এক সপ্তাহ একদিন পার হলো বেগম জিয়ার ডাকা অবরোধের। ১২ জানুয়ারি এক সংবাদ সম্মেলনে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি বলেছেন, অবরোধের কারণে এক পোশাক খাতেই প্রতিদিন লোকশানের পরিমাণ সাড়ে চারশ' কোটি টাকা। একই দিন 'অবরোধে অর্থনীতি শেষ' এই শিরোনামে প্রথম পৃষ্ঠায় বাংলাদেশ প্রতিদিন লিখেছে, 'দেশে চলমান হরতাল-অবরোধের কারণে অর্থনীতির সব খাতে প্রতিদিন অন্তত ১৬০০-২০০০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এ হিসাবে গত সাত দিনের রাজনৈতিক সংঘাতে আর্থিক খাতেই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৪ হাজার কোটি। ব্যবসা-বাণিজ্যের আর্থিক খাতগুলোর বাইরেও শিক্ষাসহ সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার নানা পর্যায়ে ক্ষতির পরিমাণ বেশুমার। সব মিলিয়ে নতুন বছরের শুরুতেই চরম ঝুঁকিতে পড়েছে দেশের অর্থনীতি। গত বছর জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সংঘাতে বিশাল আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে না উঠতেই নতুন বছরের শুরুতে অবরোধে বড় ঝুঁকির সূত্রপাত ঘটেছে। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ অবস্থা চলতে থাকলে আগামী ১০ দিনের মধ্যে বিপর্যয় নেমে আসবে দেশের অর্থনীতিতে।
১২ তারিখ সন্ধ্যায় টকশো ফ্রন্টলাইনে প্রশ্নকর্তা দর্শকদের সবাই দেশের বর্তমান অবস্থায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। জানতে চেয়েছেন কি হতে যাচ্ছে। হরতাল-অবরোধের কি অবসান হচ্ছে? প্রশ্নের জবাবে এ কথাও নিঃসন্দেহে বলা যায়, এ অবস্থার সহসা পরিবর্তন হবে বলে মনে হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ এতদিন ধরে বিএনপির আন্দোলন করার যোগ্যতা নিয়ে বিদ্রূপ করত। বলত, আন্দোলন 'কাহাকে বলে, কত প্রকার ও কি কি তাহা বিএনপি জানে না। আওয়ামী লীগের কাছে শিখতে হইবে।' কিন্তু এখন আর সে রকম বলে না। গাজীপুরের জনসভার ঘোষণা থেকে বিএনপির ব্যাপারে আওয়ামী লীগকে সিরিয়াসই দেখা যাচ্ছে। ঢাকায়ও তাদের জনসভা করার অনুমতি না দেওয়া, বেগম জিয়াকে ঘর থেকে বেরুতে না দেওয়া, তাকে একপ্রকার অফিসবন্দী করে রাখার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ দেখায়নি সরকার। ফলে ধরে নেওয়া যেতে পারে বিএনপির জনসমর্থন আছে। তারা ডাকলে মানুষ তাদের সভায় আসে এটা সরকার জানে। এ জন্যই এ বাধা সর্বক্ষেত্রে।
সরকার হয়তো মনে করেছিল, গতবারের মতোই বেগম জিয়াকে আটকে রাখতে পারলে আর নেতাকর্মীদের দাবড়ালে গত বছরের মতোই আন্দোলন মরে যাবে। কিন্তু এবার তা হলো না। অবরোধ সফলভাবে পালিত হলো যা এখনো হচ্ছে এবং বিএনপি এমনকি ইজতেমাকে পর্যন্ত পাশ কাটিয়ে তাদের কর্মসূচি অব্যাহত রাখল। আওয়ামী লীগ নেতাদের ধারণা ছিল ইজতেমার কারণে খালেদা জিয়া আন্দোলন ধরে রাখতে পারবেন না। কিন্তু তাদের ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হলো। আট দিন পার হয়ে অবরোধ নবম দিনে পা দিল। আওয়ামী লীগ এ পরিস্থিতিকে কাজে লাগানোর জন্য তাদের সর্বাত্দক চেষ্টা চালাতে শুরু করল। তাদের নেতা-মন্ত্রীরা এমনভাবে কথা বলতে লাগলেন যেন খালেদা জিয়া একজন নাস্তিক আর আওয়ামী লীগ ইসলাম রক্ষা করার দল। কিন্তু এতেও কোনো কাজ হলো না। জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে ধার্মিক সাজার চেষ্টা করলে মানুষ তাকে ময়ূরপুচ্ছধারী দাঁড়কাকই মনে করে। আওয়ামী লীগ তার ধর্মনিরপেক্ষতার পবিত্র পোশাকে ময়লা লাগিয়ে ফেলল।
এ কথাও এখন নিশ্চিতই বলা যায়, বিএনপি দ্বিতীয় দফা ইজতেমাতেও ছাড় দেবে না। আমি শুনেছি, দলটির নেতাদের কেউ কেউ ছাড় দেওয়ার পক্ষে ছিল। কিন্তু তৃণমূলের কর্মীরা মনে করেন, আন্দোলনে ঢিল দিলে সরকারের নির্যাতন এমন মাত্রায় বেড়ে যাবে যে তারা রক্ষা পাবেন না। অতএব কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে। শুধু তাই নয়, ১২ তারিখে বাংলাদেশ প্রতিদিন লিখেছে, ১২ জানুয়ারি থেকে অবরোধ কর্মসূচি আরও কঠোর করার পরিকল্পনা ছিল বিএনপি জোটের। এদিকে অবরোধের পাশাপাশি সারা দেশে এবার শুরু হয়েছে হরতাল। এর মধ্যে সরকার দাবি না মানলে হরতালের পর আসবে টানা অসহযোগ।
পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে বিজিএমইএ প্রয়োজনে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করবে বলে ভাবছে। তারা সংকট নিরসনে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছেন।
পরিস্থিতি সত্যি ভয়াবহ এবং তা দিনকে দিন মীমাংসার বাইরে চলে যাচ্ছে। ইজতেমাকেও ছাড় না দেওয়াতে বোঝা যায় বিএনপি এবার শেষ দেখতে চায়। যুক্তিতর্কের মধ্যে যাচ্ছি না। বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় থাকা দরকার। সরকার তুড়ি মেরে আর বিএনপিকে উড়িয়ে দিতে পারছে না। যদি পারত তাহলে ১০ দিন ধরে এই পরিস্থিতি চলতে পারত না। ১০ দিন পরে তা আরও গুরুতর রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিত না। কিন্তু পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝছে বলে মনে হয় না। যে কোনো একটি সংকটের সময় সরকার যেমন সবদিক বিশেষ করে দেশের স্বার্থের দিক বেশি বিবেচনায় রাখতে হয় সে রকম না করে একতরফাভাবে বিএনপির ওপর দায় চাপিয়ে কঠোরতার নীতি অবলম্বন করার চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতা তোফায়েল আহমেদ বলছেন এদের নকশাল বাড়ির মতো দমন করা হবে। আর প্রধানমন্ত্রী ১২ জানুয়ারির জনসভায় বলেছেন আর সহ্য করা হবে না। এদের ঠেকাতে যা করার তাই করব।
কি অদ্ভুত না! বিএনপি কি নকশাল নাকি? তাদের নকশালি কায়দায় দমন করার মানে যে কত কঠিন তা নিশ্চয়ই কারও বুঝতে অসুবিধা হয় না। গত কয়েক দিন ধরেই দেখছি আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপিকে একটি জঙ্গিবাদী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা করছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী তার জনসভার ভাষণে বলেছেন খালেদা জিয়া জঙ্গিদের রানী।
মানুষ অবশ্য এ ধরনের কথাবার্তা শুনতে চায় না। মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। তাই প্রধানমন্ত্রীর কাছে এমন কিছু শুনতে চেয়েছিল যাতে তারা শান্তি পায়। দেশে যখন যা কিছুই ঘটে মানুষ তার জন্য সরকারের দিকেই চেয়ে থাকে। সে সরকার বৈধ কি অবৈধ নির্বাচিত কি অনির্বাচিত তাও ভেবে দেখে না। আমি নিজেও অন্তত এ মুহূর্তের পরিস্থিতিতে এ প্রশ্ন তুলতে চাইছি না। যে জনসভায় দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী এমন কড়া বক্তৃতা করলেন সেই জনসভাও কতটা গণতান্ত্রিক রীতিনীতিসম্পন্ন সেটা প্রশ্ন করা যায়। খুবই অবাক ব্যাপার প্রধানমন্ত্রীর এই জনসভা অনুষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনসভার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এখন কি বিএনপিকে জনসভা করার অনুমতি দেওয়া হবে। পত্রিকায় যেভাবে খবর বেরিয়েছে তাতে মনে হচ্ছে জনসভা করার অনুমতি দিলে বিএনপি তাদের অবরোধ প্রত্যাহারও করতে পারে। যদি তা সত্যি হয় তবে আশা করব সরকার সেই পথে অগ্রসর হবে। অবশ্য জনসভার জন্য সেটাকে কোনো শর্ত হিসেবে আমি উল্লেখ করতে রাজি নই। বিএনপিকে অথবা যে কোনো দলকে জনসভা করতে না দেওয়ার তো কোনো কারণ নেই। যদি সত্যি সত্যি সরকার বিএনপিকে জনসভা করতে না দেয় সেটা একটি ইতিহাস হয়ে থাকবে। সেখানে লেখা থাকবে একটি জনসভার কারণে একটি দেশ অচল।
আবার আমি সরকারকে বলতে চাই জেদ ছেড়ে দিন। দেশের যে কোনো সংকট মোচনে ব্যর্থতার দায় শেষ পর্যন্ত সরকারের কাছেই আসে। সবাই চাইছে সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করুক। এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী যদি উদ্যোগ নেন, তবে তার পরাজয় হবে না। বরং মানুষ তাকে সাধুবাদ জানাবে। বিগত ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে এবং পরের এই এক বছরে সরকার যত বিতর্কিত হয়েছে তার নিরসনের একটি বিরাট সুযোগ তৈরি হবে। একটি জাতীয় সংলাপ যদি শুরু হয় তবে রাজনীতির বর্তমান পথও পাল্টে যাবে। নতুন করে যাত্রা শুরু করা যাবে এবং তা সবাই মিলে।
লেখক : রাজনীতিক, আহ্বায়ক নাগরিক ঐক্য।
ই-মেইল : [email protected]