বায়ান্নের ভাষাসংগ্রামী ও বাংলাদেশের প্রথম নারী জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ (১৯৩২-২০২০) এর আজ ৯ এপ্রিল প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী। গত এক বছরে করোনার অতিমারি আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে জাতির বেশ কিছু শ্রেষ্ঠ সন্তান। জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদের মৃত্যু করোনায় না হলেও তিনি অতিমারির কঠিন সময়ে অনেকটা নীরবেই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। সময়ের হিসেবে বছর চলে গেল। আমরা হারালাম আমাদের একজন উদার ও অনুপ্রেরণাদায়ী অভিভাবক।
জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ-এর পৈত্রিক নিবাস ফরিদপুর। তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। শিক্ষা জীবনের সর্বক্ষেত্রে মেধার অসামান্য স্বাক্ষর রেখেছেন। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্রী থাকাকালে ভাষা আন্দোলনের সাথে যুক্ত হন। ভাষা আন্দোলনকে সফল করার লক্ষ্যে মিছিল-মিটিংয়ে অংশগ্রহণ, বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে আন্দোলনের পক্ষে প্রচারণা চালানো এবং আন্দোলনের জন্য অর্থ সংগ্রহের কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার মিছিলে নেতৃত্ব প্রদানকারীদের অন্যতম ছিলেন তিনি। মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণকে তিনি তার জীবনের এক উজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবে বিবেচনা করতেন।
লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব অরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজ থেকে ১৯৬০ সালে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জন করে পরের বছর ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি ছিলেন একজন বিদগ্ধ পন্ডিত ও গবেষক। শিক্ষকতা করেছেন তুরস্কের বসফোরাস বিশ্ববিদ্যালয়, ফুলব্রাইট ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলভার্নো কলেজে। তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র ছিল, ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলমানদের ইতিহাস; উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর আধুনিক তুরস্কের ইতিহাস এবং বাংলাদেশ ও তুরস্কের নারী উন্নয়ন। এ সকল বিষয়ে তিনি প্রচুর গবেষণামূলক প্রবন্ধ লিখেছেন এবং দেশ বিদেশের নামকরা জার্নালে তা প্রকাশিত হয়েছে। তার মুসলিম কমিউনিটি ইন বেঙ্গল গ্রন্থটি দেশ-বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে রেফারেন্স গ্রন্থ হিসেবে বহুল আলোচিত।
১৯৫২ সালে পাকিস্তান সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি দলের সদস্য হিসেবে তুরস্ক সফর করেন। এছাড়া জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন ১৯৬৯ ও ১৯৭৯ সালে। ১৯৮৩ সালে ইউনেস্কো অধিবেশনেও তিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি সমাজসেবক ও নারী সংগঠক হিসেবেও সক্রিয় ছিলেন। জাতীয় মহিলা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, গার্ল গাইডের ইন্টারন্যাশনাল কমিশনারসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। বাংলা ভাষায় ইতিহাস চর্চার পথিকৃত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইতিহাস পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এবং এ সংগঠনের আটবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও বলিষ্ঠ নেতৃত্বে এ সংগঠন বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চা ও ইতিহাস সংরক্ষণের প্রধানতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে আজ প্রতিষ্ঠিত।
জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ এর পিতা বিচারপতি মুহাম্মদ ইব্রাহিম ছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি, ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের উপাচার্য ও পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী। তাঁর চলার পথে পিতা ছিলেন তাঁর অন্যতম আদর্শ। জাস্টিস মুহাম্মদ ইব্রাহিম (১৮৯৮-১৯৬৬): মেমোরিয়াল ভলিউম এবং ডাইরিজ অব জাস্টিস মুহাম্মদ ইব্রাহিম (১৯৬০-৬৬) গ্রন্থ দু’টো সম্পাদনা ও সংকলন করে সুফিয়া আহমেদ আমাদের ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায় জাতির সামনে উন্মোচন করেছেন। পাকিস্তানের আইনমন্ত্রী থাকাকালে তাঁর পিতা সামরিক শাসক আইয়ুব খানের সাথে পূর্ব বাংলার স্বার্থ রক্ষায় বিভিন্ন বিষয়ে দ্বিমত প্রকাশ করতেন এবং নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও তাঁর মতামত ব্যক্তিগত ডাইরিতে লিখে রাখতেন। এ ডাইরিতে ইতিহাস সচেতন পাঠকগণ দুই পাকিস্তানের বৈষম্যের চিত্র ও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানীদের মানসিকতা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার নিরিখে দেখতে পান।
ড. সুফিয়া আহমেদ শিক্ষা ও গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৯৬ সালে বাংলাদেশের প্রথম মহিলা জাতীয় অধ্যাপক রূপে বরিত হন। এছাড়া ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ এবং বাংলাদেশের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০২ সালে ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন।
ড. সুফিয়া আহমেদ আমাদের হৃদয়ে থাকবেন একজন আদর্শ শিক্ষক হিসেবে। তিনি ছিলেন একজন আদর্শবান ও নীতিবান শিক্ষক। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর বন্ধন কত সুদৃঢ় হতে পারে তা আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাছ থেকে শিখেছি। আমাদের সমাজে শিক্ষককে পিতা-মাতার সাথে তুলনা করা হয়। তিনি সত্যিকার অর্থে ছিলেন শিক্ষার্থীদের মায়ের মতোন। একজন শিক্ষার্থীকে সৎচিন্তায়, সৎপথে ও উদার জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ করা; পেশার প্রতি নিষ্ঠাবান থাকা; সর্বোপরি আদর্শ মানুষ হওয়ার শিক্ষা তিনি তার ছাত্র-ছাত্রীদের সারা জীবন দিয়ে গেছেন। তাঁর মৃত্যুতে আমরা একজন আদর্শ শিক্ষক ও আমাদের সত্যিকারের অভিভাবক হারিয়েছি। জাতীয় অধ্যাপক ড. সুফিয়া আহমেদ-এর আদর্শ অফুরান প্রেরণার উৎস হয়ে আমাদের আলোর পথ দেখাবে।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন