নকলের মহোৎসবে চলচ্চিত্রশিল্প থমকে গেছে। পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখি হলেও টনক নড়ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের। বছরে ৯৮ ভাগ নকল ছবি মুক্তি পাচ্ছে। এসব ছবি দেখতে দর্শক প্রেক্ষাগৃহে যাচ্ছে না। এতে লোকসানের কবলে পড়ে বন্ধ হচ্ছে প্রেক্ষাগৃহ। 'রাজত্ব', 'ডেয়ারিং লাভার', 'ভালোবাসা জিন্দাবাদ', 'দবির সাহেবের সংসার'সহ চলতি বছরের এ পর্যন্ত মুক্তিপ্রাপ্ত বেশির ভাগ ছবির বিরুদ্ধে নকলের অভিযোগ উঠেছে এবং এ কারণে ছবিগুলো ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়েছে। এ অবস্থায় অনিশ্চিত পথে চলছে ঢালিউড।
চলচ্চিত্রকারদের কথায়, নকলরোধে সেন্সর নীতিমালা থাকলেও অদৃশ্য কারণে সেই নীতিমালাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অহরহ নকল ছবি মুক্তি পাচ্ছে। এতে সাহসী হয়ে উঠছে নকলবাজরা। বীরদর্পে নকলের কথা স্বীকার করে উৎসাহ নিয়ে নকলের গতি বাড়াচ্ছ তারা।
চলচ্চিত্রকার ছটকু আহমেদ বলেন, ষাটের দশকে এ দেশে চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয়। তখন উর্দু ছবির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে মৌলিকত্ব দিয়ে সফল হয় ও প্রশংসা কুড়ায় বাংলা ছবি। 'সুতরাং', 'সাতভাই চম্পা', 'নবাব সিরাজদ্দৌলা', 'জীবন থেকে নেয়া', 'আনোয়ারা', 'কাঁচের দেয়াল', 'ধারাপাত'সহ অসংখ্য বাংলা ছবি দেশে বিদেশে প্রশংসিত, ব্যবসা সফল ও পুরস্কৃত হয়। সেই অবস্থা এখন আর নেই। বর্তমানে নকলের দাপটে কৌলিন্য হারিয়েছে আমাদের চলচ্চিত্র।
এ দেশে প্রথম নকলের অভিযোগ ওঠে সত্তরের দশকে 'অগি্নশিখা' শিরোনামের একটি ছবির বিরুদ্ধে। সেন্সর বোর্ড জানায়, ছবিটি কলকাতার 'মায়ামৃগ' ছবির নকল এবং বোর্ড এটি আটকে দেয়। এরপর কিছুদিন নকল প্রবণতা থমকে থাকলেও সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময়ে আবার নকলের উৎসব শুরু হয়। এবার কিন্তু সেন্সর বোর্ড অজানা কারণে নকলের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। বলিউডের 'শোলে', 'রুটি' 'দিওয়ার', 'গৌরা আওর কালা'কে হুবহু নকল করে ঢালিউডে নির্মাণ হয় যথাক্রমে 'দোস্ত দুশমন', 'একমুঠো ভাত', 'সেতু', 'নিশান' ইত্যাদি। এধরনের অসংখ্য নকল ছবিকে অবলীলায় ছাড়পত্র দিয়ে বিতর্কিত হয়ে পড়ে সেন্সর বোর্ড। এতে নকল প্রবণতা ক্রমেই বৃদ্ধি পায়। শুধু ছবি নয়, গানও হুবহু নকল হতে থাকে। আশির দশকে শতকরা ৫০টি ছবি নকল হয়। সত্তর ও আশির দশকে শীর্ষ নকল নির্মাতার তালিকায় স্থান করে নেন চিত্রপরিচালক ইবনে মিজান। আর সংগীত পরিচালক হিসেবে বেশি উচ্চারিত হতো মনসুর আলীর নাম। নব্বই দশকের শেষ দিকে সীমাহীন নকল, অশ্লীলতা, পাইরেসি ইত্যাদি মহামারী ঢালিউডের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকে দেয়। দর্শক এসব কারণে ঘৃণাভরে দেশীয় ছবি থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এতে লোকসানের কবলে পড়ে নব্বই দশক পর্যন্ত দেশে থাকা প্রায় সাড়ে বারশত প্রেক্ষাগৃহে কমে এখন সাড়ে তিনশতে এসে ঠেকেছে।
সেন্সর বোর্ডের সদস্য নায়করাজ রাজ্জাক বলেন, ষাটের দশকে এ দেশে কয়েকটিমাত্র প্রেক্ষাগৃহ ছিল। শুধু বাংলা চলচ্চিত্রের স্বর্ণযুগের কারণে ক্রমান্বয়ে এই সংখ্যা বেড়ে আশির দশকে সাড়ে বারোশতে উন্নীত হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, নব্বই দশকের শেষ ভাগে শুরু হওয়া অবক্ষয়ের কারণে প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ হতে শুরু করে। নায়করাজ রাজ্জাক বলেন, নকল প্রবণতা রোধে সেন্সর বোর্ড সদস্যদের নিয়ে শীঘ্রই একটি কমিটি গঠন করা হবে। তা ছাড়া এফডিসি থেকে ছবি নির্মাণের অনুমতি নিতে গেলে গল্প জমা দেওয়ার বিধানও করা হচ্ছে। এখন থেকে নকলকে কঠোর হস্তে দমন করা হবে।
সম্প্রতি গল্প ও গানের পাশাপাশি ছবির পোস্টারও নকল করা শুরু হয়েছে। চলতি বছর মুক্তিপ্রাপ্ত 'ডেয়ারিং লাভার' ও 'রাজত্ব' ছবি দুটির পোস্টার যথাক্রমে বলিউডের 'তিসমার খান' ও 'আর রাজকুমার' এর হুবহু নকল। এ ছাড়া এখন আবহ সংগীত, পোশাক, নাচ, সংলাপও অহরহ নকল হচ্ছে। এসবের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও সেন্সর বোর্ড নির্বিকার থাকছে। আর এ কারণেই এ সময়ের আলোচিত নকল চিত্রনাট্য রচয়িতা খ্যাত আবদুল্লাহ জহির বাবু ফেসবুকে নকলের পক্ষে স্ট্যাটাস দেওয়াসহ প্রকাশ্যে নকলের কথা স্বীকার করে বেড়াচ্ছেন। চাষী নজরুল ইসলাম বলেন, এটি অবশ্যই অনৈতিক কাজ। এ কারণে দর্শক এখন আর এ দেশের ছবি দেখে না। উন্মুক্ত আকাশ সংস্কৃতির যুগে নকল করে চোখে ধুলো দেওয়ার সুযোগ নেই।