বছর পনেরো আগের কথা। আমাদের টোনাটুনির সংসারে দেশ থেকে ২০/২২ বছরের খুব কাছের এক আত্মীয় আসে এদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের উদ্দেশ্যে। বেশ কিছুদিন বাদে একদিন সাহেবকে বললাম ওকে আপাতত অন্য আত্মীয়ের বাসায় রেখে আসতে। আমি সুস্থ হবার পর যেন আবার নিয়ে আসে।
বলতে দ্বিধা নেই, জীবনে প্রথমবারের মতো কোন অতিথির আগমনে বিরক্তই হলাম। কেননা, একদিকে প্রথমবারের মতো মা হতে চলেছি, শারীরিক নানান জটিলতা ছিল। চাকুরি সামলে বাড়ি ফিরে বমি আঁটকে রান্না করা, অতিথি আপ্যায়ন বেশ কষ্টকরই ছিল।
তাকে চাকুরি ঠিক করে দেয়া হল। বেশ কিছুদিন বাদে আমরা আবিস্কার করলাম, চুপচাপ শান্ত ছেলেটি কাজ করতে চাইছে না।
কখনো রুমে, কখনো সোফায় বসে ঝিমায়। ঝিমাতেই থাকে দিনভর। কিছুই স্বাভাবিক ঠেকছে না। হাসপাতালে নিয়ে যাই। প্রাথমিক চিকিৎসার পর যে ডিপার্টমেন্টে পাঠানো হল, সেখানকার ওয়েটিং রুমের অন্যসব রোগীদের দেখে আঁতকে উঠলাম। সকলেরই একই রকম চাহনি, অস্বাভাবিক আচরণ, ঝিমাতে ঝিমাতে ডানে বাঁয়ে হেলে যাচ্ছে।
লোহার গেইটে দাঁড়ানো বিশালদেহী লোকটির কাছে জানতে চাইলাম, ওকে এখানে কেন রাখা হয়েছে ? বলল, এরা সবাই একই ধরনের রোগী বিধায় ডাক্তার দেখে ব্যবস্থা নিবে।
কন্কনে শীতের সেই রাতে দোকানপাট সব বন্ধ। হেঁটে অনেক খুঁজে ব্রডওয়েতে যে খাবারের দোকানটি খোলা ছিল, তা থেকে কিছু খাবার কিনে হাসপাতালে দিয়ে বাড়ি ফিরি। পরদিন ফোন আসে, তোমাদের রোগীকে ফ্লাশিং অমুক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সেখানে ছুটে যাই। ভিজিটর রুমে আমি একা অপেক্ষায়।
ছেলেটিকে নিয়ে আসা হল। টুকটাক কথা সেরে জানতে চাইলাম ফের আসবার সময় কিছু নিয়ে আসবো? বলল, কিছু কয়েন নিয়া আইসেন ভাবী, ফোনে এদিক সেদিক কথা বলবো।
হাসপাতাল থেকে দু'দিন বাদে ফোনে জানালো, তোমাদের রোগীকে ম্যানহাটন অমুক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। সেখানে চিকিৎসা চলবে। আবারো দেখা করতে গেলাম সেই হাসপাতালে। ওয়েটিং রুমে দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে তাকে আনা হল। এবার আগের চেয়েও আরও অসুস্থ মনে হল। মুখভর্তি দাড়ি, চক্ষু যুগল রক্তাক্ত। জানলাম স্যালাইন, ইনজেকশন, ঘুমের ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় এমন হয়েছে। সপ্তাহ তিনেক বাদে অনেকটা সুস্থ হলে বাড়ি নিয়ে আসা হল তাকে। আমরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
ক'মাস বাদে আবারও সেই অসুস্থতা। হাসপাতালের আগের অভিজ্ঞতার কারণে এবার আর কিছুতেই সেখানে যেতে রাজি হল না সে। অসুস্থতা যেহেতু মানসিক, তাই বুঝতে চেষ্টা করছিলাম মনজগতের সমস্যাগুলো।
বলল, প্রতিনিয়ত প্রতিমুহূর্তে কানের কাছে কেউ যেন কথা বলে, মাথার ভেতরে কেবলই অস্বাভাবিক কিছু শব্দ শুনতে পায়, অনেক কোলাহল কিংবা হাতুড়ি পেটার শব্দ। খুব করে বুঝালাম, সব অসুখেরই প্রতিকার, প্রতিরোধের ব্যবস্থা আছে। বুঝিয়ে শুনিয়ে আবারও হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। দিনভর প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে আমাদের বসিয়ে রাখলো ওয়েটিং এ। শেষে হাতে ধরিয়ে দিলো একটি হাসপাতালের নাম, ঠিকানা।
তখন রাস্তাঘাট তেমন চিনি না। একে ওকে জিজ্ঞেস করে কখনো ভুল পথে, কখনো পথ চিনে নিয়ে যাই জ্যামাইকার সেই হাসপাতালে। তাদের তত্ত্বাবধানে ছেলেটিকে রেখে যখন বাড়ির দিকে ফিরি, তখন শহরে প্রায় মধ্যরাত। ততক্ষণে ছোট্ট রিয়াসাত মায়ের সাথে হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত। ভীষণ ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত আমিও। ওই অবস্থায় ঘুমন্ত রিয়াসাতকে কোলে নিয়ে সেদিন বাড়ি ফিরেছি কেমন করে, তা আজ আর মনে করতে পারি না।
মাঝে ভালোমন্দে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর।
আজ সে দেশে ফিরে যাচ্ছে। যাবার সময় পা ছুঁয়ে সালাম করছিলো যখন, আমি আশীর্বাদের হাতখানি মাথায় রাখি। মনে মনে বলি, স্রষ্টা, তুমি সকলকে ভালো রেখো। ততক্ষণে সিঁড়ি বেয়ে তার নেমে যাবার শব্দ ভেসে আসে কানে।
ছুটে বেলকনিতে যাই, বাকিটুকু চলে যাওয়া দেখি সেই মানুষটির, একদিন যার আগমনে আমি খুশি হতে পারিনি।
দু'দিনের পৃথিবীতে আমরা মানুষেরা একে অন্যকে ঘৃণা করি, ঈর্ষা করি!
আমরা ভুলে যাই, সুস্থ থাকার চেয়ে সুন্দর এবং আনন্দের কিছু নেই।
সবাইকে মাহে রমজানের শুভেচ্ছা...
(লেখকের ফেসবুক পেজ থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/৩০ মে, ২০১৭/ফারজানা