অমর একুশের গানের রচয়িতা আবদুল গাফফার চৌধুরীকে প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানালেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা। রবিবার বিকেল ৩টায় নিউইয়র্ক সিটির জ্যামাইকায় জেএফকে এয়ারপোর্ট সংলগ্ন ‘ক্রাউন প্লাজা’ হোটেলের মিলনায়তনে কলামিস্ট ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই প্রবাদ পুরুষ গাফ্ফার চৌধুরী প্রবাসীদের উষ্ণ অভ্যর্থনায় অভিভূত হন। এ সময় তার সাম্প্রতিক একটি বক্তব্যকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিকৃত করে জামাত-শিবির ও বিএনপির একাংশ কর্তৃক সহজ-সরল প্রবাসীদের ক্ষেপিয়ে তোলার অভিপায়ে প্রবাসে তার বিরুদ্ধে নানা কর্মসূচির প্রতি ইঙ্গিত করে গাফফার চৌধুরী বলেন, ‘আমি মোটেই বিস্মিত নই। এরকম মূর্খ এই সমাজে আগেও ছিল। আগামীতেও থাকবে। তাই একটা সামাজিক বিপ্লব দরকার। যে বিপ্লব মানুষকে বদলাবে জ্ঞানের পথে। মানুষ হাঁটবে আলোর আঙিনায়।’ এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে কখনোই কোন তালেবানী পতাকা উড়বে না- এ বিশ্বাস নিয়ে আমি ফিরে যাচ্ছি।’ তিনি বলেন, ‘শত অপপ্রচার ও প্রতিকুলতার মধ্যে আজকে এখানে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি যেভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন, তাতে আমি আশাবাদী। বাংলদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তির বিজয় নিশ্চিত।’
গাফফার চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের শত্রু দুইটি: মৌলবাদ ও দুর্নীতি। এ দুটো ধ্বংস করা না গেলে আধুনিক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এজন্যে সেকুলার সোসাইটির ভূমিকা অনেক বেশি। তিনি বলেন, ধর্মান্ধতা বাংলাদেশে প্রগতির পক্ষে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।
সংবর্ধনা প্রদানের এ অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা ছিল নিউইয়র্কে বাঙালি পাড়া হিসেবে পরিচিত জ্যাকসন হাইটসের জুইশ সেন্টারে। কৌশলগত কারণে ভ্যানু পরিবর্তন করেন উদ্যোক্তারা। স্বল্প সময়ের নোটিশে হওয়া সত্ত্বেও বিকাল তিনটার আগেই মিলনায়তনটি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়।
অনুষ্ঠানের অন্যতম আয়োজক মুক্তিযোদ্ধা ও যুক্তরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধু পরিষদের সভাপতি ড. নূরন নবী জামাত-শিবিরের অপতৎপরতা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, ‘আমাদের এই অনুষ্ঠানটি ছিলো জ্যাকসন হাইটসের জুইশ সেন্টারে। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির হুমকিতে জুইশ সেন্টার কর্তৃপক্ষ ভেন্যু বাতিল করে দেয়। ফলে কয়েক ঘণ্টার নোটিশে আমাদের এই সভার আয়োজন করতে হয়।’ ড. নূরন নবী বলেন, ‘মৌলবাদী শক্তি ঘোষণা দিয়েছিলো, তারা কোন অনুষ্ঠান করতে দেবে না। কিন্তু আজ উদীচী ও আমরা দু'টি অনুষ্ঠান করে তার জবাব দিয়েছি।’
ড. নূরন্নবীর স্বাগত বক্তব্যের পর একটি দেশাত্মবোধক গান ও অমর একুশের গান পরিবেশন করে যুক্তরাষ্ট্র উদীচীর শিল্পীরা। সবাই দাঁড়িয়ে কণ্ঠ মেলান এ গানের সঙ্গে। এরপরই মাইক তুলে দেয়া হয় সংবর্ধিত ব্যক্তিত্ব আবদুল গাফফার চৌধুরীর হাতে। তিনি বলেন, ‘আপনাদের অনেকে জানেন, ১৯২৬ সালে 'বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন' নামে একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ঢাকায়। মূলত এ আন্দোলন ছিল মুসলিম সমাজকে প্রগতিমুখী করার জন্য একটি সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন। আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞান দর্শন রাজনীতি অর্থনীতি ইত্যাদি নানা বিদ্যার দিগন্তে বিচরণ উৎসাহী এবং মুক্তিবাদ ও মানবতাবাদ উদ্দীপ্ত সদ্য প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল হুসেন (অর্থনীতি ও বাণিজ্য), অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন (পদার্থ বিদ্যা), বিএ ক্লাসের ছাত্র আবুল ফজল, ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের অধ্যাপক কাজী আবদুল ওদুদ (বাংলা) প্রমুখ ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কাজী আবদুল ওদুদকে বলা হতো এ প্রতিষ্ঠানের মস্তক, আবুল হুসেনকে হস্ত এবং কাজী মোতাহার হোসেনকে হৃদয়। তাদের লক্ষ্য ছিল মুসলমান বাঙালিকে কীভাবে এগিয়ে নেয়া যায়। প্রসঙ্গত বলা দরকার, রাজা রামমোহন রায়কে 'মহামানব' বলার অপরাধে এদের বিচারের কাঠগড়ায় তোলা হয়। কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন প্রাণভয়ে কলকাতা চলে যান। আপনারা জানেন, কবি কাজী নজরুল ইসলামকে কাফের ফতোয়া দিয়েছিল তৎকালীন মোল্লারা। বলা হয়েছিল ইংরেজী শিক্ষা হারাম। স্যার সৈয়দ আহমদকেও এরা পছন্দ করেনি ইংরেজী শিক্ষা প্রসারে কাজ করেছিলেন বলে। অথচ এরাই পরে কাজী নজরুল ইসলামকে মুসলিম রেঁনেসার কবি তকমা দেবার চেষ্টা করেছে। এখন মৌলবাদীরা নজরুলের গান গান- নিজেদের প্রয়োজনে।’
৮১ বছর বয়েসী মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে আপসহীন এই কলামিস্ট বলেন, ‘ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, পুড়িয়ে মারা হতো নারীদের। ভ্যাটিকানে বিদ্রোহ হয়েছিল। সভ্যতা একবারে আসেনি। অনেক পরিক্রমা পার হতে হয়েছে মানব সমাজকে।’ তিনি বলেন, ‘ইসলামে অনেক ইমাম এসেছেন। তাদের একে অপরের সঙ্গে ভিন্নমত ছিল। সুন্নীহ ও শিয়া মুসলমান বিষয়েও অনেক কথা আছে। কিন্তু মানব সমাজ এগিয়ে গেছে। এগোতেই হয়।’
গাফফার চৌধুরী বলেন, আজকের সমাজ সমকামীদের অধিকার দিয়েছে। 'গে রাইটস' এখন একটি স্বীকৃত বিষয়। এসব নিয়ে এই প্রজন্মকে ভাবতে হবে। পরখ করতে হবে আলো ও আঁঁধারের পথ।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের একজন কামাল আতাতুর্ক দরকার। যিনি অনেক কিছুই নিষিদ্ধ করেছিলেন। তুরস্কে যে ভাবে সভ্যতার বিবর্তন হয়েছিল, আজ তা জানতে হবে-বুঝতে হবে এই প্রজন্মকে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বে আজ নতুন নতুন মৌলবাদ তৈরি হচ্ছে। এটা কারা করছে? কাদের স্বার্থে করছে ? বিশ্বব্যাপী আজ মুসলমান, মুসলমানকে হত্যা করছে সবচেয়ে বেশি। গোত্রগত সংঘাত মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে শুধুমাত্র মুর্খতা, বর্বরতার কারণে। মানুষের অজ্ঞতাই আজ এই নতুন নতুন মৌলাবাদের অন্যতম কারণ।’
প্রবীণ এই সাংবাদিক বলেন, ‘সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে আমি মৃত্যুকেও ভয় করি না। আমার কথা আমি সত্যের পক্ষে বলেই যাবো। আমার বিবেচনাবোধ কেউ রুখতে পারবে না।’
গত ৩ জুলাই জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের ‘বঙ্গবন্ধু মিলনায়তনে’ ‘বাংলাদেশ : অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যত’ শীর্ষক এক আলোচনায় আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর বক্তব্যের কিছু অংশকে ‘ইসলাম, নবী-রাসুল এবং সৃষ্টিকর্তাকে অবমাননার সামিল’ হিসেবে অভিযোগ করে একদল প্রবাসী প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। তারা ‘যেখানে গাফ্ফার-সেখানেই প্রতিরোধ’ কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবে গত ৫ জুলাই নিউইয়র্ক সিটির জ্যামাইকায় তাজমহল রেস্টুরেন্ট এবং ব্রুকলিনে বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম লীগের মিলনায়তনে গাফ্ফার চৌধুরীর অনুষ্ঠানে বাধা প্রদান করে। বাধার পরিপ্রেড়্গিতে অকুস্থলে পুলিশ আসে এবং সকলকে সব ধরনের কর্মসূচি থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেয়। এরপর ৭ জুলাই মঙ্গলবার গাফ্ফার চৌধুরীর আরেকটি সমাবেশ হয় বোস্টনে। সেখানেও বাধা প্রদানের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু আয়োজকরা সজাগ থাকা এবং সমাবেশ স্থলে পুলিশের উপস্থিতি ঘটায় সে সমাবেশে বিঘ্ন ঘটানো সম্ভব হয়নি।
বিডি-প্রতিদিন/ ১৩ জুলাই, ২০১৫/ রশিদা