আমাদের দেশে সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিছানা সংখ্যার দ্বিগুণ রোগীকেও ভর্তি করতে হয়। রোগীদের খাবার বাজেট রাষ্ট্রীয় আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হলেও একজন রোগীকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি মেটানো সম্ভব নয়। ধরুন, ঢাকা মেডিকেল কলেজের রোগীর শয্যা সংখ্যা ১৫০০, রোগী থাকেন ৩০০০ বা ২৫০০। সুতরাং পথ্য বরাদ্দ যা থাকে তা আবার ভাগে কমে যায়। একই চিত্র জেলা সদর হাসপাতালগুলোর। সরকারি হাসপাতালগুলোতে যে শুধু নাই-নিস্তারী লোকজন আসে তা নয়, কিছু মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত লোকও আসেন, যারা মনে করেন ওই হাসপাতালে চিকিৎসক বা চিকিৎসার মান সর্বোচ্চ, যদিও স্টার সুবিধাদি নেই যা সাধারণত করপোরেট হাসপাতালগুলোতে থাকে। প্রশ্ন হলো, নিঃস্ব বা নিম্ন, মধ্য এবং উচ্চবিত্ত রোগীদের সরকারি হাসপাতালে এক ধরনের সমাজসেবা প্রয়োজন, কারা দিতে পারেন- এ নিয়েই আমার আলোচনা। আদিকাল থেকে সমাজসেবার প্রচলন। খ্রিস্টপূর্ব ১৭৫০ সালে কিং হামবুরি একে অপরকে সাহায্য করার অর্থাৎ সমাজসেবায় কোড অব জাস্টিস জারি করেন। Philanthropy গ্রিক শব্দ, এর অর্থ ‘Acts of love for humanity’যা গ্রিক সভ্যতায় প্রতিষ্ঠানিক রূপলাভ করেছিল খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ সালে। যেশাস খ্রিস্ট বলেছেন, 'একের প্রতি অন্যের ভালোবাসা- ঈশ্বরের ইচ্ছা'। নবীজি (সা.) অনুসারীদের বলেছিলেন, 'গরিবের প্রতি জাকাত প্রদান একটা নৈতিক দায়িত্ব।' জাকাতের ইংরেজি প্রতিশব্দ যদি ‘Purification tax’ হয় তাহলে জাকাত হলো আপনার অর্থের শুদ্ধি এবং আপনার আত্দার শুদ্ধি। পৃথিবীতে আসা সর্বশেষ ধর্ম ইসলাম সেখানে যে পাঁচটি স্তম্ভের কথা বলেছে 'জাকাত' তার একটি অন্যতম।
হাসপাতালগুলোতে আত্দীয় ও লোকজন আছে এমন এক গ্রুপ, আর কেউ নেই, এ ধরনের এক গ্রুপ রোগী থাকেন। থাকেন নিঃস্ব শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের রোগী। এমন কেউ থাকেন, যারা একা কিছুই করতে পারেন না। আছেন সবল ব্যক্তি, কিন্তু ব্যথায় ছটফট করে কাতরাচ্ছেন বিছানায়। এ রকম হাজারও ধরনের রোগী। তাদের পাশে কি সেবা দরকার...? হাসপাতালে নার্স, ওয়ার্ডবয়, ক্লিনার এমন সংখ্যক নেই যে তারা সবাইকে সবটুকু দিতে পারেন, দেওয়ার মতো সংখ্যায় থাকলেও সেবা দেওয়ার মনটুকু নেই। স্বাস্থ্যসেবা দানকারী এ ধরনের চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয়, ক্লিনার, ট্রলিবয়সহ সবাইকে একসঙ্গে বলা হয় Health care provider দুর্ভাগ্য হলেও সত্য যে, careটা provide করা হয় না।
গত ৬ জানুয়ারি ২০১৫ বিকালে সমাজসেবা অধিদফতর আয়োজিত 'দুস্থ রোগীদের কল্যাণে হাসপাতাল সমাজসেবা ও শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম' এক আলোচনা সভায় এক যুগ্ম সচিব মহোদয় বললেন, ডেলিভারি পদ্ধতিতে ডাক্তারদের ভুলত্রুটির জন্য বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়। সে কথাটা আংশিক সত্য। শুধু ভুলত্রুটি নয়, অবহেলাও দায়ী। তবে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্য জেনেটিক কারণ ছাড়াও প্রিন্যাটাল অর্থাৎ গর্ভাবস্থায় মায়েদের হাম, মামপ্স, রোবেলা টক্সোপ্লাসমোসিস, সিফিলিসসহ বেশকিছু রোগের জন্য এমনকি গর্ভাবস্থায় মা যদি কোনো ওষুধ সেবন করেন (Toxic) তাহলে নবজাতক বিকলাঙ্গ হতে পারে। তবে প্রসব বেদনার শুরু থেকে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত প্রক্রিয়ায় ধাত্রী থেকে শুরু করে সব ধরনের স্বাস্থ্য পরিচর্যা প্রদানকারীর অবহেলা ও অযত্নে অনেক সময় শিশু পঙ্গুত্ববরণ করতে পারে, যাকে বলা হয় পেরিন্যাটাল। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পরও উল্লেখিত কারণ বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াসম্পন্ন অনেক ওষুধ ও রোগের জন্য বিকলাঙ্গতার শিকার হতে পারে। যার অন্যতম হলো জন্ডিস। এ ছাড়াও দুর্ঘটনাজনিত কারণ তো আছেই। তাই বংশধরদের পাপের ফসল পঙ্গুত্ব বা বিকলাঙ্গতা এটা কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া উচিত নয়।
বোবা ও বধির আমেরিকান অভিনেত্রী মারলী ম্যাটলিন অভিনীত ‘Children of the lesser God’ বইটিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য তিনি অস্কার পেয়েছেন। বলতে চাচ্ছি পূর্ণাঙ্গ সহায়তা বা সেবা শুশ্রূষা পেলে যেকোনো Gifted শিশু অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে পারে। এই সেবা-শুশ্রূষা দেওয়ার দায়িত্ব সমাজকর্মীদের। বিশেষ করে Medical Social Worker (চিকিৎসা সমাজকর্মী) যা একটা পৃথক পেশা হওয়া উচিত। চিকিৎসা সমাজকর্মীরা সাধারণত রোগীদের মানসিক অবস্থা এবং তাদের পারিবারিক সম্পর্ক নিরূপণ করে থাকে। তাদের কাজ হলো পরিবারের সঙ্গে রোগীর সম্পর্ক তৈরি করে দেওয়া, কমিউনিটিতে পুনর্বাসন করা, সাইকোথেরাপি দেওয়া, কাউন্সিলিং করা এবং এ ধরনের অন্যান্য রোগীর সঙ্গে সামাজিক বন্ধন সুদৃঢ় করা। আজকের এই বিজ্ঞানের যুগে সামাজিক নেটওয়ার্কের মাধ্যমে যোগাযোগ স্থাপন করে দেওয়া। চিকিৎসা সমাজকর্মীরা, চিকিৎসক, নার্স, ফিজিওথেরাপিস্ট, অকুপেসানেল থেরাপিস্ট, স্পিস থেরাপিস্ট, রিক্রিয়েশনাল থেরাপিস্টসহ সব ধরনের স্বাস্থ্য পরিচর্যাকর্মীর সঙ্গে কাজ করা উচিত। আমাদের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিদ্যা, সমাজকল্যাণ, পুষ্টিবিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিভাগের ছেলেমেয়েরা ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ নিতে আসেন। বলতে দ্বিধা নেই তারা মোটামুটি একটা বিনোদন বা পিকনিক করে যান। তারা কিন্তু রোগীদের দৈহিক পরিচর্যা করতে পারেন, হাত ধরে বারান্দায় হাঁটাতে পারেন, তাদের মাথার পাশে বসে পত্রিকা বা উপন্যাস বা গল্প পড়ে শোনাতে পারেন, তাদের পরিবারের বিদেশে থাকা আত্দীয়স্বজনের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে পারেন। মেডিকেল সোশ্যাল ওয়ার্কারদের দায়িত্ব সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়কে দিতে পারি আমরা। এ ধরনের সমাজকর্মীরা, গৃহহীন, বেকার, আয়শূন্য পরিবার, মাদকাসক্তদের সেবা ও পুনর্বাসনে পূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। সর্বশেষ হাসপাতাল কেমন হওয়া উচিত? Hospital, Hospitality, Hospitable, Hospiece প্রতিটি শব্দ একটি অপরটির সম্পূরক। তাই পাঁচতারা হোটেল, সুদৃশ্য কক্ষ, কার্পেট করা বারান্দাই হাসপাতালের চাহিদা হওয়া উচিত নয়। হওয়া উচিত উপরের চারটি ইংরেজি শব্দের প্রতিফলন।
লেখক : উপাচার্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শাহবাগ, ঢাকা।