তিন সিটির যে নির্বাচন জনমনে শান্তি ও স্বস্তির পরশ বুলিয়েছিল, শেষদিকে এসে তা শঙ্কা ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে। প্রশ্ন জেগেছে, এই নির্বাচন কি অবাধ, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ হবে? বিরোধী দল বিএনপি, এমনকি শাসকলীগের ঘনিষ্ঠ মিত্র জাতীয় পার্টির প্রার্থীরাও অভিযোগ করেছেন যে, তারা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড পাননি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও কর্মীবাহিনী তাদের নানাভাবে হয়রানি করছে। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর জন্য চলছে হুমকি-ধমকিসহ নানা ধরনের চাপ। নির্বাচন কমিশনে অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাওয়া যাচ্ছে না।
এর আগের দুটি লেখায়ও লিখেছি যে, তিন সিটি করপোরেশন নির্বাচন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারে কোনো অদল-বদল ঘটাবে না। ক্ষমতাসীনরা যদি তিনটি সিটিতেই পরাজিত হন, তাহলেও যারা জিতবেন তাদের দল রাষ্ট্রক্ষমতা পাবে না। তবে সরকার বদল না হলেও এই নির্বাচন সুষ্ঠু ও সুচারুভাবে সম্পন্ন হলে দেশের রাজনীতির চেহারা বদলে যাবে এমন একটা উচ্চাশা ছিল। এ বছর জানুয়ারির শুরু থেকে মার্চের শেষ অবধি তিন মাস দেশ ছিল শান্তিহীন, স্বস্তিহীন, এমনকি গন্তব্যহীন। হিংসা-হানাহানি-সহিংসতা-নাশকতায় বিবর্ণ হয়ে গিয়েছিল বাংলার সবুজ দৃষ্টিনন্দন রূপ। প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় নানা প্রকার পরিসংখ্যান ছাপা হলেও এবং শাসক দলের লোকেরা বিভিন্ন জন বিভিন্ন সংখ্যা উল্লেখ করলেও দেশের দায়িত্বশীল জাতীয় সংবাদপত্রগুলোর অধিকাংশের হিসাব অনুযায়ী ওই তিন মাসে সহিংসতা-নাশকতায় মৃতের সংখ্যা ১৪২ জন। সরকারি দলের পক্ষ থেকে সব মৃত্যুকে পেট্রলবোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগের মাধ্যমে হত্যা বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে এবং অভিযুক্ত করা হচ্ছে বিএনপি-জামায়াতকে। কিন্তু এই ঢালাও অভিযোগটাও সত্য নয়। মিডিয়ায় প্রকাশিত পরিসংখ্যান বলে, পেট্রলবোমা ও আগুনে দগ্ধ হয়ে মৃতের সংখ্যা ৭৯। বাকি ৬৩ জন মারা গেছেন বিচারবহূর্ভূত ক্রসফায়ার, সংঘর্ষ ও অন্যান্য কারণে। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ যাই থাক তিন মাস দেশে শ্বাসরুদ্ধকর একটা পরিস্থিতি ছিল। তিন সিটি নির্বাচন মানুষের শ্বাস ফেলার একটা ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। ধারণা করা গিয়েছিল, এই নির্বাচন অসহনীয় পরিস্থিতির অবসান ঘটাবে এবং দেশ ফের নৈরাজ্যকর জগতে প্রবেশ করবে না; সিটি নির্বাচনের পর আরও বড় কোনো রাজনৈতিক অর্জন হবে। অন্তরালের কোনো শুভ উদ্যোগেরই 'সোনালি ফসল' ভেবেছিল মানুষ এই ছোট্ট নির্বাচনকে। এই নির্বাচনী সিদ্ধান্তের গোড়ার দিকে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার প্রতি সরকারের সদাচরণও মানুষের মধ্যে এমন ধারণার সৃষ্টি করেছিল। কিন্তু তিন সিটি নির্বাচনে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর এই নির্বাচন যেমনটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ হবে বলে ভাবা হয়েছিল সেই ভাবনাগুলো সরকার ও নির্বাচন কমিশন ওলট-পালট করে দিচ্ছে বলে মনে হয়। এমন একটি আশা-জাগানিয়া নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য করার জন্য সরকার, বিশেষ করে নির্বাচন কমিশন যা কিছু করণীয় সবকিছুই করবে এমন একটা দৃঢ় প্রত্যাশা ছিল সবার। নির্বাচনে সব প্রার্থী নির্বাচনসংশ্লিষ্ট সব কাজে সমান সুযোগ পাবেন এটা কারও দয়া-দক্ষিণার বিষয় নয়। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, সব প্রার্থী, বিশেষ করে সরকারবিরোধী প্রার্থীরা সে সুযোগ পাচ্ছেন না। ঢাকার দুই সিটির ৯৩ ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীর মধ্যে ৫৪ জনের বিরুদ্ধেই বর্তমানে ফৌজদারি মামলা রয়েছে। এসব মামলার বেশির ভাগই ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে করা। নির্বাচন কমিশন এদের সবার প্রার্থিতা বৈধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করেনি। প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থক এবং পরিবারের লোকজনকেও হয়রানি করছে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অথবা সরকারদলীয় প্রার্থী কিংবা তাদের লোকজন। ঢাকা দক্ষিণে বিএনপি সমর্থিত মেয়র প্রার্থী মির্জা আব্বাস সশরীরে প্রচারণায়ই নামতে পারেননি জামিন না পাওয়ায়। অন্যরাও জামিন পাননি। গ্রেফতারের ভয়ে আদালতে যেতেও সাহস পাননি অনেকে। অথচ আওয়ামী লীগ সমর্থিত অনেক প্রার্থীর বিরুদ্ধেও ফৌজদারি মামলা ছিল; কারও কারও বিরুদ্ধে ছিল হত্যা মামলা বা হত্যা প্রচেষ্টার মামলা। কিন্তু নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণাসহ অন্যান্য কর্মকাণ্ডে অবাধে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে তাদের কারও মামলা সরকার আগেই প্রত্যাহার করে নিয়েছে, কেউ কেউ জামিন নিয়ে নিশ্চিন্তে কাজ করছেন।
১৭.৪.২০১৫ দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবরে দেখা যায়, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ২৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী সলিম উল্লাহ সলুর বিরুদ্ধে ৩০২/৩৪ দণ্ডবিধিতে চারটি মামলা ছিল। এর মধ্যে সব কটি থেকেই অব্যাহতি বা খালাস পেয়েছেন তিনি। ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী জামাল মোস্তফার বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা ছিল। কাফরুল থানায় ৩০৭ ধারায় করা একটি মামলা (২৮ নম্বর মামলা) তদন্ত কর্মকর্তা চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে তাকে অব্যাহতি দিয়েছেন। বাকি চারটি মামলার তিনটি প্রত্যাহার ও একটি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।
৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী আবদুর রউফও দুটি মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ-সমর্থিত প্রার্থী সফিউল্লার বিরুদ্ধে ৩০২/৩৪ দণ্ডবিধিতে ২০০২ সালে তেজগাঁও থানায় মামলা হলেও তাকে অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অন্য ধারায় আরও দুই মামলায় অব্যাহতি ও চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
দক্ষিণ সিটির ২ নম্বর ওয়ার্ডের ক্ষমতাসীন দলের কাউন্সিলর প্রার্থী আনিসুর রহমানের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে ৩০২ ধারায় একটি হত্যা মামলা হয়। এ ছাড়া ২০০৭ সালে বিস্ফোরক আইনে ও অন্য ধারায় দুটি মামলা হয়। তিনটি মামলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করেছে।
১৬ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী হোসেন হায়দারের বিরুদ্ধে ১৯৯৯ সালে হত্যা মামলা হয়েছিল। মামলাটি ২০১০ সালে প্রত্যাহার করা হয়। ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী গোলাম মোস্তফার মোট চারটি মামলা প্রত্যাহার করা হয়। এর মধ্যে একটি হত্যাচেষ্টার। বাকিগুলো বিস্ফোরক আইনসহ দণ্ডবিধির অন্যান্য ধারায়।
দুটি মামলায় পুলিশের অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয় ৪৩ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী মোহাম্মদ সাহিদকে। ৫০ নম্বর ওয়ার্ডের সায়েম খন্দকারের বিরুদ্ধে ১৩টি মামলা ছিল। সবকটি থেকে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি হত্যা ও তিনটি হত্যাচেষ্টার মামলা।
৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী ইলিয়াস রশীদের নামে ২৩টি মামলা ছিল। এর মধ্যে একটি হত্যা ও দুটি হত্যাচেষ্টার। এগুলোর মধ্যে ৮টি প্রত্যাহার করা হয়েছে। বাকিগুলো থেকে তিনি অব্যাহতি অথবা খালাস পেয়েছেন। তবে তার নামে ২০০৭ সালের একটি হত্যা মামলা এখনো বিচারাধীন।
বিএনপির ক্ষেত্রে চিত্রটি ভিন্ন। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নামার আগে-পরে তাদের অনেকেই জামিন না পেয়ে পালিয়ে থেকে আতঙ্কের মধ্যে নির্বাচনী কাজ পরিচালনা করছেন স্ত্রী, সন্তান, পরিবারের লোকজন, কর্মী-সমর্থকদের দিয়ে। সেখানেও বাধা পাচ্ছেন তারা। দু-একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যায়- মির্জা আব্বাসের নির্বাচনী সেল থেকে পাঠানো বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়েছে, ১৬ এপ্রিল-২০১৫ প্রচারণাকালে জজকোর্ট এলাকায় কয়েকজন সমর্থককে মারধর করা হয়েছে এবং প্রচারণার মাইক ছিনিয়ে নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। ১৬ এপ্রিল-২০১৫ রাতে খিলগাঁও বাগিচা মোড়ে পোস্টার টানানোর সময় আব্বাসের প্রচারকর্মী শরীফুল ইসলাম উজ্জ্বলের ওপর হামলা করে সরকার সমর্থকরা। পরে শাজাহানপুর থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে দুটি মামলা করে। এ ছাড়া ঝিলপাড়ে সাদা পোশাকে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও কিছু স্থানীয় সন্ত্রাসী নির্বাচনী প্রচার কাজে বাধা দিয়ে একটি রিকশা-ভ্যানে স্থাপিত মগ প্রতীক ভেঙে দেয় এবং হুমায়ুন নামে মির্জা আব্বাসের এক সমর্থককে মারধর করে। ১৯ এপ্রিল-২০১৫ সকালে ঝিগাতলায় গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণের সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা খায়ের মহিউদ্দিনের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ কর্মীরা।
১৬ এপ্রিল-২০১৫ সন্ধ্যায় মিরপুর থানা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক শাহাবউদ্দিনকে গণসংযোগ চালানোর সময় গ্রেফতার করে মিরপুর থানা পুলিশ। একইভাবে প্রচারণা চালানোর সময় ১৮ এপ্রিল-২০১৫ রাত ৮টায় রাজধানীর চামেলীবাগ থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী বিএনপি নেতা কাজী হাসিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে পল্টন থানা পুলিশ। এ ছাড়া ঢাকা দক্ষিণ ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মো. নাঈমের বাসায় ১৬ এপ্রিল রাতে তল্লাশি চালিয়েছে পুলিশ। এসব ঘটনার পর যারা প্রকাশ্যে আসার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তারাও ফের আত্দগোপনে চলে যান। ঢাকা দক্ষিণ ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী মো. মোহন জানান, বাসার সামনে সবসময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছেন। নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনার পরও তাদের এমন আচরণ দেখে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, সরকার বড় না পুলিশ বড়।
এরশাদের জাতীয় পার্টিরও অভিযোগের অন্ত নেই। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের অনেককেই ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিষয়টি নিয়ে দলটির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু ঢাকা মহানগর জাতীয় পার্টি দক্ষিণের আহ্বায়ক সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এবং সদস্য সচিব জহিরুল আলম রুবেলকে সঙ্গে নিয়ে সম্প্রতি আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের গুলশানের বাসায় বৈঠকও করেন। কোন কোন কাউন্সিলর প্রার্থীকে হয়রানি করা হচ্ছে এর একটি তালিকাও তার কাছে দেন জাতীয় পার্টির নেতারা।
মাহবুব-উল আলম হানিফের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়টি স্বীকার করে জহিরুল আলম রুবেল বলেন, তিনি বিষয়টি দেখবেন বলে তাদের আশ্বস্ত করলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তিনি জানান, বিষয়টি নিয়ে যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি ইসমাইল হোসেন সম্রাটের সঙ্গেও কয়েক দফা টেলিফোনে কথা বলেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।
১১ নম্বর ওয়ার্ডে জাতীয় পার্টি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থী সেলিম আহম্মদের কাজিরবস্তি এলাকায় অবস্থিত একটি নির্বাচনী ক্যাম্প ১৮ এপ্রিল-২০১৫ আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর লোকজন বন্ধ করে দেয়। এর আগে তার খিলগাঁও বাগিচা এবং ঝিলপাড়ের আরও দুটি নির্বাচনী ক্যাম্প বন্ধ করে দেয় আওয়ামী লীগ সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীর লোকজন।
এ ছাড়াও জাতীয় পার্টি সমর্থিত ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রার্থী হাজী ইসমাইল হোসেন, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী আশরাফ হোসেন রাসেল, ৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী মো. আলমাস উদ্দিন, ১০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী জুবের আলম রবিন, ১৩ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী হুমায়ুন মজুমদার, ২০ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী হাজী আমানত উল্লাহ, ৫১ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী কাওছার আহম্মেদকে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে নানাভাবে হয়রানি এবং ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে বলে তারা অভিযোগ করেন।
সবচেয়ে উদ্বেগজনক খবর হলো নির্বাচনী প্রচারাভিযানকালে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার ওপর শাসক দলের ক্যাডারদের হামলা। বেগম জিয়া নিজে বলেছেন, তাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই তার ওপর হামলা চালানো হয়েছে। হামলার ঘটনা একবার ঘটেনি, ঘটেছে তিনবার। প্রতিবারই হামলার ভয়াবহতা বেড়েছে। সরকারি মন্ত্রী-মিনিস্টাররা বলছেন, তিন মাসের সহিংস আন্দোলনের জন্য খালেদা জিয়ার ওপর ক্ষুব্ধ জনগণ এ হামলা করেছে। কিন্তু বহুল প্রচারিত অনেক প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ছবি ছাপানো ও দেখানো হয়েছে হামলাকারীদের। ২৩ এপ্রিল একটি ইংরেজি দৈনিকে ছবিসহ কারওয়ান বাজারে খালেদা জিয়ার ওপর হামলাকারীদের যে রাজনৈতিক পরিচয় ছাপা হয়েছে তারা সবাই ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। সরকারপক্ষ কোন মুখে বলছেন বিক্ষুব্ধ জনতা হামলা করেছে খালেদা জিয়ার ওপর?
ভোট গ্রহণের ৮/১০ দিন আগে বেগম জিয়ার ব্যাপারে সরকারের যে মনোভাব ছিল তা কী পাল্টে গেল? নাকি এটা সরকারের মধ্যকার কোনো সরকারের খেলা- যারা চায় না এই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হোক! তারা হয়তো ভাবছে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হলে সরকার সমর্থিত প্রার্থীরা জিততে পারবেন না। তাতে এ মুহূর্তে ক্ষমতা না হারালেও দ্রুত নড়বড়ে হয়ে যাবে মসনদ। ক্ষমতার স্বাদ, ভোগ বিলাস এবং বিত্ত-বৈভব গড়ার সুযোগ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই এভাবেই চলুক। এমনকি কেউ বিএনপিকে হয়তো এভাবে সংঘাতের পথে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। সেনা মোতায়েন নিয়ে নির্বাচন কমিশনই বা কী করল? সরকার পক্ষ ছাড়া সবাই সেনা মোতায়েনের দাবি জানিয়েছেন। কেন তা চেয়েছেন তা মানুষ জানে। নির্বাচন কমিশন ২৬ এপ্রিল থেকে সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় সবাই খুশি হয়েছিল। ভোটটা স্বস্তিতে দেওয়া যাবে ভেবেছিল। কিন্তু ইসি সিদ্ধান্ত পাল্টে ফেলল। এখন বলছে, সেনাবাহিনী সেনানিবাসেই থাকবে, ডাকলে আসবে। সেনাবাহিনী তো কারও বাড়িতে থাকে না, সেনানিবাসেই থাকে। এ আবার নতুন কী? এতে মানুষের কাছে কিন্তু ভালো বার্তা গেল না। সরকারের 'দলদাসরা' যাই বলুক, মানুষ বলছে, সেনাবাহিনী তিন দিন টহলে থাকলে দুর্বৃত্তরা শহর ছাড়বে, আর তাতে সরকারি প্রার্থীদের সর্বনাশের কথা ভেবেই ব্যবস্থাটি রাতারাতি পাল্টে দেওয়া হয়েছে। এসব কর্মকাণ্ড থেকে সিটি নির্বাচন স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। সংশয় জেগেছে জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়েও।
যে কোনো নির্বাচনে সব প্রার্থীর জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করার দায়িত্বই শুধু নয়, নির্বাচন কমিশনের এটা অবশ্য কর্তব্যও। বহুল আলোচিত তিন সিটি নির্বাচনে সমান সুযোগ সৃষ্টি তো দূরের কথা, তেমন একটি পরিবেশও তৈরি করতে পারেনি বর্তমান নির্বাচন কমিশন। ইসির বিতর্কিত ভূমিকা, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ওপর বার বার সশস্ত্র হামলা, কয়েকজন মন্ত্রী ও প্রার্থীর আচরণবিধি লঙ্ঘন, সরকারি দলের কোনো কোনো নেতার উসকানিমূলক বক্তব্য এবং সর্বশেষ সেনা মোতায়েন নিয়ে নির্বাচন কমিশনের নানা টালবাহানার কারণে রাজনৈতিক স্বস্তির এ নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ ও অগ্রহণযোগ্য হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। অনেকেই নির্বাচন কমিশনকে পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের জন্য অভিযুক্তও করছেন।
লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট
ই-মেইল :[email protected]