দীর্ঘদেহী হওয়ার জন্য ১৩ থেকে ১৯ বছর বয়সের মধ্যে অনেকে নানা রকম শরীরচর্চা করেন - এটা শোনা যায়। কিন্তু অপারেশন করিয়ে পায়ের হাড় লম্বা করার মাধ্যমে উচ্চতা বাড়ানোর কথা খুব একটা শোনা যায় না। শুনতে অভিনব মনে হলেও এখন জানা যাচ্ছে, পৃধিবীতে প্রতি বছর শত শত লোক এমন অপারেশন করাচ্ছেন।
এই অস্ত্রোপচার খুবই কষ্টকর, এর দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিও আছে অনেক, কিন্তু কয়েক ইঞ্চি উচ্চতা বাড়াতে অনেকেই এ কষ্ট ও ঝুঁকি মেনে নিচ্ছেন।
শোনা যাক স্যাম বেকারের অভিজ্ঞতা। হাইস্কুলের শেষ বছরে উত্তীর্ণ হবার সময় স্যাম দেখলেন, তার সহপাঠীরা সবাই ধীরে ধীরে তার চেয়ে লম্বা হয়ে গেছে।
"আমি কলেজে গিয়ে দেখলাম, আমি ছেলেদের চেয়ে তো বটেই - অনেক মেয়ের চেয়েও খাটো" - বলছিলেন তিনি।
'খাটো ছেলেদের সাথে মেয়েরা প্রেম করতে চায় না'
স্যাম বেকার বলছিলেন, 'উচ্চতা আপনার জীবনের ওপর অনেক প্রভাব ফেলে। সত্যি বলতে কি অনেক মেয়েই তাদের চেয়ে খাটো ছেলেদের সাথে প্রেম করতে চায়না। সবচেয়ে কষ্টকর যে কথাটা আমার মাথায় ঘুরতো তা হলো - আমি হয়তো জীবনে কাউকে বিয়ে করতেই পারবো না। '
স্যামের বয়স ৩০। তিনি থাকেন নিউইয়র্কে। তিনি জানতেন তার উচ্চতা বৃদ্ধির বয়স চলে গেছে, কিন্তু তবুও তার একটা আশা ছিল যে হয়তো তিনি আরো খানিকটা লম্বা হবেন।
'আমার মনে হতো, লম্বা হবার সাথে জীবনে সাফল্যের সম্পর্ক আছে। তাই আমি আমার নিজের মতো করে ব্যাপারটার একটা সমাধানের উদ্যোগ নিলাম।'
খোঁজখবর নিয়ে, কিছু গবেষণা করে তিনি দেখলেন, উঁচু হিলের জুতো পরা বা স্ট্রেচিং করার মতো সমাধানে তিনি আকৃষ্ট বোধ করছেন না।
কিন্তু পা লম্বা করার অপারেশনের কথা জানার পর ব্যাপারটা তাকে চমৎকৃত করলো। তিনি এ নিয়ে খোলাখুলি কথা বললেন তার মায়ের সাথে, এবং ঝুঁকিগুলো বিবেচনা করলেন।
তারপর তার মনে হলো, অপারেশন টেবিলই তার সমস্যার সমাধান।
স্যাম অপারেশনটা করালেন ২০১৫ সালে। তিনি ছিলেন ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি লম্বা। আর এখন তার উচ্চতা হয়েছে ৫ ফুট ৭ ইঞ্চি (১৭০ সেন্টিমিটার)।
আমি কি হাঁটতে পারবো?
স্যাম বলছিলেন, 'ডাক্তার আমাকে অপারেশন নিয়ে কথা বলার সময় পরিষ্কার করেই বুঝিয়েছিলেন যে এই শল্যচিকিৎসা অত্যন্ত কঠিন।'
'আমি নিজে উদ্বিগ্ন ছিলাম যে তিন ইঞ্চি লম্বা হবার পর আমার ঠিক কি অবস্থা হবে। আমি কি হাঁটতে পারবো? দৌড়াতে পারবো? এ প্রশ্নগুলোই মাখায় ঘুরছিল।'
'অপারেশনের পর সপ্তাহে তিন-চারদিন কয়েক ঘন্টা করে আমাকে ফিজিওথেরাপি নিতে হতো। এটা চলেছিল প্রায় ৬ মাস।'
'লোকে এটাকে কসমেটিক সার্জারি বলে, কিন্তু আমি এটা আসলে করিয়েছিলাম আমার মানসিক স্বাস্থ্যের কথা ভেবে।'
বহু দেশে এখন এ অপারেশন হচ্ছে
যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, ইতালি, তুরস্ক এমনকি ভারত সহ ১২টিরও বেশি দেশে পা লম্বা করার অপারেশন করা হচ্ছে এখন।
কোনো কোনো ব্যক্তি এর মাধ্যমে প্রায় ৫ ইঞ্চি পর্যন্ত উচ্চতা বাড়াতে পেরেছেন। ঠিক কত লোক এই অপারেশন করান তা বলা কঠিন। কিন্তু বিবিসি এ নিয়ে বেশ কিছু দেশের ক্লিনিকের সাথে কথা বলেছে।
ক্লিনিকগুলো বলছে, এর জনপ্রিয়তা ক্রমশ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতি বছর ১০০ থেকে ২০০টি এ অপারেশন হচ্ছে। অন্য দেশগুলোতে অপেক্ষাকৃত কম -প্রতি বছর ২০ থেকে ৪০টি।
যুক্তরাজ্যে আরও কম- বছরে ১৫টি অপারেশনের কথা জানতে পেরেছে বিবিসি, তবে সর্বত্রই এ সংখ্যা বাড়ছে।
কীভাবে অপারেশন করে পা লম্বা করা হয়?
প্রথমে পায়ের হাড়ে একটি ছিদ্র করা হয়। তারপর সেই হাড় কেটে দু-টুকরো করে তার ভেতরে একটি ধাতব রড ঢুকিয়ে দিয়ে তা স্ক্রু দিয়ে এঁটে দেওয়া হয়। এরপর রডটার দৈর্ঘ্য প্রতিদিন এক মিলিমিটার করে ধীরে ধীরে বাড়ানো হয়। এভাবে রোগীর ইচ্ছা অনুযায়ী উচ্চতা অর্জন করা, এবং হাড় জোড়া লাগা পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া চলে।
অত্যন্ত ব্যয়বহুল অপারেশন
যুক্তরাজ্যে কেয়ার কোয়ালিটি কমিশন নিয়ন্ত্রিত কিছু প্রাইভেট ক্লিনিকে এ অপারেশন হয়, যাতে খরচ পড়ে ৫০ হাজার পাউন্ড পর্যন্ত। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এ জন্য ৭৫ হাজার ডলার থেকে ২ লক্ষ ৮০ হাজার ডলার পর্যন্ত ব্যয় হতে পারে।
এটি একটি দীর্ঘ, বেদনাদায়ক ও ব্যয়বহুল অপারেশন। এই অপারেশনের কৌশল আবিষ্কার করেন একজন সোভিয়েত ডাক্তার গাভরিল ইলিজারভ। তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে ফিরে আসা আহত সৈন্যদের চিকিৎসা করতেন। গত ৭০ বছরে এই অপারেশনে কিছু পরিবর্তন হয়েছে তবে মূল কৌশল এখনো প্রায় একই আছে।
প্রতি মুহুর্তে জটিলতা দেখা দেবার ঝুঁকি
এরপর রোগীকে কয়েক মাস ধরে ফিজিওথেরাপি করতে হয় তার হাঁটাচলার শক্তি ফিরে পাবার জন্য।
এসময় প্রতি মুহুর্তে জটিলতা দেখা দেবার ঝুঁকি থাকে। এর মধ্যে স্নায়ুতন্ত্রের ক্ষতি, রক্ত জমাট বেঁধে যাওয়া বা পায়ের হাড়ের জোড়া না লাগার মত যে কোনরকম সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এই অভিজ্ঞতা হয়েছে বার্নি নামে একজনের। তিনি ২০১৫ সালে এই অপারেশন করিয়ে ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি থেকে ৫ ফুট ৯ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়েছিলেন। অপারেশনের সময় তার বয়স ছিল ৪৬।
অপারেশনের পরে দেখা গেল, তার পায়ের হাড় বেড়ে জোড়া লাগছে না। তার দু পায়ের হাড়ের মাঝখানে তিন ইঞ্চি পরিমাণ অংশ ধাতব রড, তার দু'পাশে হাড়।
তিনি হাঁটতে পারতেন, কিন্তু অনুভব করতেন প্রচণ্ড ব্যথা। তার সাথে ছিল এই মানসিক যন্ত্রণা যে, এখন হয়তো আর কিছুই করার নেই। তবে পাঁচ বছর পর তার হাড় জোড়া লাগে এবং ধাতব রড অপসারণ করা হয়।
বার্নি বলছেন, 'আমার সেরে উঠতে বহু সময় লাগবে। কিন্তু এতদিন পর হলেও আমার মনে হচ্ছে অপারেশন করা সার্থক হয়েছে। আমি খর্বকায় মানুষদের যে বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গীর শিকার হতে হয় - তা থেকে মুক্তি পেয়েছি।'
তবে এই অপারেশনের পর কতজনের ক্ষেত্রে জটিলতা হয় - তার কোন নির্ভরযোগ্য উপাত্ত নেই। তবে ব্রিটিশ অর্থপেডিক সমিতির অধ্যাপক হামিশ সিম্পসন বলছেন, এর ঝুঁকি অনেক।
'আগের চাইতে এখন এ অপারেশনের প্রযুক্তি উন্নত এবং অধিকতর নিরাপদ হয়েছে। কিন্তু এই অপারেশনের পর নতুন হাড়, মাংসপেশী, স্নায়ু, রক্তবাহী নালী এবং চামড়া তৈরি হতে হয় - তাই প্রক্রিয়াটা এখনও অত্যন্ত জটিল রয়ে গেছে। জটিলতা দেখা দেবার হারও উঁচু'- বলেন প্রফেসর সিম্পসন।
বিডি প্রতিদিন/জুনাইদ আহমেদ