দক্ষিণ আফ্রিকায় গত চার বছরে সাড়ে চারশোর বেশি বাংলাদেশি অভিবাসী নিহত হয়েছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, বিষয়টি নিয়ে কর্মকর্তারা দক্ষিণ আফ্রিকার কর্তৃপক্ষের কাছে উদ্বেগ তুলে ধরে ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ডিসেম্বরের শুরুতে এনিয়ে দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন একজন কর্মকর্তা।
তামান্না আর ফেরদৌসিদের কান্না
বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ থেকে ২০১১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়েছিলেন তামান্না আক্তারের স্বামী। এটি তামান্নার ছদ্মনাম।
দক্ষিণ আফ্রিকা যাবার দেড় বছরের মধ্যে তার স্বামী সেখানে কাজের অনুমতি অর্থাৎ ওয়ার্ক পারমিট পান। এরপরে জোহানসবার্গে তিনি একটি মুদি দোকান খোলেন। বছর খানেকের মধ্যে দাঁড়িয়ে যায় তার ব্যবসা।
টাকা পয়সা জমিয়ে ২০১৫ সালে দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি। বিমানের টিকেট কেনাও হয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু নির্ধারিত তারিখের কয়েকদিন আগে নিজের দোকানের সামনে খুন হন তিনি।
'এ ঘটনায় ওইখানে কোন আটক-গ্রেফতার-বিচার কিছু হয়েছে কি না আমরা জানি না। শুধু এইটুকু জানি, ওইখানে কোন মামলা হয় নাই। উনাকে দেশে এনে মাটি দেয়া হয়, এখানেও কোন মামলা হয় নাই।'
'আমার সঙ্গে ২০১২ সালে উনার বিয়ে হয়, ফোনেই কবুল পড়ানো হয়। উনি মারা যাওয়ার পর ওই দেশ থেকে উনার টাকা-পয়সা কিছু আসে নাই, আর এইখানে তো কিছু ছিলই না তেমন, ফলে আমরা খুব অসুবিধায় পড়ে যাই।'
চার বছরের বেশি সময় পার হবার পর তামান্না সম্প্রতি অন্যত্র বিয়ে করেছেন।
কুমিল্লার লালমাই উপজেলার ফেরদৌসির বড় ভাই কোন রকম বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ২০১৩ সালে যান দক্ষিণ আফ্রিকা।
'তিন বছর বিভিন্ন জায়গায় কাজ করার পর ২০১৬ সালে ভাইয়া 'অ্যাসাইলাম পেপার' হাতে পায়, এরপর একটা দোকান করার জন্য পরিচিত একজনের কাছ থেকে দশ হাজার রেন্ড (দক্ষিণ আফ্রিকান মুদ্রা) ধার করছিল ভাইয়া। আমরা পরে শুনছি যেদিন বাসায় টাকা নিয়া আসছে ওইদিন রাত্রেই খুন হয় আমার ভাই।'
ফেরদৌসি জানিয়েছেন, তার ভাইয়ের লাশ প্রায় এক মাস পর দেশে পৌঁছেছিল, এবং সেখানে কোন মামলা হয়নি।
'আমাদের বলছে, আমার ভাইয়ের কাগজপত্র নাই, সেজন্য এ ঘটনায় ওই দেশে মামলা হয় নাই। এমনকি লাশ দেশে আনার খরচও আমরা এখান থেকে পাঠাইছি।'
সন্তান হারানোর শোক এই পরিবারটি এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। পরিবারের হাল ধরার জন্য প্রায় দশ লাখ টাকা ধার করে ছেলেকে বিদেশে পাঠানো হয়েছিল।
কেন এসব হত্যাকাণ্ড?
প্রিটোরিয়াতে বাংলাদেশ হাইকমিশন থেকে জানানো হয়, ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত দক্ষিণ আফ্রিকায় মোট ৪৫২জন বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এর মধ্যে ২০১৯ সালের প্রথম ৯ মাসে ইতিমধ্যে ৮৮জন বাংলাদেশির মরদেহ দেশে পাঠানো হয়েছে।
দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার সাব্বির আহমেদ চৌধুরী বার্তা সংস্থা এএফপিকে জানিয়েছেন, নিহতদের শতকরা ৯৫ শতাংশই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
যার মধ্যে বেশিরভাগই ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত ও নারী ঘটিত শত্রুতার কারণে নিহত হয়েছেন বলে হাইকমিশন জানতে পেরেছে। তবে দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি রেজাউল করিম খান ফারুক জানান, বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন দোকানপাটে হামলা এবং লুটতরাজ প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেপটাউন, জোহান্সবার্গ, প্রিটোরিয়া এবং ব্লুমফন্টেইনে অভিবাসী বিরোধী হামলার শিকার হয়েছেন বহু বাংলাদেশি।
'বাংলাদেশ থেকে বৈধ এবং অবৈধভাবে যারা আসেন, নানাভাবে কিছুদিন পর তারা এখানে ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করে, বিশেষ করে মুদি বা গ্রোসারি দোকান দেয় তারা। তখন দেখা যায় বাংলাদেশি আরেকজন অভিবাসীর সঙ্গেই হয়তো তার দ্বন্দ্ব শুরু হলো। এর পরিণতিতে অনেক খুনখারাপি আমরা দেখেছি।'
'এছাড়া কাগজপত্র বিশেষ চেক করা হয় না বলে অনেকে চলে যায় গ্রামের দিকে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় তারা স্থানীয়দের সঙ্গে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ে। এ থেকে দোকানে লুট ও সংঘর্ষ এবং খুনের ঘটনা ঘটার অভিযোগ আছে।'
তিনি আরও জানান, দক্ষিণ আফ্রিকায় বাংলাদেশিদের জন্য একটি বড় সমস্যা হচ্ছে, দেশটিতে বহু বাংলাদেশি অবৈধভাবে অবস্থান ও কাজ করছেন, যে কারণে অনেক সময় হত্যাকাণ্ডের পর মামলা করায় জটিলতা সৃষ্টি হয়।হামলা, লুট এবং হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে অভিবাসী বাংলাদেশিরা নিরাপত্তা চেয়ে জাতিসংঘ শরণার্থী হাইকমিশনের কার্যালয়ের সামনে নভেম্বর মাসে বিক্ষোভও করেছে।
কেমন আছেন বাংলাদেশিরা?
বেসরকারি হিসাবে অর্থাৎ দক্ষিণ আফ্রিকায় কর্মরত বাংলাদেশি কমিউনিটির হিসাব অনুযায়ী দেশটির বিভিন্ন শহরে এই মুহূর্তে প্রায় তিন লাখ বাংলাদেশি রয়েছেন। এদের বেশিরভাগ কেপটাউন, জোহানসবার্গ এবং ব্লুমফন্টেইনে থাকেন। মূল শহরের আশেপাশে এবং গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে কাজ করেন অনেকে।
১৯৯৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমানো নোয়াখালীর তাবারক হোসেন গত বছর কেপটাউনে ছোট একটি রেস্তোরাঁ দিয়েছেন।
তিনি বলেন, এখানে প্রতিযোগিতা অনেক, টিকে থাকা সহজ না। এছাড়া স্থানীয় লোকের আর্থিক অবস্থা গত কয়েক বছর ধরে ভালো না হওয়ায় আমাদের ব্যবসার অবস্থাও ভালো না। এছাড়া প্রায়ই স্থানীয় সন্ত্রাসীরা আমাদের দোকানে লুটপাট চালায়, কখনো ধরে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ নেয়। নিরাপত্তার অভাবে অনেক সময়ই রাত জেগে দোকান পাহারা দেন তারা।
কেপটাউনেই স্বামীর সঙ্গে ছোট একটি সুপারস্টোর চালান সীমা আক্তার।
তিনি বলেন, পরিবার পরিজন নিয়ে প্রতিদিন অনিশ্চয়তায় থাকেন। কখন হামলা হবে বা বাচ্চারা যাতে খারাপ কিছুর মুখে না পড়ে, তা নিয়ে সারাক্ষণ টেনশনে থাকি।
কী করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়?
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আফ্রিকা উইংএ মহাপরিচালক মালেকা পারভিন জানান, বিষয়টি নিয়ে তারা ইতিমধ্যেই দক্ষিণ আফ্রিকার কর্তৃপক্ষের কাছে উদ্বেগ তুলে ধরে কয়েক দফা নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
'ডিসেম্বরের শুরুতে এনিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমাদের একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে যে ওই দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর তো আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই, ফলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থামাতে আমরা নিজেরা সরাসরি কিছু করতে পারছি না।'
তিনি বলেন, 'ওদের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ হবার কারণে কেবল বাংলাদেশি নয়, দক্ষিণ আফ্রিকার আশপাশের দেশগুলো থেকে যারা ওখানে এসে ব্যবসা বাণিজ্য করছে সবাই হামলার শিকার হচ্ছে।'
পারভিনের মতে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, ওখানে অনেক অবৈধ বাংলাদেশি কাজ করছেন, যে কারণে হামলা বা হুমকির শিকার হলে অনেকেই দূতাবাস বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে অভিযোগ জানাতে যায় না। ফলে ঠিক কী পরিমাণ মানুষ ঝুঁকিতে রয়েছেন সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া কঠিন।
তবে, অভিবাসী বিরোধী হামলার প্রেক্ষাপটে সেপ্টেম্বরের শুরুতে দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের চলাচলে সতর্কতা জারি করে বাংলাদেশ হাইকমিশন।
দক্ষিণ আফ্রিকার বেকারত্ব এবং অপরাধ প্রবণতা
নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশ থেকে মানুষ দক্ষিণ আফ্রিকায় কাজের সন্ধানে যেতে শুরু করে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশটিতে বৈধভাবে এক লাখের মত বাংলাদেশি রয়েছেন। দেশটিতে এখনো সাদা এবং কালো মানুষদের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ব্যাপক এবং ভূমির মালিকানা নিয়েও রয়েছে চরম অসন্তোষ। সেই সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে দেশটিতে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, স্থানীয়দের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৮ শতাংশ।
কর্মসংস্থান না থাকায় কেপটাউন এবং জোহান্সবার্গসহ বড় শহরগুলোর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া দেশটির একটি বড় সমস্যা।
বিডি প্রতিদিন/আরাফাত