দেখতে দেখতে মাহে রমজানের মাঝামাঝি এসে গেলাম। গত পর্বে লেখা হয়নি। রোজা রেখে লিখতে বসেছিলাম। অনেক চেষ্টা করেও কেন যেন কিছুই লিখতে পারিনি। এমন যে হয় এর আগে কখনো বুঝিনি। দুই-তিনবার চেষ্টা করেও কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। বহু বছর আগে এক জুমার নামাজের খুতবায় কিয়ামতের আলামত সম্পর্কে এক মাওলানা বলেছিলেন, আমরা নামাজ পড়তে সুরা ভুলে যাব। কোনোক্রমেই মনে করতে পারব না। কেন যেন আমার অনেকটা তেমনই মনে হচ্ছিল। নয়া দিগন্তে লেখা হয়নি, বাংলাদেশ প্রতিদিনেও না। কত পাঠক কত ফোন করেছে, কী হলো মঙ্গলবারের লেখা কেন পেলাম না? নিজেও ভেবেছি কী হলো, চেষ্টা করে লিখতে কেন পারলাম না। সারা সপ্তাহ এর উত্তর খুঁজে পাইনি।
রোজার মাস একেবারে নীরবে থাকতে চেয়েছিলাম। গত সাড়ে চার মাস তাঁবু খাটিয়ে বাইরে থেকেছি। ঝড়-বৃষ্টি-তুফান কোনো কিছুকেই আমলে নেইনি। রমজানের শুরু থেকে লোকজনের ঘরে রাত কাটাই। নানা জায়গায় নানা পরিবেশ। এমনিতে কোনো অসুবিধা না হলেও সেহরিতে কমবেশি অসুবিধা হয়। এই তো সেদিন ছলঙ্গার ওমর আলীর বাড়িতে রাত ৩টায় উঠে শুনি বাড়ির মেয়েরা সবকিছু তৈরি করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কেবল ভাত চড়িয়েছে। মেয়েদের আফসোসের শেষ নেই, কী হবে? ৩টায় ভাত চড়িয়ে ভাত নামাতে ৩০-৩৫ মিনিট তো লাগবেই। এখন উপায়! আমি নিজেও চিন্তায় পড়েছিলাম। কাকে যেন বলেছিলাম, তরি-তরকারি যা আছে নিয়ে এসো, কোনোখান থেকে মুড়ি আনো। এমন তো হতেই পারে। তাই বলে তো রোজা নষ্ট করা যাবে না? কয়েক ভাইয়ের হাটিবাড়ি। এসব দেখে এক বউ এক ডিশ ভাত নিয়ে এলো। রাতে ওমরের বাড়ির সবকিছু ভালো থাকলেও ভাত একটু শক্ত ছিল। আমি শক্ত ভাত খেতে পারি না। সেহরিতে রাঁধতে দেরি হওয়ায় আমার ভালোই হয়েছিল। যে বউ ভাত এনেছিল তার ভাত খুবই চমৎকার ছিল।
যাদবপুর ইউনিয়নের কালমেঘা এক অসাধারণ সুন্দর জায়গা। মুক্তিযুদ্ধের সূচনায় পিলখানার একদল পালিয়ে আসা ইপিআর কালমেঘার ইলিমজান উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের খোঁজে বড়চওনার আজিজকে নিয়ে কালমেঘায় গিয়েছিলাম। সেখানেই প্রথম কিতাব আলীর সঙ্গে দেখা। তারপর কত দিন, কত বছর কেটেছে। এক সময় কিতাব আলী আমার ছায়ার মতো কাজ করেছে। এখন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। বারবার বিয়ে করে বলে নাকি কিতাব আলীর ছেলে সেলিম, কায়সার বাপকে মেরেছে শুনে যারপরনাই মর্মাহত হয়েছি। দেশে আল্লাহর গজব আর কী করে পড়বে? জন্মদাতার গায়ে সন্তানের হাত সুস্থভাবে এও আশা করা যায়? কালমেঘার মানুষের দুর্দান্ত সংগ্রামী ভূমিকা আমাকে প্রতি মুহূর্তে আলোড়িত ও উৎসাহিত করে। '৯৯-এর উপনির্বাচনে আওয়ামী সরকারের ভোট ডাকাতির প্রতিবাদে কালমেঘার প্রায় ৬-৭ হাজার মানুষ গজারির লাঠি হাতে সখীপুর এসেছিল।
কালমেঘার বিক্ষুব্ধ জনতার লাঠি হাতে সখীপুরে আসা দেখে পুলিশ থানা ছেড়ে পালিয়েছিল। ওসি পায়খানায় আশ্রয় নিয়েছিল। আমি শান্ত হতে বললে সেদিন তারা আমার কথা শুনে কোনো অঘটন না ঘটিয়ে ঘরে ফিরেছিল। সে জন্য কালমেঘার সংগ্রামী জনতার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার শেষ নেই। মজার ব্যাপার কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের গোড়াপত্তনও কালমেঘা থেকেই হয়। কালমেঘার যুবনেতা শাহীন ছলঙ্গার হতদরিদ্র সোবহানের ভাঙা মাটির ঘরে খাবার ব্যবস্থা করেছিল। সোবহানের বাড়িতে খাবার খেয়ে ছলঙ্গা বাজারে এলে মুষলধারায় বৃষ্টি শুরু হয়। পাহাড়ের রাস্তায় হাজারের ওপরে মানুষ। আমরা চলেছি পাথারের দিকে। পায়ে হেঁটে, কখনো গাড়িতে করে। রাস্তার কাদায় লুটোপুটি খাওয়া ছোট বাচ্চাদের চেনা যাচ্ছিল না। জয় বাংলা বাজারের কাছে ছোট্ট এক বাচ্চা এমন এক কাদার গর্তে পড়েছিল সে যে মানুষ, না অন্যকিছু বোঝা যাচ্ছিল না। আবদুল্লাহ বীরপ্রতীক বাচ্চাটির হাত ধরে পুকুরে চুবালে তবে বোঝা যায় সে এক মানব সন্তান। সে এক অভাবনীয় সংগ্রামী দিন। তাই সেদিন ইফতার শেষে ছলঙ্গার ওমর আলীর বাড়ি ছিলাম। ওমর আলীর ছেলে শহর আলী ভীষণ খেটেছে। রাতের বেলায় ছামান ও অন্যরা বারান্দায় পড়েছিল।
তার আগের রাতে ছিলাম কামালিয়া চালা মাদ্রাসার পাশে জিন্নার বাড়ি। টিনের ঘর তবু বেশ সুন্দর পরিবেশ। আদরযত্ন, খাবার-দাবার ছিল অসাধারণ। আর এই কামালিয়া চালা আমার জীবনের এক বিস্ময়কর স্মরণীয় জায়গা। মুক্তিযুদ্ধের সময় হঠাৎই একবার পাথরঘাটা ঘাঁটির পতন ঘটে। পাথরঘাটা রতনপুর জসিমের হাটখোলার মাঝামাঝি কামালিয়া চালার অবস্থান। ঘাঁটি উদ্ধার করতে পাথরঘাটা গিয়েছিলাম। সেই প্রথম কামালিয়া চালা দেখি। পশ্চিমের দিকে প্রায় পুরোটাই হিন্দুদের বসত, পুবে কিছুটা মুসলমান। স্বাধীনতার পর থেকে বহুবার কামালিয়া চালা যাতায়াত করেছি, এখনো করি। কামালিয়া চালার দরিদ্র নরেশ ছিল আমাদের দলের হাতিবান্ধা ইউনিয়নের সভাপতি। কিছুদিন হলো আওয়ামী লীগ হয়েছে। আওয়ামী লীগ আরও আছে কিন্তু তার মতো দুষ্টামি কেউ করে না। আমি আগে জানতাম না, মাদ্রাসায় হিন্দু শিক্ষক থাকতে পারে। কামালিয়া চালায়ই প্রথম দেখেছিলাম নরেশ মাদ্রাসা শিক্ষক। সে জন্য কামালিয়া চালা মাদ্রাসার প্রতি আমার একটা বিশেষ টান ছিল। আমি জেলে থাকতে সখীপুরের সংসদ সদস্য হয়েছিলেন হুমায়ুন খান পন্নী। তাকে কামালিয়া চালার জরাজীর্ণ মাদ্রাসায় নিতে সবাই মিলে ১২ হাজার টাকা খরচ করেছিলেন। মাদ্রাসায় গিয়ে জনাব হুমায়ুন খান পন্নী ২০ হাজার টাকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সে টাকা তুলতে আবার আরও ৮ হাজার টাকা খরচ হয়েছিল। আমাদের দলের নেতা নরেশ এবং কামালিয়া চালার মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট করিম মাওলানার কাছে ঘটনাটি শুনেছিলাম। তাই এলাকার সংসদ সদস্য হিসেবে মাদ্রাসা ঘরের জন্য আবেদন ছাড়াই এক লাখ টাকা মঞ্জুর করেছিলাম। মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট করিম মাওলানা মঞ্জুরিপত্র পেয়ে দিশাহারা। এর আগে ওই মাদ্রাসা সরকারি হাজার টাকাও পায়নি। তাই সুপারিনটেনডেন্টের ভিরমি খাবার অবস্থা। এরপর হঠাৎ একদিন আমার সঙ্গে দেখা। তিনি প্রায় উন্মাদের মতো আচরণ করেন। বারে বারে খেদোক্তি করেন, ১২ হাজার টাকা খরচ করে ডিপুটি স্পিকার হুমায়ুন খান পন্নীকে নিয়েছিলাম। তিনি দিয়েছিলেন ২০ হাজার। তা আবার তুলতে গিয়ে খরচ হয়েছিল ৮ হাজার। এক পয়সাও বাড়তি হয়নি। যে দামে কেনা সেই দামেই বেচার মতো। আপনাকে একদিনের জন্য কিছু করলাম না, কোনো দরখাস্ত দিলাম না, লাখ টাকা বরাদ্দ- এ কী করে সম্ভব? তিনি খুবই অবাক হয়েছিলেন।
তখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে আমার বিরোধ চলছে। কারণ '৯৬-এর নির্বাচনে আমরা বলেছিলাম, পাঁচ লাখ চাকরি দেব, পাটের দাম দেব, বিনামূল্যে সার দেব, আটিয়া বন অধ্যাদেশ প্রত্যাহার করব। প্রায় তিন বছর এর কোনো কিছুই যখন হচ্ছিল না, তখন জননেত্রীকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, প্রায় তিন বছর চলে যাচ্ছে আমাদের প্রতিশ্রুতির কোনো কিছুই তো হলো না। আমাদের কথা রক্ষা করতে না পারলে জনগণ তো মুখ ফিরিয়ে নেবে। নেত্রী বলেছিলেন, কোনো চিন্তা করবেন না। আবার নির্বাচনের সময় দেখবেন মানুষ ঠিকই ভোট দেবে। আমার বিশ্বাস নেত্রীর মতো ছিল না। আমার বিশ্বাস ছিল প্রতিশ্রুতি রাখতে না পারলে জনগণ মুখ ফিরিয়ে নেবে। একপর্যায়ে আমি আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করি। ঘোষণা হয় উপ-নির্বাচনের। '৯৯-এর সেই উপ-নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশগ্রহণ করি। সেই সময় বর্ষায় কামালিয়া চালা গিয়েছিলাম। মাঠের পাশে বটগাছের গোড়া পর্যন্ত স্পিডবোটে গিয়েছিলাম। করিম মাওলানা আর আলহাজ ফয়েজউদ্দিন স্পিডবোট থেকে প্রায় উঁচু করে ডাঙ্গায় তুলেছিলেন। নির্বাচন করব মার্কা নিয়ে সমস্যা। ফয়েজ উদ্দিন হাজী এবং করিম মাওলানা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, স্যার, মার্কা নিয়ে চিন্তা করবেন না। কোনো কিছু যদি না হয়, আপনার এই যে গামছা কাঁধে দরকার হলে আমরা এই গামছাই মার্কা বানাব। কামালিয়া চালার মিটিং থেকেই আমার ভিতর গামছা যে মার্কা হতে পারে তেমন একটা ভাবনা কাজ করছিল। সে নির্বাচনে আমাকে গামছা দেওয়া হয়নি। মার্কা দেওয়া হয়েছিল পিঁড়ি। গণতান্ত্রিক সব নিয়ম-কানুন লঙ্ঘন করে তখনকার আওয়ামী ২৮ মন্ত্রীর মধ্যে ২৫ জন এসেছিলেন সখীপুর-বাসাইল উপ-নির্বাচনে। মন্ত্রীরা কত জায়গায় ঘুরতেন, ১০ জন মানুষও হতো না। আওয়ামী লীগের বড় বড় নেতারা চায়ের দোকানে চা চাইলে দোকানি তাদের কাছে চা বেচতে চাইত না। সেটা ছিল নির্বাচনের নামে এক প্রহসন। তারপর আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ব্যাপক ভরাডুবি হয়। তাদের সিট নেমে আসে ৫০-এর কোঠায়। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিএনপি সরকার গঠন করে। বেশি সমর্থন পেলে সরকার ভালো চলে না। বিএনপি সরকার তার এক উজ্জ্বল প্রমাণ। তখন প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় বেশ কিছু স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার পাকা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। না চাইতেই কামালিয়া চালা মাদ্রাসার তালিকা দিয়েছিলাম। লোকজন কামালিয়া চালা মাদ্রাসার ভবন নির্মাণের জায়গা মাপজোখ করতে গেলে পাকা ভবন হবে শুনে সুপারিনটেনডেন্টসহ সবাই বেহুঁশ। কোনো তয়-তদবির নেই, বলা নেই, কওয়া নেই মাদ্রাসায় পাকা ভবন- এ কী করে সম্ভব? আসলে সবই সম্ভব।
কোনো তয়-তদবির করতে হবে কেন? কেন কারও কাছে গিয়ে হাত কচলাতে হবে? জনপ্রতিনিধিদের কাজ চোখে দেখে এলাকার উন্নয়ন। ইদানীং কারও দায়বদ্ধতা নেই। তাই সবকিছু কেমন যেন হয়ে গেছে। অবস্থান কর্মসূচির ১৫০তম দিনে কামালিয়া চালা এবং ১৫২তম দিনে ছলঙ্গায় রাত কাটাতে গিয়ে পুরনো দিনের কত কথা মনে পড়ছে।
লেখক : রাজনীতিক