সেদিন এক সরকারি কাজে কক্সবাজার যাই। সন্ধ্যার পর তিনজন অনুজ সহকর্মীকে নিয়ে সমুদ্রদর্শনে গেলাম। সৈকত ধরে আমরা হাঁটছি, গল্প করছি আর সাগরগর্জনের অপরূপ শব্দ ও দৃশ্য উপভোগ করছিলাম। ঢেউগুলোকে দূর থেকে ভাসমান সাদা সাদা পাহাড়ের মতো দেখাচ্ছিল। অন্ধকার ভেদ করে তারা যেন একে অপরকে ধরার জন্য নিরন্তর তীরের দিকে ধাবমান। বলছে যেতে নাহি দিব। কুলে এসে আঁচড়ে পড়ছে তরঙ্গের পর তরঙ্গ। সাগরবিলাসী নানা মানুষ তা দেখছে। কেউ জল স্পর্শ করছে কেউ বা বালিতে গড়াগড়ি দিচ্ছে। কেউ সমুদ্রস্নানে পুত-পবিত্র হচ্ছে। নানা বয়েসি মানুষের মেলা বসে প্রতিদিন এ উপকুলে।
কক্সবাজারের সমুদ্রসৈকত নিয়ে আমরা কতকিছু বলছি, যার শেষ নেই। সবাই বলছি Longest sea beach in the world। কেউ বলছে Longest sandy beach on earth। কক্সবাজার-ইনানি-টেকনাফ পর্যন্ত প্রায় ৮৫ কিঃ মিঃ বালুময় বিচ। শতাব্দী কালব্যাপী প্রায় একই অবস্থানে থেকে আমাদের Bay of Bengal নিম্ন গাঙ্গেঁয় এ ব-দ্বীপকে দিয়ে যাচ্ছে গৌরবময় বিপুল জলরাশি আর জলজ সম্পদের অফুরন্ত ভান্ডার।
পৃথিবীতে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ বিচ বা সমুদ্র সৈকতের দৃশ্যাবলী উপভোগ করছে। কেবল একান্ত শান্তির অন্বেষণে সপরিবারে বেড়াতে গিয়ে কোটি কোটি টাকা তারা অবলীলায় ব্যয় করছে। বাংলাদেশ থেকেও হাজার হাজার মানুষ যাচ্ছে বালি, গোয়া, পাথায়া, অস্ট্রেলিয়া বা ইউরোপ-আমেরিকার নানা সমুদ্র সৈকতে। অথচ আমাদের এই অসাধারণ ন্যাচারাল বীচটি’র প্রায় পুরোটাই অব্যবহৃত। ভাবতে কস্ট লাগে, দুঃখবোধ কাজ করে।
সন্ধ্যার আগেই আমরা ইনানি বিচ যাই। নয়নাভিরাম ‘মেরিন ড্রাইভ’ সড়কটি ব্যবহার করি। বিস্মিত হওয়ার মত, ছুটির দিন অথচ বাইরের পর্যটক তেমন কোথাও নজরে পড়েনি। পথে দামি কোন গাড়িও চোখে পড়ে নি। আমরা ইনানিতে গিয়ে সুর্যাস্ত পর্যন্ত থাকি। ছিল না কোন বাইরের অতিথি দর্শনার্থী। লোক সমাগম নেই বললেই চলে। এর একটি প্রধান কারণ বোধ হয়, একই স্থানে মানুষ কতবার যাবে? বৈচিত্র খোঁজাই মানুষের ধর্ম। তবে ইনানিতে খুব সুন্দর একটি হোটেল/রিসোর্ট হয়েছে। ‘রয়েল টিউলিপ’ নামের হোটেলটি এলাকাটিকে সামগ্রিকভাবে সমৃদ্ধ করেছে। উদ্যোক্তাদের রুচির প্রশংসা করতে হয়। এমন আরো হওয়া চাই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ‘মেরিন ড্রাইভ’ সড়কটি এখন পর্যন্ত অসাধারণ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি এটি উদ্ভোধন করেছেন। ভারী যানবাহন চলাচলে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ বহাল থাকলে সড়কটি অনেক দিন বেঁচে থাকবে। যেন সড়কই দীর্ঘতম এ বিচের প্রাণ।
আমরা বলি, অমিত সম্ভাবনার দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। এতে কোন সন্দেহ নেই। শুধুমাত্র কক্সবাজার জেলাই দেশের চেহারা পাল্টে দিতে পারে। কক্সবাজারেই পর্যটন কর্পোরেশনের প্রধান কার্যালয় হতে পারে। বিদেশী উদ্যোক্তা বা বিনিয়োগকারীদের নিয়ে সকল প্রকার সভা-সেমিনার সেখানেই হতে পারে। যেখানে অসংখ্য পাঁচ তারকা মানের হোটেল রয়েছে। সভা, সেমিনার ওয়ার্কশপ বা যে কোন সম্মেলন করার মত বিশ্বমানের সুযোগ রয়েছে। এমনকি সরকারি স্থাপনাও রয়েছে পর্যাপ্ত। যেখানে বিদেশি অতিথিবৃন্দ অনায়াসে সাময়িকভাবে অবস্থান করতে পারে। আমাদের ঐতিহাসিক সমুদ্রজয় এবং এর অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা নিয়ে সবকিছু হতে পারে স্পটে অর্থাৎ কক্সবাজারে। আকাশ পথে মাত্র পঞ্চাশ মিনিটের ভ্রমন। এতে কী কারো খুব সমস্যা হবে?
আসলে প্রাইভেট সেক্টরকে কাজে না লাগাতে পারলে কক্সবাজার সী-বিচের কেন্দ্রস্থল লাবনি পয়েন্ট থেকে মাত্র দেড়-দুই কিঃ মিঃ সরাক্ষণ মানুষের পদচিহ্নে মুখরিত শুকনো জায়গাটি ব্যবহার করা ছাড়া আর সম্প্রসারিত হবে বলে মনে হয় না। একটি মাত্র রাস্তার উন্নয়ন তথা নির্মাণাধীন হোটেল বা রিসোর্ট ভবন দিয়ে পর্যটন শিল্পের উল্লেখযোগ্য কোন সফলতা আসবে না। একে ক্রমাগতভাবে বাড়িয়ে অন্ততঃ ইনানি অভিমুখে যেতে হবে। বিভিন্ন স্পটে হেলিকপ্টার নামার সুবিধা দিতে হবে। একটি আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর জরুরী। এসব কাজে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, বড় বড় শিল্পপতি ও সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। অতি রক্ষণশীলতা উন্নয়নের পথে মারাত্মক বাঁধা। এটি পৃথিবীর সকল দেশের জন্যই প্রযোজ্য।
আমার কাছে মনে হয়, বিগত পঞ্চাশ বছর যাবৎ কক্সবাজার সী-বিচ খুব একটা প্রসারিত হয়নি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেও যারা কক্সবাজার সাগর সৈকতের নোনা জলে পা ভিজিয়েছেন আজকের অশীতিপর বা বয়োবৃদ্ধ নাগরিক আপনি নিজে গিয়ে দেখুন, বিচ ব্যবহারের স্থানটুকু তেমনই আছে। শুধু নতুন নতুন কিছু নামি-দামি অট্টালিকা ক্রমাগত আকাশকে স্পর্শ করছে। থাকা-খাওয়াও সহজলভ্য হয়েছে। তবে বিদেশী-বান্ধব পর্যটন নগরী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদেরকে আরো অনেক কিছু করতে হবে। আমি আশাবাদী মানুষ।
লেখক : সরকারি কর্মকর্তা
(মো: আবদুল মান্নানের ফেইসবুক পেইজ থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/ সালাহ উদ্দীন