২০১৪ সালের পুরোটাই আমি ব্যয় করেছি জ্ঞান অর্জনের জন্য। পাশাপাশি জীবনের অগোছালো অধ্যায়গুলো সাজিয়ে নেওয়ার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করেছি। জ্ঞানের বড় বিপদ হলো ভুলে যাওয়া এবং মুসিবত হলো চেষ্টা করেও অনেক কিছু ভুলতে না পারা। আরও সমস্যা আছে, জ্ঞান মানুষকে প্রশ্ন করতে শেখায়। ভালোমন্দ বাছ-বিচারের পর সত্য প্রকাশ করার জন্য তাড়া দিতে থাকে এবং শরীরের পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে সব সময় সজাগ করে রাখে। ফলে মানুষ এক ধরনের অস্থিরতায় ভোগে, সত্য বলার অস্থিরতা কিংবা সত্যের স্বপক্ষে দাঁড়িয়ে যাওয়ার অস্থিরতা।
জ্ঞান কতটুকু অর্জন করতে পেরেছি তা বলতে পারব না, তবে নিজের জানা বিষয়গুলোকে মানুষের কাছে তুলে ধরতে একটুও কার্পণ্য করিনি। এক্ষেত্রে প্রকৃতিও আমাকে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের সর্বাধিক পঠিত তিনটি দৈনিক পত্রিকায় প্রতি সপ্তাহে গড়ে চারটি কলাম লিখি। তরুণদের জন্য লেখাগুলো ফেইসবুকে পোস্ট করি। ফলে দেশ-বিদেশের বাংলা ভাষাভাষী বিরাট সংখ্যক পাঠক-পাঠিকা অনায়াসে আমার লেখা পড়তে পারেন। কেউ হয়তো পছন্দ করেন, আবার কেউবা করেন অপছন্দ। কেউ কেউ আবার ধৈর্যহারা হয়ে আমার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে যাচ্ছেতাই ভাষায় গালাগাল করেন। ফেইসবুকের কমেন্ট বক্সে গেলে বোঝা যায়, বাঙালি সাম্প্রতিককালে গালি সংস্কৃতিতে কতই না উন্নতি করেছেন। আমি কমেন্টগুলো মনোযোগসহকারে পড়ি এবং নিজেকে প্রতি মুহূর্তে সংশোধনের চেষ্টা করি অথবা নিজের কৃতকর্মের প্রতি আরও আস্থাশীল হওয়ার প্রেরণা লাভ করি।
আজকের লেখার বিষয়বস্তু দেশজ রাজনীতির পাঁচালি। আমাদের দেশের রাজনীতির অাঁকাবাঁকা মেঠোপথ কিংবা মহাসড়কের পথচারীরা অথবা পথের ধারের লোকজনের মনমানসিকতাই আজকের লেখার বিষয়বস্তু। প্রথমে নিজের সম্পর্কে একটু ভূমিকা দেওয়ার কারণ হলো লোকজন প্রায়ই জানতে চায়, আমি এখন কী করছি কিংবা আমার ভবিষ্যৎ কী? তারা তাদের আপন চিন্তার বলয় দ্বারা আমাকে পরিমাপ করে এবং নিজেদের ইচ্ছেমতো আমাকে কোনো দলে ঢুকিয়ে দেয় অথবা বের করে দেয় গলা ধাক্কা দিয়ে। আমি যখন আওয়ামী লীগের ভালো কোনো দিক নিয়ে দুই কলম লিখি তখন সরকারদলীয় সমালোচকরা বলেন, কোনো কাজ হবে না রে মদন! যতই কুয়াকুয়ি কর, দলে ফিরতে পারবা না। অন্য দলের লোকেরা বলেন, তুই আর মানুষ হইলি না। তুই আসলেই একটা আওয়ামী লীগ। তোর নেত্রী তোরে এত প্যাদানি দিল, জেলে নিল, তারপরও তোর শরম হলো না। তোর রক্তই খারাপ, আওয়ামী রক্ত কোনো দিন ভালো হয় না! তুই মর, কচুখেতে গলায় দড়ি দিয়ে মর।
সরকার বা আওয়ামী লীগের মন্দ বিষয় নিয়ে সমালোচনা করে লিখলে অদ্ভুত সব প্রতিক্রিয়া পাই। যাদের সমালোচনা করি সেই দলের লোকেরা বলে, এই! তুই কিডারে? রাস্তা থেকে ধরে এনে নেত্রী এমপি না বানালে আজ তোরে কে চিনত? টকশো মারাও-কলাম লিখো! অসভ্য, বেইমান-মোনাফেক ইত্যাদি। সরকারবিরোধীরা তখন আমার পক্ষ নেয়, তারা বলে সুবহান আল্লাহ! এগিয়ে যান রনি ভাই! আমরা আছি। আপনার মতো সাহসী বীর আর নেই। আপনার দ্বারাই হবে। আপনিই পারবেন এই দেশকে নেতৃত্ব দিতে। কু...লীগ ছাড়েন। ইসলামের পথে আসেন। তওবা করেন। সত্যের পথের সৈনিক হন। শহীদ জিয়ার দল আপনাকে বরণ করে নেবে। জাতীয়তাবাদী শক্তি আপনার সঙ্গে আছে ইত্যাদি।
কোনো কোনো লেখায় আমি জামায়াত-বিএনপিকে সমালোচনা করলে ওই দলের লোকেরা আমার বারোটা বাজিয়ে দেওয়ার জন্য রাজ্যের সব অশ্লীল শব্দমালা দিয়ে আমার জন্য স্পেশাল সব গালি রচনা করে যা মুদ্রণের অযোগ্য। যারা সবচেয়ে ভদ্র, তারা বলে ওই মিছকা শয়তান? ওই হাসিনার পোলা, তুই জামায়াত-বিএনপি সম্পর্কে জানোস! আবাল কোথাকার! পাড়াইয়্যা তোর প্যাডা বাইর কইরা ফ্যালামু, পণ্ডিত সাজোস! ভণ্ড কোথাকার ইত্যাদি। কেউ কেউ পরামর্শ দেন কোনো কিছু না লেখার জন্য। আবার অনেকে বলেন, আগে দলীয় পরিচয় ঠিক কর! তারপর লেখ। নিরপেক্ষ হওয়ার যেন চেষ্টা না করি এমনতরো হাজারও উপদেশ নিয়ত আমাকে অনুপ্রাণিত করে সত্যিকার অর্থে নিরপেক্ষভাবে কিছু করার জন্য। কিছু সমালোচক অবশ্য বলেন ভিন্ন কথা। আমি নাকি ইদানীংকালে কাকুর মতো কথা বলি। বাংলাদেশের একজন বয়স্ক এবং শীর্ষ রাজনীতিবিদকে কিছু লোক মশকরা করে কাকু সম্বোধন করেন।
অনেকে আবার ব্যঙ্গ করে বলেন কাগু। লোকজনের অভিযোগ কাকু বা কাগুর প্রধান বৈশিষ্ট্য তিনি সকালে একরকম বলেন তো বিকালে বলেন অন্যরকম। সব রঙের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে গিয়ে তিনি হয়ে পড়েছেন বর্ণহীন। তিনি নাকি কথা দিয়ে কথা রাখেন না, বিশেষ করে মেয়েদের সঙ্গে নাকি একেবারেই কথা রাখেন না। তারা এসব মন্দ কথা বলে এবং আমাকে কাকুর সঙ্গে তুলনা করে বলেন, আমি নাকি কেবল ভবিষ্যৎ স্বার্থসিদ্ধির জন্য যখন যার অবস্থা ভালো হয়, তার দিকেই ঝুঁকে পড়ি। মূলত আগামীর রাজনীতির খেলায় যে দল বিজয়ী হবে আমি যাতে সেই দলে ভিড়তে পারি এমন মনোভাব থেকেই নাকি লেখালেখি, টকশো কিংবা সভা-সমিতি করে বেড়াই। লোকজন যাকে কাকু বলেন, আমি তাকে স্যার বলি। শুধু আমি নই সব দলের সব এমপিই তাকে সামনা-সামনি স্যার বলেন। যদি সুযোগ হতো তাহলে হয়তো সম্মান করে বলতাম কাকাবাবু। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছি বহুবার। বাংলাদেশের পঙ্কিল রাজনীতির আবর্তে কাকাবাবু সম্পর্কে আমার মূল্যায়ন একটু অন্যরকম। সময় ও সুযোগ পেলে হয়তো আরেক দিন লিখব। আজকে বলব, কেন আমরা কেবল মানুষের দোষ খুঁজে বেড়াই? কিংবা নিজের পক্ষে থাকলে কেন আমরা একজন মানুষের অতি প্রশংসা শুরু করি। আমি বর্তমান সমাজের অতিক্ষুদ্র একজন মানুষ। আমার জীবনের বাস্তব কিছু ঘটনার বর্ণনা দিলাম কেবল আশপাশের লোকজনের রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার বৈশিষ্ট্য বোঝানোর জন্য। বড় মানুষদের জীবনে হয়তো নির্মম ও নৃশংস সমালোচনার আঘাত আরও অনেক তীব্র। এখানে বলে রাখা ভালো, আমাদের দেশের সমালোচকরা সব সময় নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে রেখে কিংবা নাম-পরিচয় গোপন রেখে আড়ালে-আবডালে সমালোচনা বা কুৎসা রটনা করে। সামনে এসে প্রতিবাদ করা কিংবা সমালোচনা করার ঝুঁকি কেউ নেয় না কেবল আমার মতো বোকা প্রকৃতির কিছু লোক ব্যতিরেকে। আমার বিরুদ্ধে কৃত সমালোচনা বা বিরূপ মন্তব্য সবই করা হয়েছে ফেইসবুকে। অনুমান করি এসব ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের বেশির ভাগই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণ-তরুণী। কর্মজীবী কিছু যুবক-যুবতীও রয়েছেন। তাদের অনেকের লেখাপড়ার মান ভালো কিন্তু চিন্তাচেতনায় প্রচণ্ড একরোখা এবং গোঁয়ার প্রকৃতির। তারা নিজেদের নাম-পরিচয় গোপন রেখে অদ্ভুত সব নাম দিয়ে ফেইসবুকে অ্যাকাউন্ট খোলে। নিজেদের মতামত প্রকাশের পাশাপাশি তারা অন্যের মতামতের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন এবং বিশ্রী ভাষায় গালাগাল করার জন্য দিন-রাতের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো ব্যয় করতে থাকেন।
অনেকে হয়তো আমাকে বলতে পারেন, আমি কেন ফেইসবুকের কমেন্টগুলোকে এত গুরুত্ব দিচ্ছি? অথবা প্রথম শ্রেণির এবং সর্বাধিক পঠিত দৈনিক পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ সম্পাদকীয় কলামগুলো কেন ফেইসবুকে পোস্ট করি? সৈয়দ আবুল মকসুদ, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী কিংবা জাফর ইকবাল সাহেবরা তো ওমন করেন না! এ ব্যাপারে আমার বক্তব্য হলো, বর্তমানে ফেইসবুককে অস্বীকার কিংবা এড়িয়ে যাওয়াটা বোধহয় ঠিক নয়। কারণ বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি লোক এই সামাজিক মাধ্যমটির সঙ্গে জড়িত। সারা দুনিয়ায় ফেইসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা নাকি ২০০ কোটি। যে কোনো একটি বিষয় ফেইসবুকে জনপ্রিয়তা পেলে তা যত দ্রুত সবার কাছে পেঁৗছে যায় তা অন্য কোনো মাধ্যমে একেবারেই অসম্ভব। আমার ফেইসবুকের পোস্টগুলো গড়ে ৫০ লাখ লোকের কাছে পেঁৗছে যায়। এখন ৫০ লাখ লোকের মধ্যে কতজন সেই পোস্ট পড়বেন কিংবা পড়বেন না সেটা তাদের একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার।
লেখক হিসেবে ফেসবুক নিয়ে আমার অনেক সুখানুভূতি রয়েছে। জ্ঞানের রাজ্যে এই সামাজিক মাধ্যমটি আমাকে অনেক কিছু শেখায়। বিশেষ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের রাজনৈতিক চিন্তা, রুচিবোধ, প্রেম-প্রণয় কিংবা যৌনাকাঙ্ক্ষা নিয়ে যেমন খোলামেলা অভিব্যক্তি থাকে তেমনি ধর্মবোধ, মানবতা, অর্থনীতি, সমাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে শুরু করে কৃষিকাজ কিংবা ঘরকন্যা ইত্যাদি নিয়েও অনেক শিক্ষামূলক বিষয় থাকে। এত কিছুর মধ্যে আজ আমি কেবল তরুণদের রাজনৈতিক মন ও মানসিকতা নিয়ে কিছু কথা বলব।
তরুণ বলতে আমি নিশ্চয় তরুণ সম্প্রদায়ের সবাইকে নয়, একাংশকে বুঝাচ্ছি। তারা অন্যকে অপমান করার যে প্রবৃত্তি অর্জন করেছেন তা অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করেছে। আমার সন্তানের বয়সী তরুণ-তরুণীরা আমাকে তুই তুকারি করে সম্বোধন করছেন। তারা অভিযোগ করছেন আমি কিছুই জানি না, রাজনীতি বুঝি না, আমার বিদ্যে অতি অল্প এবং আমি যা কিছু করছি তা কেবল আমার ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে। এসব তরুণ যে রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা কিংবা ধ্যান-ধারণা বা বিশ্বাসের অনুরক্ত তা থেকে তাদের একচুল সরানো রীতিমতো অসাধ্য। তারা ভিন্ন মতকে একদম সহ্য করতে পারছেন না। ভিন্ন মতের মানুষকে তারা রীতিমতো ঘৃণা করেন। তারা যাদের প্রতিপক্ষ মনে করেন তাদের যে কোনো মূল্যে অপমান করার মধ্যেই এ শ্রেণির তরুণ-তরুণী নিজেদের সফলতা এবং সার্থকতা খুঁজে পান। বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, হরকাতুল জিহাদ, বাম সংগঠনগুলো, পেশাজীবী সংগঠন, এনজিও, সামাজিক সংগঠন, ধর্মীয় সংগঠন, বাণিজ্যিক সংগঠন প্রভৃতির সঙ্গে জড়িত তরুণ-তরুণীরা স্বার্থের বাইরে গিয়ে উদার নৈতিক চিন্তায় বা কর্মে নিজেদের জড়িত করছেন না।
ইতিহাস নিয়ে আমি যতটুকু পড়েছি তাতে আমার এ ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, তরুণ সমাজই দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। আবার যে দেশ, সমাজ বা কালের তরুণেরা সুন্দরতম মানবিক গুণাবলী পরিহার করে উল্টোরথে নিজেদের জীবন-যৌবন সঁপে দিয়েছে সেখানে প্রগতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে, অন্ধকার দানা বেঁধেছে এবং অগ্রযাত্রা থমকে দাঁড়িয়েছে। প্রত্যেকটি শতাব্দীকে যদি চার ভাগে ভাগ করা হয়, তবে লক্ষ্য করা যাবে যে, প্রতি ২৫ বছরে দেশ ও জাতির সামনে নেতৃত্বগুণসম্পন্ন প্রতিভাময় বহু তরুণ-তরুণীর আগমন ঘটে। তাদের দেশবাসী চিনেন, শ্রদ্ধা করেন এবং নির্ভরতা নিয়ে সর্বজনীনভাবে ভালোবাসেন। এখন আমি যদি প্রশ্ন করি ৩০ বছরের কম বয়সী কয়জন তরুণ-তরুণী আমাদের এ ১৭ কোটি মানুষের দেশে আছেন যাদের দেশবাসী তাদের ভবিষ্যৎ নেতা, সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষক, প্রশাসক, সমাজসেবক কিংবা ধর্মগুরু হিসেবে পাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন?
সুকুমার বৃত্তির অনুসরণকারী তরুণ-তরুণীর সংখ্যা যাই থাকুক না কেন, মন্দ স্বভাবধারীর সংখ্যা যে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে তাতে আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত না হয়ে উপায় নেই। ঐশীর মতো পিতা-মাতা হত্যাকারী কিশোরী পৃথিবীতে গত ৫০ বছরে জন্ম নিয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। যদি প্রশ্ন করা হয়- সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি ইয়াবা ট্যাবলেট বিক্রি হয় কোন দেশে এবং কারা খায়? তাহলে নিশ্চিতভাবেই সবাই বাংলাদেশের নাম বলবে এবং এদেশের ৩০ বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের নামই উঠে আসবে। আবার যদি ফেনসিডিলের কথা জিজ্ঞাসা করি তবে একই উত্তর পাওয়া যাবে। হাজারও সব নেশার উপকরণের মধ্যে আমি কেন ইয়াবা বা ফেনসিডিলের কথা উল্লেখ করলাম? কারণ নেশার জগতে এগুলোর মতো নিম্নমানের, অরুচিকর এবং বিষাক্ত মাদক দ্বিতীয়টি নেই। কাজেই এগুলো গ্রহণকারীরা যে মানুষজনকে ইতর প্রাণীর মতো মনে করবে এবং অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দেবে এটাই স্বাভাবিক।
এখন প্রশ্ন হলো- সমাজের এতটা পচন হলো কী করে? অথবা এই পচনের শেষ গন্তব্য কোথায়? আমার মনে হয় স্বাধীন বাংলাদেশের বেশির ভাগ সময় ধরে চলা রাজনৈতিক অস্থিরতা, হানাহানি, মারামারি ইত্যাদির কারণেই সমস্যাগুলোর সূত্রপাত হয়েছে। অসম রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা বিশেষ করে রাজনীতির ব্যাকরণ না মেনে শক্তি প্রয়োগের রাজনীতি শুরু হওয়ার কারণে আমরা আমাদের নেতা হিসেবে যাদের পেয়েছি তাদের বেশির ভাগই মানবিক গুণাবলীসম্পন্ন নন। পাশবিকতা, নির্বুদ্ধিতার জড়তা, অত্যাচার, অবিচার, অসৎ মনোভাব, ছলচাতুরি, চরিত্রহীনতা, মিথ্যাচার ইত্যাদি দিয়ে বিশাল শ্রেণির সুবিধাভোগী রাজনীতিবিদ প্রথমে নিজেদের পরিবারকে শেষ করেছে। তারপর সমাজকে এবং শেষমেশ পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাকেই অক্টোপাসের মতো আক্রমণ করে বসেছে।
আমি একটু বিস্তারিত হিসাব না দিলে আপনারা হয়তো বিভ্রান্ত হতে পারেন। আসুন আমরা সরকারি বরাদ্দ, উন্নয়ন কর্ম এবং শিক্ষাব্যবস্থার রুটটি খুঁজি। রুটটি হলো- একটি ইউনিয়নের ওয়ার্ড। প্রতি ইউনিয়নে ৯টি করে ওয়ার্ড থাকে। সেখানে একজন মেম্বার এবং মেম্বার হওয়ার মতো আরও দশজন লোক থাকে। তদ্রূপ একটি ইউনিয়নে চেয়ারম্যান হওয়ার মতো লোক গড়ে ১০ জন। উপজেলা চেয়ারম্যান, পৌর মেয়র, কাউন্সিলর- সব পদের বিপরীতে প্রভাবশালী দশজন করে লোক থাকে। এমপি প্রার্থীর সংখ্যাও সারা দেশ মিলিয়ে প্রায় ছয় হাজার। সুতরাং ওয়ার্ড থেকে জাতীয় সংসদ অবধি পদ-পদবিলোভী লোকের সংখ্যা কম করে হলেও ১০ লাখ। এই ১০ লাখের মধ্যে ৯০ ভাগ লোকই অসম প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ক্ষমতা লাভের চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের সেই চেষ্টার কারণে অন্তত এক কোটি লোক প্রত্যক্ষ দুর্নীতি এবং অনিয়মের মধ্যে জড়িয়ে পড়ে নিজেদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র শেষ করে দিচ্ছে।
কাজেই এক কোটি পরিবারের তরুণ-তরুণী যাদের হয়তো টাকা- পয়সার অভাব নেই, নেই থাকা-খাওয়ার সমস্যা; কিন্তু হৃদয়জুড়ে রয়েছে সীমাহীন হতাশা। তারা আপন পরিবারের কাউকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতে শিখেননি। নিজেদের অসৎ পিতা-মাতা, আত্মীয়স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীদের নীতিহীন কর্মকাণ্ড, অনাচার এবং ব্যভিচার দেখতে দেখতে তারা ওসব জিনিসকেই জীবনের মূল অবলম্বন বানিয়ে ফেলেছেন। ফলে আমরা যে যাই মনে করি না কেন তারা কিন্তু মন্দ কাজের মধ্যেই এক ধরনের সীমাহীন তৃপ্তি খুঁজে পায়, অনেকটা ইয়াবা বা ফেনসিডিলের আসক্তির মতো।
এ অবস্থায় আমাদের দেশজ রাজনীতি যে আগামী দিনে কোথায় যাবে, কারা পরিচালনা করবেন এবং কীভাবে করবেন তা ভাবতেই আতঙ্কে গা শিউরে ওঠে। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মই তো আমাদের নেতৃত্ব দেবেন। আসমান থেকে ফেরেশতা কিংবা ভিন গ্রহ থেকে কোনো প্রাণী এনে এই বঙ্গের সিংহাসনে বসানো হবে না। অথবা উন্নত দুনিয়ার কোনো রাজকুমারকেও আমরা নেতা বানাব না। আমাদের ভবিষ্যৎ নেতা হবেন আমাদের সন্তানরা। কাজেই তাদের সুপথে চালানোর জন্য বর্তমান নেতৃত্ব যদি এখনই সতর্ক না হন তবে কেয়ামতের আলামত এ বাংলাদেশ থেকেই শুরু হবে- নাউজুুবিল্লা।
লেখক : কলামিস্ট।