এবার কোথা থেকে শুরু করব বুঝতে পারছি না। আজ সিটি করপোরেশন নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে দীর্ঘ অবরোধ-হরতাল থেকে দৃষ্টি এড়াতে দেওয়া হয় এ নির্বাচন। এ নির্বাচন সম্পর্কে আমার কোনো আগ্রহ ছিল না। ভাতের বদলে ফেন দিয়ে কাজ চালানোর মতো, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো আর কী? সেবার গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ১৫ দিন আগে নারায়ণগঞ্জের এক সভায় আল্লাহকে হাজির নাজির জেনে বলেছিলাম, অবশ্যই গাজীপুরে সরকারি প্রার্থী লক্ষাধিক ভোটে হারবে। একসময়ের টঙ্গী পৌরসভার চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আজমত আলী আমার খুবই প্রিয় ভালো মানুষ। আওয়ামী লীগের না হয়ে স্বতন্ত্র দাঁড়ালেও কিছু বেশি ভোট পেত, জেতার সম্ভাবনাও ছিল প্রচুর। কারণ আবদুল মান্নানের চেয়ে দেখতে শুনতে, যোগ্যতা দক্ষতায় অ্যাডভোকেট আজমত আলী মোটেই পেছনের ছিল না। শুধু আওয়ামী লীগ করার কারণে সে যাত্রায় তাকে হারতে হয়েছে। ২৮ জানুয়ারি থেকে ২৮ এপ্রিল ৯২ দিন ঘরের বাইরে দেশের নানা পথে-প্রান্তরে ঘুরছি, নির্বাচনের তেমন পর্যবেক্ষণ করিনি। লোকজনের কাছ থেকে যা শুনেছি তা-ই একমাত্র ভরসা।
যাক ওসব কথা। আজ অথবা কাল হালুয়াঘাট থাকব। হালুয়াঘাটের কথা মনে হলেই '৭৫-এ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ প্রতিরোধের কথা মনে হয়। আমরা ৪০ জন ঈশ্বরগঞ্জ, ফুলপুর, তারাকান্দা হয়ে হালুয়াঘাট পৌঁছেছি। হালুয়াঘাট থানা পেরিয়ে উত্তরে গেলে নির্বোধের মতো কিছু পুলিশ আমাদের পিছু নেয়। তারা বুঝতে না পেরে প্রতিরোধ সংগ্রামীদেরই জিজ্ঞাসা করে, যারা গেল তারা কারা? এক পুলিশ এলএমজি বসিয়ে গুলি চালাতে যায়। আরিফ আহমেদ দুলাল পুলিশের এলএমজির ব্যারেল ধরে টান দিলে ব্যারেল ছুটে বেরিয়ে আসে। প্রতিরোধ সংগ্রামীরা গুলি চালালে পুলিশরা থানা ছেড়ে পালিয়ে যায়। ওসি পায়খানায় পালায়। হালুয়াঘাট থেকে দুই-আড়াই মাইল উত্তরে গোবরাকুড়া সীমান্ত পিলারের পাশে প্রবোধ দিওয়ের বাড়ি। অনেক রাতে সেখানে অনেক চেষ্টা করে এক কেজি চালের ভাত সবাই ভাগ করে খাই। হালুয়াঘাটে এসে সেসব কথা জীবন পর্দায় ছায়াছবির মতো একের পর এক ভেসে উঠছে।
জীবনে এই প্রথম ময়মনসিংহ টাউন হল মাঠে তাঁবু খাটিয়ে রাত কাটিয়েছি। ময়মনসিংহের ছাত্র-যুবক, সাধারণ মানুষের অভাবনীয় সহযোগিতায় হৃদয় ভরে গেছে। শহরে আসার আগে সৌজন্য হিসেবে ময়মনসিংহের মন্ত্রী প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানকে ফোন করেছিলাম। তিনি অসাধারণ সৌজন্যের পরিচয় দিয়েছেন। বার বার আমার স্ত্রীকে তার সালাম পৌঁছে দিতে বলেছেন। আমি অভিভূত হয়েছি। প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান আজীবন সংগ্রামী, জনগণের একজন কাছের মানুষ। বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ময়মনসিংহ পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকা সত্ত্বেও তিনি যে কী সরকারি নির্যাতন ভোগ করেছেন তা বলার মতো নয়। মুক্তিযুদ্ধে এ অঞ্চলে রাজনৈতিক নেতা হিসেবে রফিক উদ্দিন ভূঁইয়ার অবদান তুলনাহীন, সবার ওপরে। তারপর কেউ যদি প্রত্যক্ষভাবে শিবিরে বাস করে থাকেন তিনি প্রিন্সিপাল মতিউর রহমান। তুরার ঢালু ইয়ুথ ক্যাম্পে সব থেকে বেশি যুবকদের দেখাশোনা, রক্ষণাবেক্ষণ ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে ভূমিকা রেখেছেন। আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ গঠনের পরও যতবার ময়মনসিংহ এসেছি প্রিন্সিপাল মতিউর রহমানের সঙ্গে দেখা হয়েছে। তার সৌজন্যের তুলনা হয় না। এখন তিনি মন্ত্রী, মন্ত্রী হিসেবে তাকে নিয়ে যত আলোচনা হোক আমার ব্যাপারে তার আচরণের কোনো তফাত হয়নি। সড়ক দুর্ঘটনায় তার ছেলে মারা গেলে শুধু একজন আহত পিতাকে সান্ত্বনা দিতে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ গিয়েছিলাম।
দাপুনিয়া কলেজ মাঠে রাত কাটিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম বেগ ও মাহবুব ইসলাম বেগের সঙ্গে কথা বলে বেগুনবাড়ী গিয়েছিলাম। বেগুনবাড়ী উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা, ছাত্রছাত্রীদের ভীষণ ভালো লেগেছে। তার আগে দাপুনিয়া ডি কে জি এস ইউনাইটেড কলেজের শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী এবং অধ্যক্ষ মাকসুদুল হাসান আরিফকেও ভালো লেগেছে। তাদের সৌজন্য ও আতিথেয়তা অবস্থান কর্মসূচিতে এক নতুন মাত্রা জুগিয়েছে। ক্লাস থ্রির ছাত্র ছোট্ট বাচ্চা রোমান বার বার খাবার এনেছে। কী যে ভালো লেগেছে বলে বোঝানো যাবে না। দাপুনিয়ার আগে দুপুরের খাবার খেয়েছিলাম চুরখাইয়ে। চুরখাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এ কে এম. আবদুল হাই চেয়ারম্যানের ছেলে হাসিম বাড়ি থেকে খাবার এনেছিল। পরম তৃপ্তিতে সে খাবার খেয়েছিলাম। তার আগে সাড়ে তিন মিনিটের ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি প্রত্যক্ষ করেছি। ডোবার পানি এপাশ ওপাশ দুলছিল, মাথা ঘুরছিল। রিখটার স্কেলের ৭.৫ মাত্রার ভূমিকম্প সচরাচর খুব একটা হয় না। উৎপত্তিস্থল নেপালে কয়েক হাজার লোক মারা গেছে। আমাদের তেমন জানমালের ক্ষতি না হলেও পরদিন আবার ভূমিকম্প হয়েছে। জানি না এ কিসের আলামত। যাত্রা শুরু করেছিলাম আছিম থেকে ফুলবাড়িয়া, ফুলবাড়িয়া থেকে ত্রিশাল। আছিমে যেমন ঝড়-তুফানে আক্রান্ত হয়েছিলাম, ফুলবাড়িয়ায়ও সেই একইরকম। তাঁবুর নানা জায়গা দিয়ে পানি ঝরে বিছানাপত্র ভিজে যায়। সে যে কী লেজে-গোবরে অবস্থা, ভাবা যায় না। তার পরও মানুষের ভালোবাসায় কোনো কষ্টই কষ্ট মনে হয় না। ২২ তারিখ সকাল ৭টায় বাবার সঙ্গে ছোট্ট মেয়ে প্রেরণা এসেছিল। তারপর আবার বিকালে। পরদিন সকাল ৭টায় বাপ-বেটি নাস্তা নিয়ে হাজির। ওইদিন ত্রিশালে যাওয়ার কথা ছিল। আমাদের একটু দেরি হচ্ছিল। দেখলাম দুপুরের খাবার নিয়ে এসেছে। খাবার শেষে একেবারে কাছঘেঁষে সে যে কী দরদ দিয়ে বলেছিল, 'দাদু, সাবধানে থাকবে। বৃষ্টিতে ভিজবে না, শরীর খারাপ হবে। তোমার জন্য খুব মায়া হয়।' মনে হচ্ছিল এ যেন আমার মা-ই আমাকে সাবধান করছে। ফুলবাড়িয়ার সবুজ, বেলাল, প্রশান্ত, দেলোয়ার অসাধারণ সহযোগিতা করেছে। সেখান থেকে তাঁবু ফেলেছিলাম ত্রিশালের দরিরামপুর কবি কাজী নজরুল ইসলাম একাডেমি মাঠে দরিরামপুর প্রাইমারি স্কুলের সামনে। গিয়েই শুনি জায়গাটা নাকি আওয়ামী লীগের ঘাঁটি। ত্রিশালের প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা রজব আলী সেখানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির। একটু পরই এসেছিলেন নবী নেওয়াজ সরকার। ত্রিশালের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের নেতা। বাঁশের চেয়ে কঞ্চি শক্ত, সেটা সেখানেই ভালোভাবে বুঝলাম। বৃষ্টি-বাদলের দিন, তাই একটি ঘরের চাবি চেয়েছিলাম, প্রাইমারি স্কুলের হেড মিস্ট্রেজ চাবি দেননি। তার ছেলে অ্যাডভোকেট সবুজ আওয়ামী লীগ করে। সেজন্য মুক্তিযুদ্ধের সরকারের আমলে কোনো মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় পাবে না- ভাবতেই যেন কেমন লাগে। অথচ টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছিলাম। যাওয়ার আগে কর্নেল ফারুক খানের নির্বাচনী এলাকা কাশিয়ানীর হোগলাকান্দি প্রাইমারি স্কুলের ছোট্ট মাঠে ছিলাম। তাদের সহযোগিতায় স্তম্ভিত হয়েছি। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর মাজারে, বাড়িতে, বৈকুণ্ঠ, নির্মল, আতিয়ার, আক্কাস, আলভী সবাই অভাবনীয় যত্ন করেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ড্রইংরুম, খাবার ঘর আমাদের লোকজন ব্যবহার করেছে। আমি ফজরের নামাজের সময় নিচ তলার বাথরুম ব্যবহার করেছি। কোথাও কোনো বাধা হয়নি। যত বাধা ত্রিশালের দরিরামপুরে। শুধু মানুষের সৃষ্ট বাধা নয়, প্রকৃতিও বাধা হয়েছে। এমন ঝড়-তুফান, ব্যক্তিগত সচিব ফরিদ আহমেদ এবং কম্পিউটার অপারেটর মো. আলমগীর হোসেনের বিছানা চার-পাঁচ ইঞ্চি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। যা হোক, ত্রিশালের গুটিকয় মানুষের অসহযোগিতা আপামর জনসাধারণ ও ছাত্রছাত্রীদের অভাবনীয় সহযোগিতাকে ম্লান করতে পারেনি। ত্রিশাল থেকে চুরখাইয়ে এলে শত শত মানুষ পঙ্গপালের মতো ছুটে আসতে দেখে হৃদয় মন ভরে গিয়েছিল।
সেখান থেকে দাপুনিয়ায় সর্বসাধারণের সাড়া দেখে আরও অভিভূত হয়েছি। তারপর বেগুনবাড়ী। সেই ছোটবেলা থেকে দেখতাম, আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে কত মানুষ যেত। কোথায় যাচ্ছেন জিজ্ঞাসা করলে খুব দাপটে বলতেন, বেগুনবাড়ী। সাত-আট দিন পর ফেরার পথে শোনা যেত, 'আর বলবেন না, মরবার গেছিলাম। হায়রে মানুষ, নোকরে নোকে খায়।' সেই বেগুনবাড়ী আনন্দমোহন কলেজের ছাত্র শাহীনুর আলমের কল্যাণে ঘুরে এলাম। ময়মনসিংহ টাউন হল মাঠে তাঁবুতে বসে যখন লিখছি তখন '৬৯-এর কথা বড় বেশি করে মনে পড়ছে। আইয়ুব খানের পতনের আগে ময়মনসিংহ জেলে ছিলাম। আড়াই-তিন বছর আগে থেকে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন। ময়মনসিংহ ছাত্রলীগের নেতা নজরুল ইসলামের ভাগ্নে আনোয়ার, ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মুক্তাগাছার শহিদুল্লাহ খন্দকার, নেত্রকোনার অজয় রায়, কিশোরগঞ্জের নগেন সরকার, অষ্টগ্রামের ন্যাপ নেতা আবদুল বারী- আরও অনেকেই ছিলেন। ১৬ বা ১৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তিতে আমরা জেল থেকে ছাড়া পাই। ২২ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু আগরতলা মামলা থেকে মুক্ত হয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে ছাড়া পান। বঙ্গবন্ধু ছাড়া পেলেও ময়মনসিংহ জেল থেকে বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী ও অন্যরা তখনো ছাড়া পাননি। শুনেছিলাম, সন্ধ্যার পর রাজবন্দীদের মুক্তির আদেশ গেলে তারা কেউ জেল থেকে বেরোতে রাজি হননি। তাই জেল কর্তৃপক্ষ নিরুপায় হয়ে পরদিন ২৩ ফেব্রুয়ারি তাদের মুক্তি দেয়। আমরা টাঙ্গাইল থেকে একদল ছাত্র-যুবক এসেছিলাম সদ্য কারামুক্ত আমাদের নেতা লতিফ সিদ্দিকীকে নিতে। এই টাউন হল ময়দানেই ২৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৯ এক অসাধারণ ঐতিহাসিক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়েছিল। বিপুল লোকসমাগম হয়েছিল। কমিউনিস্ট নেতারা জেল খাটতে পারলেও উত্তাল জনতার সামনে আকাশফাটা মাঠ কাঁপানো বক্তৃতা করতে পারতেন না। মুক্তাগাছার খন্দকার শহিদুল্লাহ এবং টাঙ্গাইলের লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন বক্তৃতার জাদুকর। বিশেষ করে লতিফ সিদ্দিকী তার বক্তৃতায় আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলতে পারতেন। এখন টাউন হলের পুব-দক্ষিণে ফুলপুরের জননেতা শামসুল হকের এক প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছে। এই প্রথম দেখলাম একজন জেলা পর্যায়ের নেতার এ ধরনের বিরল সম্মান। যদিও তার প্রস্তরফলকে জীবনীর অনেকটাই ঘাসের নিচে তলিয়ে গেছে। ফুলপুরের শামসুল হক এক বিরল চরিত্রের নেতা। তিনি একবার এক সভায় ৩০ লাখ শহীদের স্থলে ৩০ কোটি বলে ফেলেছিলেন। সভার উদ্যোক্তারা ভুল ধরে দিতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, 'যা বলেছি বলেছিই। একজনও কমাইবাম না।' মানে ৩০ কোটিই সই। সারা জীবন বড় কষ্ট করেছেন। '৯৭ অথবা '৯৮ সালে সংসদ সদস্যদের কোটা থেকে একটি ট্যাক্স-ফ্রি রিকন্ডিশন কার নিয়েছিলেন। আমি একবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক সভায় যাওয়ার পথে জোর করেই গাড়ি দিয়েছিলেন। পরদিন বাসায় এসেছিলেন। কথার ছলে বলেছিলেন, 'লিডার, ছেঁড়া জুতা আর পুরান গাড়ি এক সমান।' আমিও জীবনে বার বার তা উপলব্ধি করেছি।
ফুলবাড়িয়া জেলা পরিষদের ডাকবাংলো মাঠে যেদিন ছিলাম সেদিন হঠাৎই জার্মানি থেকে লাবলু ফোন করেছিল। নির্বাসিত জীবনে জার্মানিতে প্রবাসী অনিল দাশগুপ্ত, আবদুল মতিন, আনোয়ারুল কবির, লাবলু, আলমগীর ভূইয়া, সুইডেনের কাদের, প্রদীপ আরও অনেকে দারুণ সাহায্য করেছে। লাবলু কোনো দুর্ঘটনায় বিকলাঙ্গ হয়েছিল সে অবস্থাতেই আমার দেশে ফেরা নিয়ে ইউরোপের নানা প্রান্তে যেভাবে ছুটে বেরিয়েছে সে এক বিস্ময়কর ব্যাপার। সেই লাবলুর মামাতো ভাই যুবলীগ নেতা চঞ্চল হঠাৎই আত্দহত্যা করেছে। খবরটা আমাকে চমকে দিয়েছে। কবির মামার ছেলে চঞ্চল আমার খুবই প্রিয়। এত কিছুর পরও কতবার যে সে এসেছে তার হিসাব নেই। ভারতে নির্বাসিত থাকতে লাবলুর কারণে কবির মামা সব সময় যোগাযোগ করতেন। তিনি গিটার বাজাতে ভালোবাসেন। স্বাধীন বাংলা বেতারের অনেক গান গিটারে তুলেছেন। তার স্বরলিপি ছাপার জন্য অনেক চেষ্টা করেও সফল হতে পারেননি। দু-চার বার আমার সাহায্য চেয়েছেন, আমিও সাহায্য করতে চেষ্টা করেছি। সেই মামার উপযুক্ত ছেলে বিষণ্নতায় ভুগে অকালে চলে গেল। ছেলেটির মধ্যে হতাশা ছিল জানতাম। আওয়ামী রাজনীতি নিয়ে কিছুই ভাবি না। তার পরও আপনজনের হতাশায় কষ্ট হয়। নাম না জানা অনেকেই নেতা হয়ে যাওয়ায় ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিল। এত অল্প বয়সে ছয়-সাত তলা দালান বাড়ি থাকতে, ছেলেমেয়ে থাকতে আওয়ামী ঘরানার নেতা-কর্মীরা যদি আত্দহত্যা করে তাহলে দিনের পর দিন বঞ্চনার শিকার হয়ে আমার তো ৭০ বার মৃত্যুবরণ করা উচিত। এই সফরে গত ২৩ তারিখ আওয়ামী ঘরানার নবী নেওয়াজ সরকারের যোগ্যতা দেখলাম। অ্যাডভোকেট সবুজের যে অসৌজন্য দেখেছি তা তো ভোলার নয়। সবুজের মা দরিরামপুর প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। রুম খুলে দেয়নি সে ভিন্ন কথা, পায়খানাও খোলেনি। যেখানে ছিলাম সেখান থেকে দেড়-দুইশ গজ দূরে একসময় উপজেলা চেয়ারম্যান, তারপর এমপি মতিনের বাড়ি। একবারের জন্যও খোঁজ নেয়নি। বরং অসহযোগিতায় ইন্ধন জুগিয়েছে। অথচ চুরখাই, দাপুনিয়া, বেগুনবাড়ী এবং সর্বশেষ ময়মনসিংহ টাউন হল মাঠে তাঁবু ফেলে যে অভাবনীয় সৌজন্য পেয়েছি তাতে মনপ্রাণ ভরে গেছে। আমরা টাউন হলে পৌঁছতেই পিয়ন ছুটে এসে সালাম দিয়ে বলেছিল, 'আমি পৌরসভার কর্মচারী। আপনার যা কিছু দরকার সাধ্যমতো সব পাবেন। হলের বাথরুম খুলে রেখেছি, যেখান থেকে খুশি বিদ্যুৎ নিতে পারবেন।' একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ভদ্রলোকের কথা শুনে বুক জুড়িয়ে গিয়েছিল। সত্যিই ভালো-মন্দ নিয়ে যে সমাজ তা পথে পথে পদে পদে চলতে ফিরতে দেখতে পাচ্ছি। শান্তির অন্বেষণে যা করা দরকার আমরা তা করতে প্রস্তুত। তবু কেন যেন বার বার ত্রিশালের কবি কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত এখনো টিকে থাকা স্কুলঘরের প্রতি অবহেলার কথা মন থেকে মুছে ফেলতে পারছি না। ষষ্ঠ শ্রেণির অচেনা ছেলে নিবিড় ছুটে খাবার নিয়ে আসতে পারল, জিহাদ, মাজহার, আছিমের ভুট্টো, সোয়াইতপুরের কামরুল, বারেক সরকার, চান মিয়া, দাপুনিয়ার ডা. রফিক, চুরখাইয়ের ইদ্রিস মেম্বার তারা এদিক ওদিক ছোটাছুটি করে কত সহযোগিতা করল। ওহাব মিয়া বাড়িতে রান্না করে খাবার খাওয়ালো। অথচ বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রতিবাদ না করলে যে আওয়ামী লীগ নেতারা শ্মশানে অথবা কবরস্থানে থাকত তারা অনেকেই সামান্য সৌজন্যের পরিচয় দিতেও কুণ্ঠাবোধ করল। সত্যি এটাই জীবন। এই বাস্তবতাকে অতিক্রম করার ক্ষমতা কারও নেই।
কেন যেন দুই দিনে দুবার ভূমিকম্প হওয়ার পর দীপ-কুঁড়ি-কুশির কথা, ওদের মায়ের কথা বার বার মনে পড়ছে, কেন যেন দেখতে বড় বেশি ইচ্ছা করছে। দিনে দু-তিন বার কুশিমণির সঙ্গে কথা বলেও মন শান্ত হচ্ছে না। কী করে যে কুশির মধ্যে আমার প্রাণ লুকিয়ে আছে। অনেকে অনেক সময় আমাকে বইপুস্তকসহ অনেক উপহার দেয়।
গতকালই প্রথম আলোর মিছিলের সংগঠক আনিসুর রহমান সোহাগ কুশিমণিকে পবিত্র কোরআন উপহার দিয়েছে। আট বছরের মেয়ে ওর তো কোরআন পড়ার বয়স হয়নি। আল্লাহর দয়ায় বেঁচে থাকলে নিশ্চয় বড় হয়ে পড়বে।
লেখক : রাজনীতিক