এক্সট্রা শিল্পীদের ঘোর দুর্দিন এখন। একদিকে চলচ্চিত্র নির্মাণের সংখ্যা কমেছে, অন্যদিকে বিভিন্ন ড্যান্স গ্রুপসহ নির্মাতাদের পছন্দের মানুষ তাদের জায়গা দখল করে নিয়েছে। প্রায় দিনই পরিবার নিয়ে উপোস করতে হচ্ছে তাদের। তারপরও মন থেকে মুছে ফেলতে পারছেন না চলচ্চিত্র নামক প্রিয় শব্দটি। কেউ আবার জীবনের তাগিদে অনৈতিক পথের আশ্রয় নিয়েছেন।
নূপুর নামে সবাই তাকে চেনেন। বয়স পঞ্চাশের কোঠায়। ১৫-১৬ বছর বয়সে এক্সট্রা শিল্পী হন। ভালোই চলছিল জীবনযাপন। নব্বই দশকের শেষ ভাগে এসে চলচ্চিত্রের দৈন্যদশার কারণে জীবনে অন্ধকার নেমে আসে। পিতৃহারা সন্তানকে মানুষ করতে পরিচালক সমিতিতে ঝাড়ুদারের কাজ বেছে নিতে হয়। চলচ্চিত্রের দৈন্যদশাকে দায়ী করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন নূপুর।
নাসির এফডিসিতে পান-সিগারেট বিক্রি করেন। কিশোর অবস্থায় এক্সট্রা হিসেবে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু। তা প্রায় ৩৫ বছর হবে। এক সময় দৈনিক এক হাজার টাকা পর্যন্ত আয় হতো। ২০০৮ সালের পর নির্মাণ কমে এলে কোনো দিন ৩০০ টাকা পেলে তা দিয়ে অনাহারে সপ্তাহ পার করতে হয়। অভিনয়ের নেশায় বিয়ে করা হয়নি। বাবা-মা গত হয়েছে অনেক বছর। সন্তান হিসেবে শেষ জীবনে তাদের হাতে কিছু তুলে দিতে না পারার কষ্ট এখনো তাকে ভোগায়।
ষাটোর্ধ্ব নাজমা আক্তার এখনো এফডিসির আঙিনায় কাজের অপেক্ষায় থাকেন। তার কথায় এক সময় অবস্থা রমরমা ছিল। দাইমা, ডাক্তারের চরিত্রও করেছি। দিনে এক হাজার টাকা পর্যন্ত আয় ছিল। ৩৫ বছর আগে মেয়ে নূরজাহানের জন্মের পর চলচ্চিত্রে আসি। তখনকার দিনে সাড়ে তিন হাজার টাকা ঘরভাড়া দিতাম। এখন বস্তিতে থাকি। তখন আয়ের টাকা দিয়ে মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। এখন উপোস করি। আলেয়া বুড়ি, দিলবাহারী, শুকুর জাহানের অবস্থাও আমার মতো। তারাও নামেমাত্র বেঁচে আছে।
রাবেয়া, মর্জিনা, আলেয়া, রেবেকা, জাহাঙ্গীর, সেলিম, মেরিসহ প্রায় অর্ধশত এক্সট্রা শিল্পীর জীবন কাহিনী এমনই মানবেতর।
এক্সএক্সট্রা শিল্পীদের জুনিয়র আর্টিস্টও বলা হয়। তাদের নিয়ে জুনিয়র আর্টিস্ট অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন থাকলেও এর কোনো কার্যকারিতা নেই। প্রায় সাড়ে ৩০০ সদস্যকে সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ নামমাত্র এ সংগঠনটি। সামান্য আয়ের টাকার ২০ থেকে ৩০ শতাংশ তুলে দিতে হয় দালাল ও চাঁদাবাজদের হাতে। অভিনয় করতে গিয়ে আহত হলে চিকিৎসা পান না নির্মাতা কিংবা সংগঠনের পক্ষ থেকে। এক্সট্রাদের অভিযোগ- শিল্পী দূরে থাক, আমরা মনে হয় মানুষের কাতারেই পড়ি না। দিনমজুরের অবস্থাও এর চেয়ে ভালো। কোনো বিষয়ে প্রতিবাদ করা মানে তা অনধিকার চর্চার পর্যায়ে পড়া। চড়া মাশুল দিতে হয় এ জন্য। সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য মিজানুর রহমানের কথায়, চলচ্চিত্রের নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে, শিল্পীদের পারিশ্রমিকও বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্ত নিম্নগামী হয়েছে এক্সট্রাদের অবস্থান। কারণ এক্সট্রা বলে কথা বলার অধিকার বা মূল্যায়ন কখনো ছিল না তাদের। এখন তো চলচ্চিত্র নির্মাণের ধরন বদলেছে। আইটেম গান যুক্ত হয়েছে। নায়ক-নায়িকার সখাসখী বা গানের দৃশ্যে নির্মাতা নিজের মানুষ বা ডান্স গ্রুপের সদস্যদের আনেন। এতে প্রকৃত এক্সট্রারা বেকার হয়ে পড়েছেন।
প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার ছটকু আহমেদ, আজিজুর রহমান, শাহজাহান চৌধুরীসহ অনেক সিনিয়র নির্মাতার কথায় সব দেশের চলচ্চিত্রে অপরিহার্য এক্সট্রা শিল্পী। এফডিসি প্রতিষ্ঠার পর 'আমগাছতলা' খ্যাত স্থানে এক্সট্রাদের নির্দিষ্ট ঠিকানা গড়ে ওঠে। প্রয়োজনে নির্মাতা সেখানে হাজির হন। এক সময় রমরমা অবস্থা ছিল তাদের। সাধারণ মানুষ তাদের কদর করত। নব্বই দশকের শেষভাগে চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা শুরু হলে অনেকে বাঁচার তাগিদে বাধ্য হয়ে অশ্লীল দৃশ্যে অভিনয় করে। এরপর থেকে এসব শিল্পীকে সমাজে বাঁকা চোখে দেখা হয়। এখন তো আগের মতো ছবি নির্মাণ হয় না। তারা এখন বেশির ভাগ বেকার, নিঃস্ব। কেউ মঞ্চে উদোম নৃত্য করছেন। কেউ মিউজিক ভিডিওতে মডেল হচ্ছেন। কেউবা অনৈতিক কাজে গা ভাসিয়েছেন। অনেকেই এসবের সঙ্গে আপস না করে উপোস অবস্থায় এফডিসিতে তীর্থের কাকের মতো কাজের অপেক্ষা করছেন। এক্সট্রাদের বেশির ভাগই আসে অভাবি সংসার থেকে। তবে নায়িকা হওয়ার স্বপ্ন নিয়েও অনেকের আগমন এবং স্বপ্ন পূরণ হয়েছে। এখনকার জীবন্ত কিংবদন্তি অভিনেত্রী শাবানা অভাবের তাড়নায় নয়, চলচ্চিত্রকে ভালোবেসেই এক্সট্রা হিসেবে এ অঙ্গনে আসেন। ১৯৬২ সালে ৯ বছর বয়সে 'নতুন সুর' ছবিতে ছোট্ট মেয়ের চরিত্রে, ১৯৬৩ সালে 'তালাশ'-এ নৃত্যশিল্পী, এরপর 'আবার বনবাসে রূপবান', 'ডাকবাবু'সহ অনেক ছবিতে এক্সট্রা হিসেবে কাজ করেন। ১৯৬৭ সালে 'চকোরী' ছবির মাধ্যমে নায়িকা হিসেবে যাত্রা শুরু তার। নায়করাজ রাজ্জাকও প্রথমে কয়েকটি ছবিতে এক্সট্রা শিল্পী হিসেবেই অভিনয় করেন। পরবর্তীতে এক্সট্রা থেকে নায়ক-নায়িকা হয়েছেন আলেকজান্ডার বো, শাহীন, দিলদার, সাহারা, ময়ূরী, শানু, সূচনা, নদী, ঝুমকা, জিনিয়া, নাসরিন, সোনিয়া, মেঘা, নাগমা,শাহনূর প্রমুখ। তাই এক্সট্রা শিল্পীকে খাটোঁ করে দেখার সুযোগ নেই।