'লাইলাতুল কদর'- এক মর্যাদাপূর্ণ রাত। লাইলাতুর কদর আরবি শব্দ। লাইলাতুন শব্দের অর্থ রাত। আর কদর শব্দের অর্থ মহিমা, সর্বোত্তম ইত্যাদি। সুতরাং লাইলাতুর কদর শব্দের অর্থ-মহিমান্বিত রাত, শ্রেষ্ঠ রাত। এই রাতেই পবিত্র কোরআন অবতীর্ণ হয়েছিল। মহিমান্বিত এ রাতের বর্ননা ও পরিচয় পবিত্র কোরআন মাজিদে স্পষ্টভাবে দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে,
''আমরা (সম্মানার্থে বহুবচনীয় সর্বনাম)একে (কোরআন কে) অবতীর্ণ করেছি মহিমান্বিত রাতে। (হে নবী) তুমি কি জানো মহিমান্বিত রাত কী? মহিমান্বিত রাত হলো এক হাজার মাস অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এ রাতে ফেরেস্তারা এবং রূহ (জিব্রাইল)নিজেদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে প্রতিটি হুকুম নিয়ে (পৃথিবীতে) নেমে আসে। ফজর উদয় হওয়া পর্যন্ত রাতটি শান্তিময়''। (সুরা কদর)
মঙ্গলবার ২৬ রমজান। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বিশ্বাস, আজকের দিবাগত রাতটিই লাইলাতুল কদর হিসেবে গণ্য। বোখারী শরীফে হযরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, 'তোমরা রমজানের শেষ দশ দিনের বেজোড় তারিখে লাইলাতুল কদর অন্বেষণ কর'। বোখারী শরীফের অন্য এক হাদিসে রমজানের শেষ দশকে তা অন্বেষণের কথা বলা হয়েছে। হযরত আবু হুরাইরা (রা.) হতে বর্নিত আবু দাউদ শরীফের একটি হাদিসে বলা হয়েছে সেটি ২৭ বা ২৯ রাত। তাঁর বর্নিত মুসনাদে আহমদের একটি হাদিসে বলা হয়েছে সেটি রমজানের শেষ দশ রাত। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস থেকে বর্নিত বোখারী শরীফের একটি হাদিসে বলা হয়েছে, তাকে খোঁজ রমজানের শেষ দশ রাতের মধ্যে যখন মাস শেষ হতে আর নয় দিন বাকি থাকে। অথবা সাত দিন বা পাঁচ দিন বাকি থাকে। আরো গ্রহনযোগ্য একটি হাদিস হতে জানতে পারা যায় যে, শেষ দশকের ২৭তম রাত হলো কদরের রাত। আবার তাফসীরে মাযহারীতে বলা হয়েছে, প্রত্যেক রমজানে এ রাত পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বিধায় ২৭তম রাতকে প্রাধান্য দিয়ে অন্যান্য রাতকে ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে কদর হলো বছরের সর্বোত্তম রাত এবং এই রাতে পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। এ রাত সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এই রাতে করা কোনো ভাল কাজ অন্য হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। অর্থাৎ শুধু এই একরাতের ইবাদত সারা জীবন ইবাদত করার চেয়ে আরও অনেক বেশি। এটা এমন এক রাত যেখানে সূর্যোদয়ের আগ পর্যন্ত খোদার বিশেষ রহমত এবং শান্তি বর্ষিত হতে থাকে। কোরআনে বলা হচ্ছে, আমি একে নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে। নিশ্চয়ই আমি সতর্ককারী, এ রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরিকৃত হয়। (সূরা দুখান)
এ ছাড়া বলা হচ্ছে, আমি কোরআনকে বোঝার জন্য সহজ করে দিয়েছি। সুতরাং লাইলাতুল কদর ভাগ্যেরও রাত। মহান প্রভু এ রাতে প্রত্যেকের জন্য পরবর্তী লাইলাতুল কদরের আগ পর্যন্ত ভাগ্য নির্দারণ করে দেন। মুহাম্মদ (সা.) বলেন, লাইলাতুল কদরের রাতে যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে খোদার পুরস্কারের আশায় ইবাদত করে তিনি তার পূর্বের সকল গুনাহ মাফ করে দিবেন। (বুখারী)
প্রসঙ্গত, আরেকটি বিষয় উদ্ধৃত করা জরুরী, কোরআনে যে হাজার শব্দটি ব্যবহার করেছে তা মূলত প্রতীকী শব্দ। সে সময়ের আরব জাতির জ্ঞানের পরিধির আলোকে রাব্বুল আলামিন তার বক্তব্য পেশ করেছেন। আরবরা হাজারকে সর্বশেষ ও সর্বাধিক সংখ্যা মনে করত। তারা বর্তমান যুগের মিলিয়ন ও বিলিয়নের সাথে পরিচিত ছিল না। তাই তারা হাজার সংখ্যাকে শীর্ষ সংখ্যা বলে বিবেচনা করত।
সুতরাং বোঝা গেল এটা হল দয়া ও মহিমার রাত। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কবে আসলে লাইলাতুল কদর ? এর উত্তর খুঁজতে আমরা নিম্নোক্ত হাদিসের সহযোগিতা নিতে চাই। পাশাপাশি একটি গাণিতিক হিসাব মিলিয়ে দেখা যেতে পারে, কারো কারো মতামত সূরা কদরে মোট ৩০টি শব্দ আছে। হিয়া হাত্তা মাতলায়িল ফাজর। এটিতে ‘হিয়া’ শব্দটি ২৭তম শব্দ। আবার অন্যদের মতে, ইন্না আনঝালনাহু ফি লাইলাতিল কদর-এই আয়াতটি সুরা কদরে ৩ বার এসেছে। প্রতি আয়াতে ৯টা করে অর আছে। ফলে ৩*৯=২৭ হচ্ছে কদরের রাত। এটা হচ্ছে, প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত। বাস্তবত কদরের রাতটি রহস্যঘেরা। খোদা তায়ালা প্রথমে তার বন্ধুকে তা জানিয়ে দেন এবং পরে আবার তাকে ভুলিয়ে দেন। এটি গোপন রাখার উদ্দেশ্য, মুসলমানগণ যেন তা লাভ করার জন্য যারপর নাই চেষ্টা সাধনা করেন।
যির ইবন হুবাইশ রহ. বলেন, আমি উবাই ইবন কা’বকে জিজ্ঞাসা করে বলি, তোমার ভাই ইবন মাসউদ বলেন, যে ব্যক্তি সারা বছর রাতে কিয়াম করবে সে লাইলাতুল কদর লাভ করবে। তিনি বললেন, রাব্বুল আলামিন তার ওপর রহম করুন, তার উদ্দেশ্য মানুষ যেন অলস না হয়, অন্যথায় তিনি ভাল করে জানেন যে, লাইলাতুল কদর রমজানে, বিশেষ করে শেষ দশকে, বরং সাতাশে। অতঃপর তিনি শপথ করে বলেন, এতে সন্দেহ নেই লাইলাতুল কদর সাতাশে। আমি বললাম, আপনি তা কিভাবে বলেন, হে আবু আব্দুর রহমান, তিনি বললেন, নিদর্শন দেখে অথবা রাসূলের নির্দেশিত আলামত দেখে, সেদিন সূর্য উদিত হবে যে, তার কিরণ থাকবে না। ইমাম আহমদের এক বর্ণনায় আছে, সেদিন সকালে সূর্য উদিত হবে, যেন তা গামলা, যার কোনো আলো নেই।
তিরমিযির এক বর্ণনায় আছে, উবাই বলেছেন, খোদার শপথ ইবন মাসউদ নিশ্চিত জানে যে, লাইলাতুল রমজানে, এবং তা সাতাশে, কিন্তু তিনি তোমাদের সংবাদ দিতে চাননি, যেন তোমরা অলস বসে না থাক।
মুয়াবিয়া (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী (সা.) বলেছেন, লাইলাতুল কদর হচ্ছে সাতাশের রাত। আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নিকট এসে জিজ্ঞাসা করে হে নবী, আমি খুব বৃদ্ধ ও অসুস্থ লোক, আমার দ্বারা দাঁড়িয়ে থাকা খুব কঠিন, অতএব আমাকে এমন এক রাতের কথা বলুন, যেন সে রাতে খোদা আমাকে লাইলাতুল কদর দান করেন, তিনি বললেন, তোমার উচিত সাতাশ আঁকড়ে ধরা।
শিক্ষা ও মাসায়েল
এক. আমাদের পূর্বসূরিগণ কল্যাণের প্রতি আগ্রহী ছিলেন, তারা ইবাদতে মগ্ন থাকার জন্য ফযিলতপূর্ণ সময় অনুসন্ধান করতেন।
দুই. কারণবশত কোনো বিষয় না বলা আলেমের জন্য বৈধ, যেমন মানুষের অলসতা ও নেক আমলে ত্রুটির সম্ভাবনা ইত্যাদি।
তিন. নিশ্চিত জ্ঞান বা প্রবল ধারণার ওপর কসম করা বৈধ।
চার. কিরণহীন সাদা-উজ্জ্বলতা নিয়ে সকালে সূর্যের উদয় হওয়া, লাইলাতুল কদরের আলামত।
পাঁচ. মুসলিমদের উচিত ফযিলতপূর্ণ মৌসুমের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করা, যেমন লাইলাতুল কদর অন্বেষণে রমযানের শেষ দশক, যেন অল্প আমলে তার অধিক কল্যাণ অর্জন হয়।
ছয়. আলেমদের বিশুদ্ধ মত হচ্ছে, লাইলাতুল কদর পরিবর্তনশীল, তবে সাতাশের রাত অধিক সম্ভাবনাময়, যেমন উবাই ইবন কাব শপথ করে বলেছেন।
সাত. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বৃদ্ধ লোককে লাইলাতুল কদর সাতাশে বলা অন্যান্য হাদিসের পরিপন্থী নয়, যেখানে অন্যরাতে লাইলাতুল কদর বলা হয়েছে, কারণ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সে বছরের কথা বলেছেন, যে বছর সে জিজ্ঞাসা করেছে। লাইলাতুল কদর সম্পর্কে সব হাদিসের মধ্যে সমতা রক্ষার জন্য এ ব্যাখ্যার বিকল্প ব্যাখ্যা নেই।
বিডি-প্রতিদিন/১৪ জুলাই ২০১৫/ এস আহমেদ