চুরির মামলায় গ্রেফতারের পর এখন জেল-জরিমানার হাত থেকে বাঁচতে দেন-দরবার চালাচ্ছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ভাতিজা রনজিৎ সিনহা।
নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সেথাম সিটিতে মুনলাইট গ্যাস স্টেশনে কর্মরত অবস্থায় বিপুল অর্থ চুরির মামলায় সম্প্রতি গ্রেফতার হন রনজিৎ। ১৫ নভেম্বর তাকে সরকার পক্ষের আইনজীবীরা কম শাস্তি পেতে দোষ স্বীকারের প্রস্তাব দিয়েছেন। এই কম শাস্তির মধ্যে রয়েছে ৫ বছরের জেল এবং চুরিকৃত সমুদয় অর্থ কিস্তিতে পরিশোধের সুযোগ। তবে এ প্রস্তাবে সায় দিতে চাচ্ছেন না রনজিৎ। কারণ, তাহলে জেল খাটার পরই তার গ্রীণকার্ড বাতিল করে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে ইমিগ্রেশন বিভাগ।
অপরদিকে, কলম্বিয়া কান্ট্রি ডিস্ট্রিক্ট এটর্নী পোল সিজেজকারের পক্ষ থেকে রনজিৎকে জানানো হয়েছে, স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকার না করলে চুরির দায়ে কমপক্ষে ১২ বছরের জেল খাটতে হবে তাকে।
জানা যায়, সিলেটের কমলগঞ্জের সন্তান রনজিৎ (৪৮) নিউইয়র্ক সিটির ব্রঙ্কসে ৩৫৫৪ রচেম্ব্যুতে বসবাস করতেন। ২০১৫ সালে হাডসন সিটি সংলগ্ন সেথাম সিটির ৩১০ রিজোর হিল রোডে মুনলাইট গ্যাস স্টেশনে কাজ নিয়ে সেখানে যান। বাংলাদেশী মালিক সাঈদ মোহাম্মদ খোকন তার ওপর ভরসা করেন পুরোপুরি। অর্থাৎ ঐ গ্যাস স্টেশনের আয়-ব্যয়ের ব্যাপারে কোন টেনশনে ছিলেন না তিনি। কিন্তু মাস ছয়েক পরই দেখতে পান যে বিক্রি একেবারেই কমে গেছে। এরপর গোপনে যাচাইয়ের পন্থা অবলম্বন করেন। সিসিটিভিতে দেখতে পান যে, রনজিৎ সকালে স্টোরে গিয়েই ক্যাশ বাক্স খুলে বেশ কিছু ডলার নিয়ে তা দিয়ে একই স্টোরের লটারির টিকিট ক্রয় করেন। প্রতিদিনই লটারি খেলেন চুরিকৃত ডলারে। একবার সাড়ে ৭ হাজার ডলার জয়ী হলে সেই পুরষ্কারের অর্থ ড্র করেন নিউইয়র্কে এসে আরেকটি স্টোর থেকে। লটারির রেকর্ডে এটিও উদঘাটনে সক্ষম হন খোকন। এটি ২০১৬ সালের ঘটনা।
এরপর বিষয়টি কলম্বিয়া কান্ট্রি পুলিশকে অবহিত করা হয়। সে মামলার নম্বর ২০১৯২২৪২। শুরু হয় গোপনে তদন্ত। টের পেয়ে রনজিৎ আত্মগোপন করেন। তদন্ত শেষে রনজিতের বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হয় এবং তা সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়া হয়। স্টোরের মালিকও ভেতরে ভেতরে সন্ধান করেন রনজিৎকে। কিন্তু খুঁজে পাননি। এরইমধ্যে রনজিৎ গাড়ি চালানোর সময় মহাসড়ক পুলিশের কাছে ট্রাফিক ভায়োলেশনের জন্যে জিজ্ঞাসাবাদের সম্মুখীন হলে তার ব্যাকগ্রাউন্ড খতিয়ে দেখার সময়ই সেপ্টেম্বরের শেষার্ধে গ্রেফতার হন রনজিৎ। শুরু হয় মামলা। জামিন লাভেও সক্ষম হয়েছেন তিনি।
সাঈদ মোহাম্মদ খোকন এ প্রসঙ্গে জানান, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির ভাতিজা হিসেবে আমি তাকে অনেক বেশী বিশ্বাস করেছিলাম। প্রায় সোয়াশ' মাইল ড্রাইভ করে ব্রঙ্কসের বাসা থেকে তাকে যখন কর্মস্থলে নিয়ে আসি তখনও দেখেছি সেই বাসা থেকে তার মালামাল ছুড়ে ফেলা হচ্ছে। কারণ বেশ ক’মাস ভাড়া দিতে পারেননি। এ অবস্থায় আমি চেয়েছিলাম তাকে কাজের মধ্য দিয়ে আর্থিক দুরাবস্থা কাটিয়ে উঠাতে। থাকা এবং খাওয়া ফ্রি করেছিলাম। যাতে বেতনের পুরো অর্থ সঞ্চয় করতে পারেন। এক পর্যায়ে রনজিতের এসাইলাম মঞ্জুর হলে বাংলাদেশ থেকে স্ত্রী-সন্তানকেও আনার সুযোগ পান। সেটিও করেছেন। তবে তার চুরির স্বভাবে পরিবর্তন ঘটেনি।
খোকন উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতির আত্মীয় হয়েও রনজিৎ যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের আশায় নানা কল্প-কাহিনী জমা দিয়েছিলেন ইমিগ্রেশনে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নেই বলে নানা যুক্তি অবতারণার এক পর্যায়ে বিচারপতি এস কে সিনহার গ্রামের বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের নথিও জমা দেন রনজিৎ। এরপরই এসাইলাম মঞ্জুর হয়।
সাঈদ খোকন গতকাল শুক্রবার আরো জানান, রনজিৎ যুক্তরাষ্ট্রে আসার আগে ঢাকায় আদম ব্যাপারি ছিলেন। বিদেশে পাঠানোর নামে বহু মানুষের কাছে টাকা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছিলেন। প্রতারণার অর্থ বেশী দিন টেকেনি। তাই পুনরায় চুরিবৃত্তিতে লিপ্ত হয়েছিলেন আমার স্টোরে।
এস কে সিনহা নানা পরিস্থিতির পর যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সিতে বসবাসরত অবস্থায় রনজিৎ তার সাথে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ করেছেন বলেও উল্লেখ করেন খোকন। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র থেকে কানাডা যাবার সময়েও এস কে সিনহাকে রনজিৎ সীমান্ত পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছেন।
রনজিতের মামলা প্রসঙ্গে কলম্বিয়া কান্ট্রি ডিস্ট্রিক্ট এটর্নী অফিস থেকে জানা গেছে, সিসিটিভি এবং নিউইয়র্ক স্টেট লটো কোম্পানীর সরেজমিনে অনুসন্ধানে সবকিছু সত্য বলে প্রতিয়মান হওয়ায় তাকে চুরির দায়ে জেল খাটতেই হবে। তার সাথে আলাপ-আলোচনা চলছে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী। এরপরই দণ্ড ঘোষণা করা হবে।
‘রায়ে শাস্তি যতদিনই হউক তা ভোগের পরই রনজিতকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বহিষ্কারের মুখোমুখী হতে হবে, কারণ তিনি সিটিজেন নন। এসাইলামের মাধ্যমে পাওয়া গ্রীণকার্ড বিদ্যমান রীতি অনুযায়ী বাতিল করেই তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে’-জানান নিউইয়র্কের খ্যাতনামা একজন এটর্নী।
এদিকে বহুল আলোচিত-সমালোচিত প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ভাতিজা হিসেবে পরিচয় দেয়া রনজিতের চুরি-কাণ্ডে প্রবাসেও নানা গুঞ্জন উঠেছে।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল