সুন্দরবনের এক অজপাড়াগাঁ থেকে উঠে আসা আমি হলাম চৌদ্দপুরুষের মধ্যে প্রথম ডাক্তার। তাই বাবা-মা-ভাইবোনের আমাকে নিয়ে যতখানি স্বপ্ন , পাড়াগাঁয়ের অন্যসকলেরও তেমনি কম নয়। কিন্তু পাশ করার ছয় ছয়টি বছর পার হয়ে গেলেও তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কোন সম্ভাবনা দেখা না দেয়ায় তা যেন দুঃস্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে। দিন আনি দিন খাই অবস্থা।
'সিম্পল' এমবিবিএস ডাক্তারের ভাত নেই এদেশে। তাই 'কমপ্লেক্স' ডাক্তার হওয়ার প্রাণপন সাধনায়, মরণপণ সংগ্রামে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলাম। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকের আগস্ট মাসের এমনি এক সন্ধিক্ষণে আমাদের মিনি পৃথিবীর আলো দেখল।
তারপর দিন গড়িয়ে মাস আসে, মাস গড়িয়ে বছর , বছর গড়িয়ে যুগ। কেওড়া নদীর বাঁকে বাঁকে শেওলা জমে, ঘোলা জলে স্মৃতি ঝাপসা হতে হতে আমিও সিম্পল থেকে কমপ্লেক্স ডাক্তার বনে গেলাম। আমাদের মিনিও হামাগুড়ি দিতে দিতে একসময় বিজ্ঞানের সব কমপ্লেক্স সূত্রগুলো কত সহজে সিম্পল করে দিতে থাকে। আর আমরা বিস্ময়-বিস্ফারিত নেত্রে তার চোখের তারায় আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া আলোর ঝলকানি দেখে অভিভূত হয়েই চলেছি।
সমস্তদিনের কর্মক্লান্ত আমি ঘরে ফিরে আমার মিনির একটি 'বাবা' শব্দে সতেজ হই, নতুন করে বেঁচে উঠি। কত হাসি, কত রাগ, কত অভিমান, কত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার অফুরান শোকগাঁথা। পাওয়া না পাওয়ার কত বেদনার জাল বুনতে বুনতে আমাদের মিনি হঠাৎ একদিন বড় হয়ে গেল!
আজ আমাদের সেই মিনি বিজ্ঞানের কঠিন কঠিন সূত্রগুলো আরও সহজ করতে চাঁদের দেশে প্রথম মানব নীল আর্মস্ট্রংয়ের দেশ সুদূর আমেরিকায় যাত্রা করছে।
মিনির মালপত্র গোছগাছ চলছে। কাপড়চোপড় বাক্সবন্দী হচ্ছে। চারিদিকে টুংটাং শব্দ। বাইরে কোন আলোকসজ্জার ব্যবস্থা হয়নি। কোন সানাইও বাজছে না। অথচ বলা নাই কওয়া নাই কোথাকার কোন্ এক নিষ্ঠুর কাবুলিওয়ালা হঠাৎ আমার বুকের পাঁজরের ভেতর ঢুকে পড়ে আমার মিনিকে ছিনিয়ে নিতে উদ্যত হল।
বারবার চশমার কাঁচ পরিস্কার করে যাচ্ছি, কিন্তু পোড়াচোখে কিছুই পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি না।
লেখক : ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের সিনিয়র কন্সালট্যান্ট ও সিসিইউ ইনচার্জ
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/২৩ ডিসেম্বর, ২০১৬/ফারজানা