ঘরের বাইরে মতিঝিলের ফুটপাথে ৬৫ দিন অবস্থান শেষে নিরন্তর যাত্রার আজ ৮৫ দিন। কেন যেন বেশ ভালোই লাগছে। রাস্তার সাধারণ মানুষ যে অনেক জ্ঞানী-গুণীর চেয়ে বিজ্ঞ, তা রাস্তায় রাস্তায় দেখতে পাচ্ছি। গতকাল ছিলাম ১২ নম্বর আছিম পাটুলী ইউনিয়ন পরিষদের খোলা চত্বরে। জায়গাটি বড় মনোরম। সামনে পাকা রাস্তা, পেছনে দোতলা পরিষদের ভবন, পুবপাশে পুকুর, পশ্চিমে অনেক নিরিবিলি খোলা জায়গা। আছিম আমার বহুদিনের পরিচিত, মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার। কত আনন্দ-বেদনার স্মৃতিবিজড়িত আছিম। বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামে ১৬ বছর নির্বাসনে কাটিয়ে প্রথম যখন আছিম এসেছিলাম, তখন সভায় তিল ধরার ঠাঁই ছিল না। এই আছিমের বাশদি গ্রামের আবুল কাশেম মুক্তিযুদ্ধে ভুয়াপুরে শহীদ হয়েছিল। সভা শেষে তার বাড়ি গিয়েছিলাম। তখন কাঁচা রাস্তা থেকে চকের মধ্য দিয়ে অনেক দূর হেঁটে যেতে হয়েছিল। আজ প্রায় ছয় মাস কাশেমের কথা ভাবছি। এখন রাস্তাঘাট হয়ে যাওয়ায় বাড়িঘর চেনা যায় না। গতকাল সকালে হঠাৎই কাশেমের ভাতিজা লাল মিয়া এসে হাজির। মনে হলো এ যেন আল্লাহর দান, যা চেয়েছি তাই পেয়েছি। '৯১-এ আছিমের সেই সভা শেষে মফিজের বাড়িও গিয়েছিলাম। বীর মুক্তিযোদ্ধা মফিজ যেমন '৭১-এ ছিল, তেমনি '৭৫-এ প্রতিরোধ সংগ্রামে শরিক হয়েছিল। '৭৫-এর অক্টোবর-নভেম্বরের দিকে মুক্তাগাছায় এক চেয়ারম্যানের বাড়িতে আশ্রয়ে থাকা অবস্থায় সরকারি বাহিনী তাদের ঘিরে ফেললে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। তাতে মফিজসহ চারজন ঘটনাস্থলেই মারা যায়। বিশ্বজিৎ নন্দী মারাত্দক আহত হয়ে ধরা পড়ে। প্রায় বছর দুই চিকিৎসা করে শাসকগোষ্ঠী তাকে ফাঁসির আদেশ শোনায়। ১২-১৩ বছর ফাঁসির সেলে থেকে আল্লাহর অসীম দয়ায় শেষে মুক্তি পায়। কিন্তু এখন সরকার বা আওয়ামীরা তার কোনো খবর রাখে না। অবস্থানের এক পর্যায়ে ৮৪ দিনের মাথায় আছিমের মানুষের অভূতপূর্ব সমর্থন পেলেও প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের একেবারে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে। আছিম পৌঁছার আগে এনায়েতপুর ইউনিয়নের সোয়াইতপুর উচ্চবিদ্যালয় মাঠ থেকে তাঁবু তুলে ভবানীপুরে কিছুক্ষণ ছিলাম। জোহরের নামাজ সেখানেই পড়েছি। জীবনে খাবারে কত কষ্ট করেছি, কিন্তু ভবানীপুর খাওয়ার জুলুমে মরতে বসেছিলাম। সে এক নতুন অভিজ্ঞতা। সোয়াইতপুর স্কুল মাঠে দুপুরের খাবার এসেছিল ২৮ বাড়ি থেকে। চান মিয়া সোয়াইতপুরে আমাদের দলের সভাপতি। দলীয় নেতা-কর্মীরা অসম্ভব সফলতার পরিচয় দিয়েছে। স্কুলের পুবপাশে মুক্তিযুদ্ধের সময় মাহু তালুকদারের দোতলা বাড়ি ছিল। তা এখন ভেঙে দালানকোঠা, টিনের ঘরদোর হয়েছে। চার ভাইয়ের তিনজন আমজাদ তালুকদার, লেজু তালুকদার, আলতা তালুকদার মারা গেছে। শুধু মনসুর উদ্দিন তালুকদার এখনো বেঁচে আছেন। কিছু দিন হলো প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হয়েছেন। কিন্তু তার পরও সকালে আমাকে দেখতে আসায় আমি ভীষণ অভিভূত হয়েছি। তাই বিদায়ের সময় তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তিনি গাছতলায় বিশ্রামে ছিলেন। তালুকদারবাড়ির সব বউ খাওয়া-দাওয়ায় অসম্ভব সহযোগিতা করেছে। প্রায় সবাই আমাদের দলভুক্ত হয়ে গেছে। সোয়াইতপুর স্কুলের গভর্নিং কমিটির সদস্য সুস্বাস্থ্যের অধিকারী সোলেমান খাবার নিয়ে সব সময় দৌড়াদৌড়ি করেছে। সোলেমানের বাড়িতে এর আগেও খেয়েছিলাম। রাতে গুপ্ত বিন্দাবনের তমালতলার শুকুর মাস্টার এসেছিল। সে এবার হজে যাবে তাই দেখা করতে এসেছিল। মুক্তিযুদ্ধে শুকুর মাস্টার অনেক কাজ করেছে, আফাজ দূত হিসেবে আছিম এলাকায় যে কাজ করেছে তার তুলনা হয় না। রূপ শিকদারের ছেলে মোকদম ও জামাল শিকদারের ভাই লালুও সোয়াইতপুরে এসেছিল। সকালের নাশতা এনেছিল আকরাম। সোহেলের সঙ্গে আকরাম প্রায় ১০ বছর আমার বাড়িতে ছিল। বড় ভালো ছেলে। এখন মুরগির ডিমের চাষ করে মোটামুটি আছে। ছেলেটা আমার নজরে আসে বছর পঁচিশ আগে। তার বাবা যখন জমিজমা ছেলেমেয়েদের মধ্যে ভাগ করে দেয় তখন আকরাম ছিল ক্লাস এইটের ছাত্র। তার ভাগে পড়েছিল এক জোড়া মহিষসহ গাড়ি আর কিছু জমি। সে সেই মহিষের গাড়ি বেয়ে লেখাপড়া করেছে। আমি যখন তাকে প্রথম দেখি সে তখন করটিয়া কলেজে অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্র। মহিষের গাড়ি চালিয়ে একটা ছেলে অনার্স পর্যন্ত পড়তে পারে, এতে আমি বড় উৎসাহী হয়েছিলাম। তবে সে কষ্ট করে পড়তে পারলেও আমার সহযোগিতায় এগোতে পারেনি। মিছিল-মিটিংয়ে জড়িয়ে পড়া, তারপর বিয়ে করা, পরে বাচ্চা-কাচ্চা- তাই আর লেখাপড়া হয়নি। কিন্তু এখন মুরগির ডিমে তার মোটামুটি সংসার চলে। সকালে আকরাম সবার জন্য নাশতা, আমার জন্যও আলাদা রুটি এনেছিল। সেখান থেকে এসেই ভবানীপুরে অমন বিপদে পড়েছিলাম। আছিম আমার প্রিয়। এখানে এসেও বিপদ কাটেনি। একে তো অতিরিক্ত খাদ্যের বিপদ, দুই ৪ বৈশাখ, ১৮ এপ্রিল সে কি প্রলয়ঙ্করী ঝড়! তাঁবু টিকে থাকলেও ঝড়তুফান সইতে পারেনি। কাপড়-চোপড়, বই-পুস্তক ভিজে একাকার। মারাত্দক তুফানে সহস্রবার 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ' পড়েছি। বরফের মতো ঠাণ্ডা পানি উপেক্ষা করে দলীয় কর্মীরা মাথার ওপর ত্রিপল ধরে রেখে বৃষ্টির হাত থেকে আমাকে রক্ষা করেছে।
আছিমের আগে সোয়াইতপুর, তারও আগে সখীপুরের কীর্তনখোলায় ছিলাম। কর্মসূচির মাঝে পয়লা বৈশাখ পড়ায় সখীপুরের কীর্তনখোলায় চার রাত কাটিয়েছি। প্রথম ইছাদীঘিতে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পরে মনে হলো সিস্টোর-সখীপুর সড়কের পাশে বাঘবেড়ে থাকা ভালো। কিন্তু গিয়ে দেখি বৈশাখী মেলার প্রস্তুতি চলছে। তার পরও থাকতে চেয়েছিলাম। পরে হঠাৎই মনে হলো আরও দুই কিলোমিটার পশ্চিমে কীর্তনখোলায় তাঁবু ফেললে কেমন হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর সখীপুরের কোথাও একনাগাড়ে চার রাত কাটাইনি। বড় ভালো লেগেছে। সবুর মেম্বার, বাদল বিডিআর, লাল মিয়া, সবুর মেম্বারের ছেলে হাবিব, দলের সভাপতি লাল মিয়া, সাধারণ সম্পাদক জুলফিকার শামীম, ছাত্রনেতা নাজমুল, আজাদ, রাসেল, ইদ্রিস শিকদার, খোয়াজ আলী, আক্কেল মাস্টার, আজিজ মাস্টার, রমজান, মতিয়ারসহ আরও কতজন যে ছায়ার মতো ছিল। নিষ্ক্রিয় কর্মীরা প্রাণ পেয়েছিল। পয়লা বৈশাখ বাঙালির হৃদয়ের স্পন্দন, হাজার বছরের কৃষ্টি সভ্যতা। কিন্তু বৈশাখ বা বৈশাখী মেলার নামে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনায় মেয়েদের ওপর যে ন্যক্কারজনক আক্রমণ হয়েছে তার নিন্দার ভাষা আমার জানা নেই। দেশে এখন নারী নেতৃত্ব ও কর্তৃত্বের স্বর্ণযুগ। এই সময় আমাদের মেয়ে সন্তানরা নির্যাতিত কেন হবে? নারী নেতৃত্ব নারীদেরই যদি রক্ষা করতে না পারে তাহলে তারা পুরুষদের রক্ষা করবে কী করে? দেশ রক্ষা তো দূরের কথা। তাই নেতা-নেত্রীদের এ ব্যাপারে ভেবে দেখতে অনুরোধ করি। হয় দেশটাকে সুন্দরভাবে চালান, না পারলে গদি ছাড়ুন, পদত্যাগ করুন। ১৭ তারিখ মুজিবনগর দিবসে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া রওনা হওয়ার আগের দিন বিকালে এক কর্মিসভায় অসাধারণ ঘটনা ঘটেছে। সকাল সাড়ে ৭-৮টায় সেকান্দারের স্ত্রী মরিয়ম চার-পাঁচ বছরের নাতি সাব্বিরকে নিয়ে এসেছিল। মোতালেবের ছেলে সাব্বির বাবার কাছে বায়না ধরেছিল, কাদের সিদ্দিকীকে দেখতে যাবে, খালি হাতে যাওয়া যাবে না। তাই ১০ টাকার বিস্কুট নিয়ে এসেছিল। বিকালে কর্মিসভায় বিস্কুটের প্যাকেট নিলামে তুলতে চেয়েছিলাম। শ্রোতাদের বলেছিলাম, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জনক মহাত্দা গান্ধীর এক প্রার্থনা সভায় শত মাইল দূর থেকে এক বৃদ্ধা এসে তাকে এক পয়সা দান করেছিলেন। সেই পয়সাটি তিনি সেই প্রার্থনা সভায়ই বিক্রি করতে চেয়ে জনতার উদ্দেশে বলেছিলেন, 'শত মাইল দূর থেকে আসা আশীর্বাদ স্বাধীনতার জন্য আমি বিক্রি করতে চাই। এই দান কে গ্রহণ করতে পারে?' শতবর্ষ আগে সেই এক পয়সা লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছিল, যা এখন কয়েক লাখ পাউন্ডের বিনিময়ে ইংল্যান্ডের জাতীয় জাদুঘরে শোভা পাচ্ছে। যেই বলেছিলাম, সাব্বিরের দাদির দেওয়া এই বিস্কুটের প্যাকেট বেচতে চাই। কেউ কেনার আছে? সঙ্গে সঙ্গে ৫০ টাকা দর উঠল। পাশের জন ১০০ টাকা। তারপর ২০০, ৫০০, ১০০০, ৩০০০ শেষ পর্যন্ত ৫০০০ টাকায় গিয়ে ঠেকে। কালিয়ার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সেলিম বিস্কুটের প্যাকেটটি শেষ পর্যন্ত ৫০০০ টাকায় করায়ত্ত করে। সেলিমের ছেলে রাজু ঢাকার অবস্থানে আমায় দেখতে গিয়েছিল, খুবই ভালো ছেলে রাজু। বড় ভালো লেগেছে সখীপুরের কীর্তনখোলায় কয়েকটা দিন। মনে হচ্ছিল পাহাড়ের মানুষ আবার জেগে উঠেছে।
গতকাল পর্যন্ত আছিম ইউনিয়ন পরিষদের সামনেই ছিলাম। ইউপি চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের নেতা সাইফুল ইসলামের দুই দিনে দেখা নেই। এমনকি পরিষদের বিদ্যুতের লাইন ভিতর থেকে বন্ধ করে দিয়েছে। পায়খানা-পেশাবের ঘর এমন নোংরা যা আগেকার দিনে মেথরের মল বইবার চাড়ির চেয়েও খারাপ। এসবই বর্তমান সরকারের মুক্তিযোদ্ধাদের বিপুল সম্মানের নমুনা। ৬ তারিখ জাতীয় স্মৃতিসৌধের গেটে ছিলাম। সমগ্র স্মৃতিসৌধে বাতি ছিল, কিন্তু আমার উপরের বাতিগুলো ইচ্ছা করে নিভিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কেন জানি হঠাৎই মনে হয়েছিল, মৃত যোদ্ধাদের স্মৃতিতে হাজারো বাতি, জীবিত থাকার অপরাধে আমার উপরে বাতি নেই, নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার পরও কী করে বলি, এটা মুক্তিযুদ্ধের সরকার। বেঁচে থাকা কি এতই অপরাধ? মরে গেলে বাতি জ্বলে, বেঁচে থাকলে জ্বলে না, নিভিয়ে দেওয়া হয়! একজন মুক্তিযোদ্ধাকে সামান্য আলো দিলে দেশের কী এমন ক্ষতি? রশিদ বয়াতি গাইতেন, 'পাগল মরলে বাতি জ্বলে, মুন্সী মরলে জ্বলে না'। তার গানই কি তাহলে সত্য? মৃতের জন্য হাজারো বাতির আলো ঝলমল ইন্দ্রপুরীর ইশারা আর জীবিতের কপালে অন্ধকার। এক বুক ব্যথা নিয়ে পদ্মা পেরিয়েছিলাম। থাকার কথা ছিল পাচ্চর। আওয়ামী কারসাজিতে সেখানে থাকা হয়নি। পরে সংসদ সদস্য কর্নেল ফারুক খানের নির্বাচনী এলাকা কাশিয়ানীর হোগলাকান্দির কুমার নদের পাড়ে ১৫৬ নম্বর হোগলাকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছোট্ট মাঠে ছিলাম। সেখানে বাচ্চাদের সঙ্গে এক অনাবিল আনন্দে কয়েকটা ঘণ্টা কেটেছিল। ক্লাস থ্রির মিম্মা, সখিনা, তানজিলা, ইশরাত, রেহানা, ইয়াসমিন, আরিফা, জয়া, চৈতী, শাহীন, সামী, রুনা সাথীদের নিয়ে আমায় এক অমূল্য ধন কলম উপহার দিয়েছিল। গত পর্বে নামগুলো লিখতে ভুলে গিয়েছিলাম সে জন্য ক্ষমা চাইছি।
একজন জীবিত মুক্তিযোদ্ধার জন্য জাতীয় স্মৃতিসৌধ অন্ধকার, তার মাথার উপরের বাতি নিভিয়ে দেওয়ায় কিছুটা বেসামাল হয়েছিলাম। তাই মহান ব্যক্তিদের কবরে ফাতিহা পাঠের অনুভূতি ভালোভাবে ব্যক্ত করার কথা ভুলে গিয়েছিলাম। ১০ এপ্রিল সকাল ১০টায় জেলখানায় নিহত জাতীয় নেতাদেরসহ বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের কবর জিয়ারত করে বীরউত্তম জিয়াউর রহমান এবং তিন জাতীয় নেতা শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমউদ্দিনের কবরে ফাতিহা পাঠ করেছি। বনানীতে জাতীয় নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের কবরে কিছুটা লোকজন ছিল। বনানী কবরস্থানের গেটের বাম পাশেই জাতীয় নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের কবর। ওরকম কঠিন সময়েও গেটের পাশে অমন ভালো জায়গায় কেন কবর দেওয়া হয়েছে আমার বোধগম্য নয়। এখন অমন ঘটনা ঘটলে নিশ্চয় কবরস্থানের দুর্গম কোনো স্থানে ফেলে রাখা হবে, যাতে কবরগুলো খুঁজে পেতে কষ্ট হয়। জিয়ার কবর খুবই শানশওকত করে বিরাট জায়গা নিয়ে করা হয়েছে। যেহেতু বিরোধী সরকার, সেহেতু রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই। একেবারে নোংরা, ধূলি-ময়লায় ভরা, এতিমের মতো পড়ে আছে, দেখাশোনার কেউ নেই। সবচেয়ে মর্মান্তিক তিন জাতীয় নেতার কবর। যেখানে কিছু নেই, কেউ নেই। পিডব্লিউবির তত্ত্বাবধানে কবর তিনটি এমন অবহেলা আর অনাদরে পড়ে আছে যা কহতব্য নয়। মূল কবরে ঢোকার পথ সব সময় তালাবদ্ধ থাকে, থাকাই উচিত। না হলে মাতালেরা ফাতিহা পাঠের বদলে নেশা করে। ১০ তারিখ সাড়ে ১১-পৌনে ১২টায় শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও খাজা নাজিমউদ্দিনের কবর জিয়ারতে গিয়েছিলাম। এরা তিনজনই ছিলেন পুরুষ প্রধানমন্ত্রী। তাদের কবরে প্রায় ইঞ্চি দেড়েক ধুলা পড়ে আছে, পরিষ্কার করার কেউ নেই। বর্তমানরা যখন প্রাক্তন হবেন, তাদের কবরে শুধু ধুলা নয়, হয়তো ময়লার পাহাড় জমবে। জাতীয় তিন নেতা, জিয়াউর রহমান, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্য, এমনকি বঙ্গবন্ধুর কবরেরও সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ দেখিনি। এ ক্ষেত্রে হুজুর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মাজারের মর্যাদা ভক্তদের কারণে কিছুটা ভিন্ন। বর্তমানে আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধুর কবরে ৩০ জন গার্ড রেখেছে। কিন্তু কবর ধোয়ামোছা, পয়পরিষ্কার করে আলভী নামের ২০-২৫ বছরের একটি ছেলে। আমি বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে রাত কাটিয়েছি। সেখানে ফুলের টবে পিঁপড়া-মাকড়সা দেখেছি কিন্তু হুজুরের মাজারে তা দেখিনি। শেরেবাংলা, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, খাজা নাজিমউদ্দিনের কবর অত অনাদরে পড়ে থাকলে বর্তমানে যারা শানশওকতে আছেন, তারা অতীত হলে তাদের কবরের অবস্থা যে এমন হবে না তা কে বলতে পারে, কেন যেন ব্যাপারগুলো আমায় খুবই ভাবায়। ঘরের বাইরে ঘুরতে গিয়ে কত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, যার বিন্দু-বিসর্গ কদিন আগেও ছিল না।
গতকাল সকালেও একের পর এক লোকজন ১০, ২০, ১০০ টাকা কুচিমুচি করে আমাদের দানবাক্সে ফেলেছিল। তা দেখে চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা আমার হাত থেকে চকলেট নিয়ে দানবাক্সে ফেলে গুটি গুটি পায়ে কাছে এসে আমায় জড়িয়ে ধরে বলেছিল, 'ওটা তোমায় আমি দান করলাম'। কী আনন্দই না লেগেছে। আজ আমরা ফুলবাড়িয়া সদরে। কাল অথবা পরশু কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশালের দিকে পা বাড়াব। তবে আছিমের সেদিনের ঝড়তুফান খুব সহজে ভুলব না। মুক্তিযুদ্ধের কারণে আছিম আমার স্মৃতিতে এমনিতেই অম্লান, তার ওপর নতুন করে অমন দুর্যোগ-দুর্বিপাক বাকি জীবন সব সময় আছিমের মিঠেকড়া মধুময় স্মৃতি মনে করিয়ে দেবে। সঙ্গে সঙ্গে হয়তো আওয়ামীপন্থি ১২ নম্বর আছিম পাটুলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের কথাও।
লেখক : রাজনীতিক