যুক্তরাজ্যবাসী বাংলাদেশি আব্দুল মান্নান স্বেচ্ছায় সিরিয়ায় যাননি, আইএস জঙ্গিরা তুরস্ক থেকে তাকে সপরিবারে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন তার ছেলে। তিনি বলেন, বাবার সঙ্গে কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। ওপরপ্রান্ত থেকে শুধু কান্নাই শোনা গেছে।
যুক্তরাজ্যের সম্প্রচার মাধ্যম আইটিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন ৭৫ বছর বয়সী মান্নানের ছেলে সালিম হোসাইন।
পরিবারটি তাদের মেয়ের প্ররোচনায় আইএসে যোগ দিয়েছে বলে সিলেটে থাকা তার স্বজনরা সন্দেহ প্রকাশ করলেও সাক্ষাৎকারে সালিম বলেছেন, তার ভাই-বোনদের কারও মধ্যে উগ্রপন্থী কোনো উপাদান বা জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ তার চোখে পড়েনি।
পরিবারটি ‘সবচেয়ে নিরাপদে আছে’ এবং ‘তারা আইএসে যোগ দিয়েছে’ বলে জঙ্গি সংগঠনটি সম্প্রতি যে বিবৃতি দিয়েছে তাও নাকচ করেছেন তিনি।
ব্রিটেনের লুটন শহরে বসবাসরত মান্নান অনেক বছর পর পরিবারের ১১ সদস্যকে নিয়ে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও গ্রামের বেড়াতে এসেছিলেন।
গত ১১ মে সিলেট ছাড়ার পর মাঝপথে তুরস্ক থেকে উধাও হয়ে যাওয়া পরিবারটিকে নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছিল। এর মধ্যে ৪ জুলাই আইএসের পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়, পরিবারটি আইএসের সঙ্গে রয়েছে।
আইটিভি যুক্তরাজ্য সম্পাদক রোহিত কাচরোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সালিম বলেছেন, তার বাবা পরিবার নিয়ে স্বেচ্ছায় সিরিয়ায় যাননি। বাংলাদেশ থেকে ফেরার পথে ইস্তাম্বুলের একটি হোটেল থেকে কৌশলে তাদের তুলে সিরিয়ায় নিয়ে যায় আইএস জঙ্গিরা।
আইটিভির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সালিমকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, তার বাবাকে ইচ্ছার বিরুদ্ধে গাড়িতে উঠিয়ে সিরিয়ায় নিয়ে যাওয়া হয়।
বেশ কয়েকবার ফোনে বাবার সঙ্গে তার কথা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিবারই ফোনের অপরপ্রান্ত থেকে তার কান্না শোনা যাচ্ছিল।
সালিম বলেন, ''আমার বাবা খুবই বৃদ্ধ মানুষ। তার বয়স ৭৫ বছর। তার এসবের দরকার নেই। তিনি ওই দেশে থাকতে চান না, আমি জানি। সবাই এটা জানেন, তিনি নয়, তিনি নয়। তিনি কখনোই ওই দেশে যেতেন না, যদি না কেউ তাকে জোর করে নিয়ে না যায়।''
''তিনি কখনোই ওই বিবৃতি দিতে পারেন না। এটা তিনি নয়। আমার বাবা শঙ্কিত, বিষণ্ন; প্রতিদিন কান্নাকাটি করছেন- (তিনি) শান্তিতে নেই।''
''তিনি এখন যেখানে আছেন, সেখানে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। তার চিন্তা শুধু পরিবার নিয়ে এবং আমাদের সবাইকে নিয়ে। তিনি খুবই দ্বিধাগ্রস্ত এবং সেখানে এই অবস্থায় তিনি পড়তে পারেন এটা কল্পনাও করতে পাচ্ছেন না। আমার মাও তাই। তারা কীভাবে সেখানে গেলেন?''
''এটা কোনোভাবেই মেলে না। ওই দেশে এখন যুদ্ধাবস্থা চলছে... সেখানে এসব নারী, শিশু-কিশোররা। তারা কেন সেখানে তাদের শিশুদের নিয়ে যাবেন? এটা নিরাপদ নয়। আমরা দ্বিধান্বিত, আমরা বুঝতে পাচ্ছি না।''
সালিম দাবি করেছেন, ইস্তাম্বুলের হোটেল কক্ষে ঢুকে পাসপোর্ট পরীক্ষা করার কথা বলে কয়েকজন তার বাবা আব্দুল মান্নান ও মা মিনারা খাতুনের কাছ থেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের আলাদা করে একে একে নিচে নামিয়ে আনেন। সব শেষে তাদের দুজনকে রুমে রেখে তারা বলে, তোমরা এখন ব্রিটেন ফিরে যাও।
কিন্তু ছেলে-মেয়ে ও নাতি-নাতনিদের ফেলে মান্নান ও মিনারা ব্রিটেনে আসতে রাজি না হলে, তাদেরও নিচে নামিয়ে আনা হয়। এরপর তাদের দুজনকে বেঁধে হোটেলের সামনে থাকা দুটি গাড়িতে তুলে সিরিয়ায় নিয়ে যায় আইএস জঙ্গিরা।
ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সালিম বলেন, “তুরস্কে দুদিন থেকে তাদের ইংল্যান্ডে ফেরার কথা ছিল। দ্বিতীয় রাতে ওই লোকরা হোটেলে আসে। তারা আসলে কারা আমরা জানি না।
“তাদেরকে আলাদা করে নিচে নামানো হয়। শেষ মুহূর্তে আমার বাবা-মা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে জানতে চান, ‘আমার পরিবারকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তোমরা, আমাদের বাচ্চাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তোমরা?
“তাদের বলা হয়, ‘তোমরা চিন্তা করো না, ইংল্যান্ডে ফিরে যাও’। একথা শুনে তারা দুজন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, তোমরা এসব কি বলছো?
“তারা কাঁদতে কাঁদতে হাতজোর করে বলতে থাকেন, আমার পরিবার, সন্তান ও শিশুদের ফেরত দাও। তখন তারা বলে, ‘ঠিক আছে আমাদের সঙ্গে আস।
“এরপর তাদের সবাইকে গাড়িতে করে তুলে নিয়ে যায় তারা।”
স্ত্রী, ছেলে, ছেলের বউ, মেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে ১১ এপ্রিল বাংলাদেশে এসে এক মাস গ্রামে ছিলেন মান্নান। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা হলেন- স্ত্রী মিনারা খাতুন (৫৩), মেয়ে রাজিয়া খানম (২১), ছেলে মোহাম্মদ জায়েদ হুসাইন (২৫), মোহাম্মদ তৌফিক হুসাইন (১৯), মেয়ে সাঈদা খানম (২৭), তার স্বামী মোহাম্মদ আবিল কাশেম সাকের (৩১), ছেলে মোহাম্মদ সালেহ হুসাইন (২৬), তার স্ত্রী রওশনারা বেগম (২৪) এবং তিন শিশু, যাদের বয়স এক থেকে ১১ বছর।
১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্যে পাড়ি জমানো মান্নান লন্ডনে রেস্তোরাঁয় কাজ করতেন। মান্নানের আগের স্ত্রীর দুই ছেলে লুটনে থাকেন। তাদেরই একজন সালিম। বাবাসহ পরিবারের সদস্যদের নিখোঁজ হওয়ার খবর তারাই পুলিশকে প্রথম জানিয়েছিল।
ডায়াবেটিসের রোগী মান্নানের স্ত্রী মিনারা ক্যান্সারে আক্রান্ত বলে যুক্তরাজ্যের সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে।
ইন্টারনেটভিত্তি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে আইএস জঙ্গিদের বিবৃতির সঙ্গে প্রচারিত ছবিতে তার বাবার আঙ্গুল উঁচু করার (আইএস জঙ্গিদের দেখানো চিহ্ন) বিষয়ে জানতে চাইলে সালিম বলেন, “এটি আইএস জঙ্গিদের প্রতি সমর্থনসূচক কোনো বিষয় নয়। এটি আইএস এর পক্ষ থেকে ‘নিছক প্রপাগাণ্ডা’।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, তার ভাই-বোনদের কেউ উগ্রপন্থী হয়ে উঠেছিল বা সিরিয়ায় পালানোর পরিকল্পনা করেছিল- এমন কোনো চিহ্ন ছিল না।
পরিবারে এধরণের কোনো ঝোঁকের চিহ্ন ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “মোটেও না, অস্বাভাবিক কিছুই ছিল না। আমি যদি এরকম কিছু পেতাম তাহলে অবশ্যই বাধা দিতাম। পুলিশও উগ্রপন্থী কিছু খুঁজে পায়নি। কোনো প্রমাণ নেই, সন্দেহজনক কিছুই নেই।
“স্বাভাবিক নয় বা সন্দেহজন কিছু যদি থাকতো তাহলে তা অবশ্যই আমার নজরে ধরা পড়তো। কিন্তু এরকম কিছুই ছিল না। কোনো চিহ্ন নেই। এরকম কোনো কিছু ধরা পড়লে আমি আমলে নিতাম।”
পরিবারের সদস্যদের ফিরে আসতে আবেগপ্রবণ আবেদন জানিয়ে সালিম বলেন, তাদের চলে পাওয়ার পর থেকে তার হৃদয় ‘শূন্য হয়ে পড়েছে’।
“আমি তাদের নিরাপদে ফেরত চাই। দয়া করে তোমরা ফিরে এসো। আমরা তোমাদের অভাববোধ করছি, তোমাদের সবার। বিশেষ করে আমার ৭৫ বছর বয়সী বাবাকে খুব মিস করছি; আর আমার মায়ের, যিনি ক্যান্সারে আক্রান্ত।
“এটা এমন যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি, ব্যাখ্যা করা ভাষা নেই। এটা এমন যে, হৃদয়ের কোথাও শূন্যতা, কিছু হারানোর শূন্যতা।
“আমরা সবাই তাদের শূন্যতা অনুভব করছি। তাদের ছাড়া আমরা সবাই হারিয়ে যাবো।”
এদিকে যুক্তরাজ্যের ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের এক মুখপাত্র জানান, ১২ সদস্যের পরিবারটি নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বেডফোর্ডশায়ারের পুলিশ ও তুরস্কের কর্তৃপক্ষ একসঙ্গে কাজ করছে।
তিনি বলেন, “আমাদের নাগরিকদের সিরিয়ায় না যেতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সিরিয়ার সঙ্গে যুক্তরাজ্যের সব কনস্যুলার সেবা বন্ধ থাকায় এই মূহূর্তে ব্রিটিশ এই পরিবারটি কোথায় রয়েছে, তা বলা খুবই কঠিন। কেউ যদি কোনো কারণে এই মূহূর্তে এসব অঞ্চল ভ্রমণে যান, তবে বুঝতে হবে, তিনি নিজেকে বিপদের মধ্যেই সমর্পণ করছেন।
''কেউ যদি যুক্তরাজ্যের বাইরে কোনও জঙ্গি গোষ্ঠীকে সমর্থন করার পর দেশে ফিরে আসে তাহলে ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ অবশ্যই তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করবে।''
বিডি-প্রতিদিন/১১ জুলাই ২০১৫/ এস আহমেদ