সুরস্রষ্টা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের সর্বশেষ সৃষ্টি বৈশাখী টেলিভিশনের সূচনা সংগীত। এ গান নিয়ে দারুণ আবেগপ্রবণ ছিলেন তিনি। কারণ, এ গানের মিউজিক ভিডিওতে পারফর্ম করার কথা ছিল তার। সব আয়োজনই সম্পন্ন ছিল কিন্তু পারফর্ম করা হলো না আর। হঠাৎ করেই অকালে চলে গেলেন তিনি। গানটির শুরু হলো-
লাল সবুজের এই দেশে
স্বপ্ন আসে ভেসে
পাখির গানে সূর্য ওঠে
আমার বাংলাদেশে।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের অসাধারণ সুর সংগীতে এ গানে কণ্ঠ দেন নতুন প্রজন্মের ৮ জন জনপ্রিয় সংগীত শিল্পী। এরা হলেন লিজা, মুহিন, পুতুল, নন্দিতা, স্মরণ, হৈমন্তী রতি মান, ইউসুফ এবং বংশীবাদক জালাল আহমেদ। গানের গীতিকার বৈশাখী টেলিভিশনের অনুষ্ঠান ও বিপণন উপদেষ্টা বেনু শর্মা।
বৈশাখী টেলিভিশনের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক টিপু আলম মিলনের তত্ত্বাবধানে এ গানের উদ্যোক্তা হলেন বৈশাখী টেলিভিশনের হেড অব নিউজ অশোক চৌধুরী। এ গানটি নিয়ে তিনি বলেন, এত বছরের একটি চ্যানেল অথচ কোনো টাইটেল সং নেই এটি মনে হয় ঠিক না। মূলত: এমন ভাবনা থেকেই এ কাজটি করার জন্য আগ্রহী হই। এরপর বেনু দা‘র লেখা কথাগুলোও ভালো লাগে। টাইটেল সংয়ের জন্য উপযুক্ত মনে হয়। কাজটি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের মতো গুণী মানুষকে দিয়ে করাতে পারলে ভালো হয়। দাদাও তার সঙ্গে কথা বলেন। আমিও বেশ কয়েকবার দেখা করি বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে।
অনেক দরদ আর দীর্ঘ সময় নিয়ে গানটির সুর ও সংগীত সম্পন্ন করেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। অনেক ভালোবাসা আর স্বপ্ন মিশে ছিল এ গানের সাথে। আগেই বলেছি, এ গানের কণ্ঠশিল্পীদের সঙ্গে মিউজিক ভিডিওর প্রধান চরিত্রে পারফর্মও করার কথা ছিল আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের। গানের মিউজিক ভিডিওর জন্য ১৯ দিনের শুটিং লোকেশন ছিল পুরো বাংলাদেশ। বিগবাজেটের এ গানের মিউজিক ভিডিও নির্মাণের প্রস্তুতি চলছিল বৈশাখী টেলিভিশনের। কিন্তু গত ২২ জানুয়ারি সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। ফলে স্বপ্নটা স্বপ্ন হয়েই রয়ে গেল, আর পূরণ হলো না।
সূচনা সংগীতের স্রষ্টা গীতিকার বেনু শর্মা বলেন, সম্ভবত ডিসেম্বর মাসের কথা। বৈশাখী টেলিভিশনের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদকের রুমে একদিন বৈশাখী টেলিভিশনের হেড অব নিউজ অশোক দা (অশোক চৌধুরী) বলছিলেন, আমাদের দেশে কোনো স্যাটেলাইট টিভির টাইটেল সং নেই। আমরা একটা ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিতে পারি। আমরা আমাদের বৈশাখী টিভির জন্য একটা টাইটেল সং করতে পারি। ডিএমডি সাহেবও সম্মতি দেন। ঐদিনই অথবা কোনো একদিন আমি অশোক দা’র রুমে যাই। আলোচনার এক ফাঁকে দাদা আমাকে বলেন, দাদা ৩ দিনের মধ্যে বৈশাখী টিভির জন্য আপনি একটা টাইটেল সং লিখে দিবেন। দাদার কথা শুনে তো আমি অবাক! বিজ্ঞাপনের জন্য অসংখ্য জিঙ্গেল ছাড়া হাতেগোনা কিছু গান হয়তো লিখেছি, কিন্তু অত বড় গীতিকার আমি না। আমি কি পারব? এমনই অভিব্যক্তি ছিল আমার।
দাদা বললেন, আমি আপনাকে চিনি এবং জানি। আপনিই পারবেন, অনেক ভালো পারবেন। সে আত্মবিশ্বাস আমার আছে বলেই আমি আপনাকে বলছি। টাইটেল সংটি লিখবেন এবং সুর করাবেন দেশের শ্রেষ্ঠ সুরকার, আমার ভীষণ প্রিয় মানুষ খ্যাতিমান আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে দিয়ে। আমি জানতাম, অশোক দা আমাকে বেশ পছন্দ করেন কিন্তু টাইটেল সং লেখার মতো এমন গুরু দায়িত্ব দেবেন তা স্বপ্নেও ভাবিনি।
বেনু শর্মা আরও বলেন, এরপর থেকেই আমার ভাবনায় সর্বণ ঐ সূচনা সংগীত। কথার পিঠে কথা বসিয়ে শুধু সাজানোর চেষ্টা। এর পরের দিন পিসিআর প্যানেলে কাজ করছি। হঠাৎ করেই গানের মুখটা আবিষ্কার করে ফেলি। লিখার পর ভাবি, মন্দ না। আমি আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি। কারণ, মুখটা যখন লিখেছি তখন পুরো গানটাও হয়ে যাবে। রাতে বাসায় ফিরে লিখতে বসি। এক সময় পুরো গানটাই সম্পন্ন করে ফেলি। গানটা লিখে এক রকম ভালো লাগা কাজ করে আমার ভিতর। অফিসে তা কম্পোজ করে অশোক দা’কে দেখাই। গান পেয়ে তিনি অভিভূত। গানটাতে বারবার চোখ বোলান। এক সময় প্রথম চার লাইন গাইবার চেষ্টা করেন। গানের এই চারটি লাইন তাকে ভীষণ আলোড়িত করে।
তিনি বলে ওঠেন, দাদা আপনি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলেন। গানটা বুলবুল ভাইয়ের মতো গুণী মানুষকে দিয়েই করাতে হবে। যত টাকা লাগুক সেটা আমি দেখব। তার সঙ্গে আমিও কথা বলতে চাই। আপনি সব ব্যবস্থা করুন।
বেনু শর্মা বলেন, এরপর আমি ফোন করি বুলবুল ভাইকে। তিনি জানান, বাসা বদলের ঝামেলা ছাড়াও তিনি ভীষণ ব্যস্ত। আমি যেন একমাস পর তাকে ফোন করি। মাসখানেক পর ফোন করি বুলবুল ভাইকে। তিনি বাসায় যেতে বলেন। অশোক দা’র যাওয়ার কথা থাকলেও ব্যস্ততার কারণে তিনি সেদিন যেতে পারেননি। আমি সম্ভবত বৈশাখী টেলিভিশনের প্রোগ্রাম ম্যানেজার লিটু সোলায়মানকে সঙ্গে নিয়ে বুলবুল ভাইয়ের বাসায় যাই। আলোচনার এক পর্যায়ে আমার লিখা গানটি তার হাতে দিই। তিনি গানের কথাগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে পড়েন। এত বড় মাপের একজন সুরকার, গীতিকার আমার লিখা গান দেখছেন! এক রকম উৎকণ্ঠা কাজ করে আমার ভিতর। এক সময় হঠাৎ করেই নরম সুরে প্রশ্ন করেন, গানটা কে লিখেছে গো?
তার এমন প্রশ্নে আমি স্মিত হাসি। তিনি পুনরায় আগের মতোই প্রশ্ন করেন,গানটা কে লিখেছে গো?
আমি বলি, কেন ভাই?
না না, বলুন না কে লিখেছে? বলেন বুলবুল ভাই।
কেমন হয়েছে বুলবুল ভাই? বিনয়ের সাথে জানতে চাই আমি।
বুলবুল ভাই তখন দারুণ উচ্ছ্বসিত! আবেগপ্রবণ হয়ে বলে ওঠেন, এ গানে তো আমি পুরো বাংলাদেশকে দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি, নদীর পাড় আর ধান ক্ষেতের আল দিয়ে বাংলাদেশের পতাকা হাতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা ছুটে চলেছে। আমি দেখতে পাচ্ছি বাংলার কৃষক দলবেঁধে ক্ষেতের ধান কাটছে। পুরো গানেই যেন বাংলার রূপ, রস, প্রকৃতি, কৃষ্টি, কালচার ইত্যাদি। আমি, আমি, হ্যাঁ আমিই এই গানটা সুর করব। তার উচ্ছ্বাস দেখে খুব ভালো লাগে আমার। অফিসিয়াল যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে গানটা তার কাছে রেখে আসি। অশোক দা’ও দেখা করেন তার সাথে। তিনিও তার স্বপ্নের কথা বলেন। আমাদের স্বপ্নের সমান জায়গাটা যেন স্পর্শ করেন বুলবুল ভাই। প্রথম ভেবেছিলাম এ গানটি গাইবেন সিনিয়র শিল্পীগণ। সে অনুযায়ী ২০ জন গুণী শিল্পীর তালিকাও তাকে দিয়েছিলাম। কিন্তু সিনিয়র শিল্পীদের নিয়ে এ কাজটি করার পক্ষে তিনি ছিলেন না।
তিনি বললেন, এ গানটি গাইবে নতুন প্রজন্মের জনপ্রিয় শিল্পীরা। তারা হবে যেমন ভালো গাইয়ে তেমনি দেখতেও হবে দারুণ। নির্মিত ভিডিও দেখে মনে হবে একেকজন বাগানে সাজানো সুন্দর সুন্দর ফুল হয়ে ফুটে আছে।
এবার বেনু শর্মা আক্ষেপের সুরে বলেন, খুব কষ্ট লাগছে,যে গান নিয়ে তিনি এত আবেগপ্রবণ ছিলেন সেই গানে তিনি পারফর্ম করতে পারলেন না, শেষটা দেখে যেতে পারলেন না।
বেনু শর্মা আরও বলেন, শট ডিভিশনের কাজে যারা সহযোগিতা করেছেন তারা হলেন, বৈশাখী টেলিভিশনের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান সম্পাদক টিপু আলম মিলন, প্রোগ্রাম ম্যানেজার লিটু সোলায়মান, প্রযোজক মামুন আব্দুল্লাহ এবং দেবাশীষ বাপ্পী।
বৈশাখী টেলিভিশনের হেড অব নিউজ অশোক চৌধুরী বলেন, কাজটি যদিও সম্পন্ন হয়েছে কিন্তু এখনো আলোর মুখ দেখেনি। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল ভাইয়ের এই অসাধারণ সৃষ্টিকে বাঁচিয়ে রাখতেই নিকট সময়ে গানটির মিউজিক ভিডিও নির্মাণের শুটিং শুরু হবে। খুব শীঘ্রই বৈশাখী টেলিভিশনের দর্শক মিউজিক ভিডিও আকারে এ টাইটেল সংটি পর্দায় দেখতে পাবেন বলে আশা রাখি।
গানের রেকর্ডিস্ট সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার ফয়সাল বিন ফিরোজ রোজেন বলেন, গত তিন বছরে বুলবুল ভাই এ গানের জন্য যত সময় দিয়েছেন এবং যত যত্ন নিয়ে কাজটি করেছেন অন্য কোনো গানের ক্ষেত্রে এমনটি দেখিনি। এ গানটি নিয়ে তার অনেক আশা ছিল। ছিল দুর্বলতাও। ৯ জন ভায়োলিন শিল্পীসহ অক্রেস্টা দলকেও ঠিক করে রেখেছিলেন তিনি। প্রচণ্ড দেশপ্রেম আর মিউজিক ভিডিওতে তার পারফর্ম করার কথা ছিল বলেই হয়তো তার এত যত্ন।
(সিনিয়র এক্সিবিউটিভ, মিডিয়া রিলেশন, বৈশাখী টিভি)
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা