জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে প্রথম দিনের বৈঠকে সংবিধান সংস্কারের ২৫টি প্রস্তাবে একমত বলে জানিয়েছে বিএনপি। এ ছাড়া ২৫ প্রস্তাবে আংশিক একমত এবং বাকিগুলোতে একমত হতে পারেনি দলটি। সংবিধান সংস্কার বিস্তারিত প্রতিবেদনে ১৩১টি প্রস্তাব থাকলেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের স্প্রেডশিটে মাত্র ৭০ প্রস্তাব। সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবের সঙ্গে স্প্রেডশিটের ‘বিস্তর ফারাক’ দেখে বিভ্রান্ত বিএনপি। ৬ ঘণ্টার বৈঠক শেষে এ তথ্য জানান বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ। গতকাল জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের (এনসিসি) সঙ্গে সংলাপে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য সফর রাজ হোসেন, বিচারপতি এমদাদুল হক, বদিউল আলম মজুমদার ও ড. ইফতেখারুজ্জামান। বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে সংলাপে অংশ নেন দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাঈল জবিউল্লাহ, রুহুল কুদ্দুস কাজল ও মনিরুজ্জামান খান। সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘স্প্রেডশিট দিয়ে আমাদের ওনারা বিভ্রান্ত করেছেন। এটা দেওয়া উচিত হয়নি। স্প্রেডশিটে সংক্ষিপ্ত হ্যাঁ/না জবাব দেওয়ার জন্য যে কাগজগুলো দিল তাতে করে অনেকটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।’
বিএনপি সংবিধান, বিচার বিভাগ, প্রশাসন, নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত মতামত জমা দিয়েছে বলে জানান সালাহ উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আজকে হার্ড কপি জমা দিয়েছি। এগুলোর ওপরে বিস্তারিত আলোচনা চলছে। সংবিধান সংস্কার দিয়ে শুরু করেছি। আমরা এই আলোচনা চলমান রাখতে চাই। রবিবার আবার আলোচনা হবে। আমরা বোঝাতে চাই বিএনপি সংস্কারের বিষয়ে কতটা সিরিয়াস।’
সংবিধান সংস্কার কমিশনের বিস্তারিত প্রতিবেদনে ১৩১টি প্রস্তাব থাকলেও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের স্প্রেডশিটে ৭০টি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে মন্তব্য করে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘সংবিধানের প্রস্তাবনা হতে শুরু করে প্রজাতন্ত্র, রাষ্ট্রের মূলনীতিসহ সব বিষয়ে দফায় দফায় আলোচনা করব। সংবিধান সংশোধনসংক্রান্ত মৌলিক প্রস্তাবের বিষয়ে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে চেষ্টা করব এক জায়গায় আসার। বিএনপি সংবিধান সংস্কার কমিশনের ২৫টি প্রস্তাবে একমত, ২৫টির মতো বিষয়ে আংশিকভাবে একমত। বাকি বিষয়গুলোতে একমত হতে পারিনি।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যেসব বিষয়ে বিস্তারিত মতামত দিয়েছি, সে বিষয়ে কমিশনকে যৌক্তিকভাবে বোঝাব এবং তাদের প্রস্তাবের বিষয়েও আমরা যৌক্তিকভাবে জানতে চাচ্ছি। যেটা যৌক্তিক, জাতির কল্যাণের দিকে লক্ষ রেখে আমরা সেটা অবশ্যই বিবেচনা করব।’
বিচার বিভাগের মতামত নিয়ে প্রতিবেদনে মিস লিড করা হয়েছে দাবি করে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিস্তারিত প্রতিবেদনের ১৫০টি মতামতের মধ্যে ৮৯টির বিষয়ে মতামত দিয়েছি বাকিগুলোর অধিকাংশ ক্ষেত্রে একমত হওয়া বা মন্তব্যসহ একমত হওয়ার কথা জানিয়েছি।’
হ্যাঁ/না তে মতামত চাওয়া বিষয়ের বিস্তারিত প্রতিবেদনের বিস্তর ফারাক আছে জানিয়ে তিনি বলেন, সংবিধানের ৯৫ অনুচ্ছেদ অনুচ্ছেদের সংশোধনী ব্যতিরেকে বিচারক নিয়োগের অধ্যাদেশ জারি করা ততক্ষণ পর্যন্ত অসাংবিধানিক হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তা সংবিধানে গৃহীত হচ্ছে। ১১৬ অনুচ্ছেদ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা সংবিধানসম্মত হবে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকবে। বিচার বিভাগ কর্তৃক সংবিধান লঙ্ঘন সমুচিত হবে না। তিনি বলেন, ‘বিএনপি বিচার বিভাগের স্বাধীনতা চায়। তাই এই প্রক্রিয়া যাতে আইনানুগ ও সাংবিধানিক পদ্ধতিতে হয়, সেজন্য মতামত দিয়েছি।’
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের বিষয়ে সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘কিছু কিছু বিষয়ে তারা এমন প্রস্তাব দিয়েছে, যা বাস্তবায়ন করলে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীন সত্তা বজায় থাকবে না। তারপরও আমরা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আগাচ্ছি।’
গতকাল সংলাপের সূচনা বক্তব্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে জাতীয় সনদ তৈরি করা। যাতে বাংলাদেশে একটি স্থায়ী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে পারি।’
তিনি বলেন, দেশে বারবার গণতন্ত্র হোঁচট খেয়েছে। বারবার দেখছি এ দেশে কেবল গণতন্ত্রই হোঁচট খেয়েছে তা নয়, ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো সংগ্রাম করেছে, বিএনপি অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেছে। এমন ব্যক্তিতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্র যাতে আর না ফিরতে পারে এবং অতীতের মতো ঘটনা যাতে ভবিষ্যতে না ঘটে, সেই জায়গাটাকেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার জন্য এ প্রচেষ্টা।
তিনি আরো বলেন, ‘বিএনপি সুনির্দিষ্ট মতামত দিয়েছে, ভিন্ন মত নিয়ে আলোচনা করতে চাই। গণতান্ত্রিক সংগ্রামে বিএনপির ভূমিকা দেশের মানুষ অবগত। তাদের ভূমিকা জনগণের কাছে প্রশংসনীয়।’
এদিকে সূচনা বক্তব্যে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘তাঁর দল সংস্কারের পক্ষে। তবে সংস্কারের সবকিছুই হতে হবে জনগণের সম্মতিতে। জুলাই গণ অভ্যুত্থান দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আমাদের সামনে আরেকবার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, আমরা তা কাজে লাগাতে চাই। আমরা এই কমিশনকে সহযোগিতা করছি, এই সরকারকে সহযোগিতা করছি সেই প্রত্যাশা নিয়েই।’
বিএনপির এই নেতা বলেন, “আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, বিএনপির চেয়ে বেশি সংস্কার বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দল করেনি। কাজেই বিএনপি সংস্কারের বিপক্ষে নয়, বিএনপি সংস্কারের দল। কিন্তু কেউ কেউ নানান কথা বলেন, তারা যখন সংস্কারের ‘স’ উচ্চারণ করেননি তখন দেশনেত্রী খালেদা জিয়া ভিশন-২০৩০ দিয়েছেন।”
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সনদ না হলেও বিএনপির ৩১ দফার সনদ আছে জানিয়ে নজরুল ইসলাম খান বলেন, শুধু একটা জিনিস বলব, ‘সবকিছুর মূলে জনগণ। জনগণের সম্মতিতে যেন সব হয়। আর জনগণ কার মাধ্যমে সম্মতি জানায় আমরা জানি। সংস্কার একটা চলমান অনিবার্য প্রক্রিয়া, এটা হতেই হবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলায় এবং বদলাবেই, আর অনিবার্য চলমান প্রক্রিয়া বলছি এটাকে।’