেন সর্বত্রই ‘ম্যাইম্যান’। সংগঠনে কার অবদান কতটুকু সেটা আর এখন বিবেচিত হয় না। ‘কার লোক’ এটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়ার ক্ষেত্রে। হাইব্রিডদের চাষাবাদ এবং ফলন খুবই উচ্চ। এদেরকে জায়গা করে দিতে আওয়ামী লীগের তৃণমূল কোনঠাসা হতে হতে বেদখল হয়ে গেছে !
লেখক: সম্পাদক বিবার্তা২৪ডটনেট
বিডি প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন