১৫ ফেব্রুয়ারি ছিল আব্বুর জন্মদিন। সকালে তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেলাম। অফিসে যেতে যেতে এক সাংবাদিকের ফোন- ‘আপনার বাবা কেমন মানুষ ছিলেন?’ কী উত্তর দেব! করুণার হাসি হেসে বললাম, ‘যে মানুষ দেশের জন্য প্রাণ দেয়, নিজ তারুণ্যের (২৪-৩৬ বছর) বেশির ভাগ সময় জেলে থাকে; যে সময় তরুণরা প্রেম করে, ভালোবাসে, জীবনকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে, সে সময় শহীদুল্লাহ কায়সার গণমানুষের মুক্তির জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেন। স্বাধীন দেশে আজ আমরা স্বাধীনভাবে চলি, আপনি আমি কথা বলি, অভিব্যক্তি প্রকাশ করি; দেশের প্রয়োজনে পরিবারের দায়িত্বকে উপেক্ষা করে যিনি দেশের দায়িত্ব পালন করতে জীবন দিয়ে গেলেন- তিনি কেমন মানুষ হবে বলে আপনার মনে হয়?’
আমার উত্তরে কিছুটা থতমত খেয়ে গেলেন সাংবাদিক বোনটি। মনে মনে বললাম, কী অভাগা এ দেশের মানুষ যে দেশের সূর্যসন্তানকেও ভালোভাবে জানে না। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আব্বুর ওপর ডকুমেন্টারি তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। রাতে বাড়ি ফিরলাম। একজন অতিপরিচিত মানুষ মুঠোফোনে একটা লিংক পাঠাল, বলল দেখতে। দেখলাম চমৎকার, হৃদয়স্পর্শী একটা ভিডিও। বাবা আর ছোট্ট এক মেয়ের গল্প। ভাবলাম এই ঐশ্বরিক, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। বিধাতা এক বছর বয়সেই এই ভালোবাসা কেড়ে নিয়েছেন আমার কাছ থেকে। নিষ্ঠুরের মতো। বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে খুব করে কেঁদে নিলাম। মনে হলো বাবা বেঁচে থাকলে কত কিছু সুন্দর হতো, কত আদরে বড় হতাম, আজ বাবা নেই বলে কত কিছু অসুন্দর। মনে পড়ে গেল সম্পা, শাওন, অমি, অনল, তৌহিদ ভাই, শোভন ভাইয়া, নিশান, নিশি সব শহীদের সন্তানদের চেহারা। আমাকে যে ভিডিও পাঠাল, সে জানত না আজ আমার বাবার জন্মদিন। কিন্তু বাবা-মেয়ের ভিডিওটি একদম উন্মুুক্ত আমার জন্য। ধন্যবাদ দিলাম তাকে অনেক। একটু পরই ঘৃণায়, রাগে, ক্ষোভে সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল। মনে হলো এই সেই জামায়াত-শিবির তাদের দোসর আলবদর যারা বাবাকে হত্যা করেছে, আমাকে বাবার এই অপার স্নেহ থেকে বঞ্চিত করেছে। আমি তাদের কী করে ক্ষমা করব। তখনই মনে হলো নঈম নিজাম ভাই একটা লেখা দিতে বলেছিলেন। হ্যাঁ, আমি লিখব, এখনই লিখব। কলম নিয়ে বসে গেলাম। আমার মতো, আমার বয়সী সব তরুণের জন্য। তোমরা কি জান, চেন? এ দেশে যারা এখন পেট্রলবোমা মারছে? মানুষকে ঝলসে দিচ্ছে? ঝলসে দিচ্ছে একটি জীবন! একেকটি পরিবার, এরা কারা? এরা ওই হায়েনা যারা ’৭১-এ আমার বাবার মতো সবাইকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করেছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছিল। আজ তাদেরই বংশধর একইভাবে এ স্বাধীন দেশের মাটিতে, গণতন্ত্রের নামে, ধর্মের নামে মানুষকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করছে। ওরা এ স্বাধীন দেশে স্বাধীনতার নামে, গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে রোধ করছে। এ সেই একই চক্র যারা চায় না বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর সুস্বাস্থ্য, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি, নারীর বাকস্বাধীনতা। এ সেই একই চক্র যারা চায় না একটি শিশু গানে গানে, কবিতায়, ফাগুনের হাওয়ায়, বৈশাখী ঝড়ো বাতাসে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠুক। চায় না বাংলাদেশের তরুণ সমাজ সত্যিকারের জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হোক। এ সেই চক্র যারা চায় বাংলাদেশের উন্নয়নে বাধা দিয়ে, দেশকে ধর্মের নামে, গণতন্ত্রের নামে জীবনকে জিম্মি রাখতে।
এ সেই অশুভ চক্র যারা বাংলাদেশকে গলা টিপে তার সংস্কৃতি, মুক্তিযুদ্ধ, কৃষ্টি, তার অবয়বকে বিকৃত করতে চায় বার বার। তারাই হত্যা করেছে গণতন্ত্রের অভিযাত্রা। কিবরিয়া হত্যা, আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা, ২০০৮-এ আওয়ামী লীগের বিপুল জয়ের পরপর বিডিআর মিউটিনি- সবই এক শিয়ালের রা। জাগো বাঙালি, জাগো বাংলাদেশ, জাগো। রুখে দাও এই নরপিশাচদের যারা কখনো বাংলাদেশের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেনি, এখনো বিশ্বাস করে না। এরা চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং অশুভ শক্তি। এদের বিরুদ্ধে আমরা সোচ্চার না হলে বাংলাদেশ একদিন আফগানিস্তান হবে, পাকিস্তান হবে। জাগো বাঙালি জাগো। ’৭১-এর মতোই প্রাণ দিয়ে রক্ষা করব আমরা এই দেশ। একটা গানের পঙ্ক্তি মনে পড়ে গেল। কয়েক দিন আগে শুনেছিলাম। এ গানটি শুনলে বাংলাদেশকে মনে হয় আমার পবিত্র সাধনভূমি- ‘রক্ষা কর আঁধারে ঘেরা মানুষ থেকে/আমার উপাসনালয়, ঈশ্বরের উপহার/রক্ষা কর পবিত্রতা, রক্ষা কর আমায়/ফিরিয়ে দাও সোনালি হাসিমাখা দিন।’