আমার মা তখন বেশ অসুস্থ। দেশের ডাক্তাররা প্রায় আশাই ছেড়ে দিয়েছেন। আমি বিদেশে বসে চারপাশ অন্ধকার দেখছি। এর মাঝে যোগাযোগ করলাম আমার এখানকার একটা হসপিটালে। ডাক্তার বললেন- আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি।
মা আসলেন আমার এখানে। আমি এক হাতে অফিস করছি, মা'র জন্য রান্না করছি, মা'কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি, হাসপাতালে যাচ্ছি, মায়ের সেবা যত্ন করছি।
ক্যান্সারে'র একদম শেষ পর্যায়ে এসে ধরা পড়েছে।
ডাক্তারের কাছে যেদিন প্রথম মা'কে নিয়ে গেলাম; মা ডাক্তারের ভাষা বুঝে না; ডাক্তার মায়ের ভাষা বুঝে না। আমি ছিলাম দুজনের মাঝে যোগাযোগের মাধ্যম।
ডাক্তার এতো চমৎকার করে, এতো সাবলীল আর হাসিখুশি মুখ নিয়ে কথা বলছিল; আমি নিজে'ই মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম।
চলে আসার সময় আমার মা আমাকে বললেন- 'তুই ডাক্তার'কে বলে দে- উনার কথা শুনে'ই আমার মনে হচ্ছে আমি অর্ধেক ভালো হয়ে গিয়েছি।'
অথচ আমার মা কিন্তু তার মুখের ভাষা কিছু বুঝতে পারেনি। স্রেফ তার শরীরের ভাষা দেখে'ই আমার মা এমন'টা বলেছিলেন।
আমার মনে আছে, একবার এই ডাক্তার গিয়েছে কোন এক কনফারেন্সে অন্য আরেক দেশে। সেখান থেকে'ই সে আমাকে ই-মেইল করে জানিয়েছে- 'তোমার মায়ের ওষুধ তো মনে হয় এই সপ্তাহে শেষ হয়ে যাবার কথা। তাকে বলো এটা যেন আরেক সপ্তাহ খায়।'
অর্থাৎ তিনি নিজ থেকে মনে করে আমাকে মেইল করেছেন।
আমার মা এখন আর এই পৃথিবী'তে নেই। কিন্তু এই ডাক্তারের কথা আমি আজীবন মনে রাখবো।
অথচ এই তো সপ্তাহ দুয়েক আগে টেলিভিশনে দেখছিলাম বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে'র এক ছাত্র তার বাবা'কে নিয়ে গিয়েছে এক হাসপাতালে।
ওই ছাত্র চাকমা কিংবা মারমা সম্প্রদায়ের হবে হয়ত। সে নিজে বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারে। কিন্তু তার বাবা বলতে পারে না। খুব স্বাভাবিক। যেহেতু তাদের ভাষা ভিন্ন, আর তার বাবা যেহেতু পড়াশুনা করেনি, তাই তার পক্ষে বাংলা ভাষা শেখা সম্ভব হয়নি।
তো, এই ছেলে তার বাবা'কে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে ওই ডাক্তার নাকি বলেছে- আপনার বাবা বাংলায় কথা বলতে পারে না কেন?
উত্তরে ছেলে'টা বলেছে- আমাদের তো ভাষা ভিন্ন। আমার বাবা পড়াশুনা করেন'নি। তাই বলতে পারে না।
ওই ডাক্তার এরপর বলেছে- বাংলাদেশে থেকে বাংলা পারেন না। আপনাদের তো সাহস কম না।
এরপর নাকি অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে এমন'কি চিকিৎসা সেবা দিতেও অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
আমি ভাবছিলাম আমার কথা। আমার মা তো এই দেশের ভাষা জানতেন না। আমি নিজেও জানি না। স্রেফ ইংরেজি দিয়ে'ই তো চালিয়ে নিয়েছে। ভাগ্যিস কেউ বলে বসেনি- এই দেশে থেকে এই দেশের ভাষা জানে না, আপনাদের চিকিৎসা দেব না!
বাংলাদেশ জাতীয় দলের অধিনায়ক মাশরাফি, যিনি এখন নড়াইলের সাংসদ'ও। সে বোধকরি গতকাল এক হসপাতাল পর্যবেক্ষণে বের হয়েছিল।
গিয়ে দেখে- সেখানে মাত্র দুই জন নার্স উপস্থিত আছে; ডাক্তার বোধকরি একজন ছাড়া আর কেউ নেই! এরপর বোধকরি মাশরাফি ওই হাসপাতালে'র ডাক্তারদের উদ্দেশ্য করে বলেছে- চাকরি করতে হলে ঠিক মতো করুন, অফিসে সব সময় উপস্থিত থাকবেন; নইলে চাকরি ছেড়ে চলে যান।
তো, আমাদের ডাক্তার সমাজের মাশরাফি'র এই কথা ভালো লাগবে কেন! এরা এখন দল বেধে মাশরাফি'র চৌদ্দ গুষ্ঠি উদ্ধার করছে।
এক ডাক্তার লিখেছে- 'যেই দেশে এখনও সরকারি হাসপাতালে রোগী'রা বেড না পেয়ে মেঝেতে শুয়ে থাকে, সেই দেশে মাশরাফি'র মতো খেলোয়াড়ের পেছনে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করার কোন মানে হয় না। ওর উচিত খেলা ছেড়ে দেয়া।'
আরেক ডাক্তার লিখেছে- 'ব্যাটা একটা মূর্খ। পড়াশুনা তো মনে হয় কিছু করে নাই। সেভেন পাশ করেছে মনে হয়। আবার ডাক্তারদের নিয়ে কথা বলতে আসে!'
চিন্তা করে দেখুন অবস্থা! অন্যায় করল এরা। কোথায় অপরাধ স্বীকার করে নিবে। সেটা না করে উল্টো অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গাইছে!
তাও ভালো, আমাদের ডাক্তার সমাজ বলে বসেনি- মাশরাফি এবং তার পরিবারকে তারা আর চিকিৎসা সেবা দেবে না! একবার ডাক্তারদের নিয়ে পত্রিকায় একটা লেখা লেখার কারণে ডাক্তারদের এক ফেসবুক গ্রুপের লোকজন এসে ঘোষণা দিয়েছিল- তারা আমাকে চিকিৎসা সেবা দেবে না!
এরা ডাক্তার হয়েছে কিভাবে এটা'ই তো একটা চিন্তার বিষয়! যেই ডাক্তার বলতে পারে খেলাধুলার কোন দরকার নাই, সব টাকা চিকিৎসার জন্য বরাদ্ধ করা হোক; সেই ডাক্তার কি আদৌ পড়াশুনা করে ডাক্তার হয়েছে?
ওই ডাক্তারের কি জানা আছে প্যালেস্টাইন এর মতো প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যাওয়া রাষ্ট্রও নিয়ম করে ফুটবল খেলে এবং আমাদের চাইতে ভালো'ই খেলে! ওই ডাক্তারের কি জানা আছে- যুদ্ধের মাঝেও আফগানিস্তান ক্রিকেট দল তাদের ওয়ানডে স্ট্যাটাস পেয়েছে; এখন টেস্টও খেলে। ওই ডাক্তারের কি জানা আছে আফ্রিকার অতি দরিদ্র দেশ ক্যামেরুন বিশ্বকাপ ফুটবল পর্যন্ত খেলে?
তো এরা যুদ্ধে কিংবা দুর্ভিক্ষে'র মাঝেও খেলাধুলা করে কেন?
কারণ বেঁচে থাকার জন্য সব কিছুর'ই দরকার আছে।
অথচ ওই ডাক্তার এই বেসিক জিনিস'টা পর্যন্ত জানে না। উল্টো বলছে
-মাশরাফি তো মূর্খ। তার কি কোন পড়াশুনা আছে নাকি!
যেই পড়াশুনা শিখে আপনারা মানুষ'কে মানুষ মনে করেন না; মানুষ হত্যা'র লাইসেন্স পান; সেই পড়াশুনা করা আপনাদের মতো শিক্ষিত মানুষজনের আমাদের দরকার নেই।
আমাদের বরং মাশরাফি'র মতো লোক দরকার- যে মানুষ'কে মানুষ মনে করে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ব্যবসায়ী না!
(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)
বিডি প্রতিদিন/এনায়েত করিম