কয়েক বছর আগে একব্যক্তি দুদকের চেয়ারম্যানের কাছে ‘বাবা তুমি ঘুষ খাও’ শিরোনামে চিঠি লিখে তার জীবনের বাস্তব একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন। এই পত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন তার ১২ বছরের মেয়ে তনিমার একটি প্রশ্নের কথা। পাশাপাশি মেয়ের সঙ্গে তার জীবনের অনেক স্মরণীয় ঘটনার অবতারণা করেছেন, যা মনকে আলোড়িত করে। তিনি বলেছেন, একদিন অফিস থেকে বাসায় ফিরে এলে তার আদরের মেয়েটি তাকে প্রশ্ন করে, ‘বাবা তুমি কি ঘুষ খাও?’ মেয়ের এমন প্রশ্ন শুনে তিনি বিস্মিত হন। তার মনে হয় জীবনের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন তিনি। প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না কী বলবেন। প্রশ্নটা তার কাছে সহজ মনে হলেও উত্তরটা ছিল অনেক কঠিন। উত্তরে তিনি বললেন, ‘ঘুষ কি কখনও খাওয়া যায়? এটা তো কোনো খাবার জিনিস নয়।’ কিন্তু মেয়েটি আরও পরিষ্কার করে বলল, ‘তুমি ঘুষ খাও নাকি সেটা জানতে চেয়েছি।’ এর সরাসরি উত্তর চাইল সে। এবার একটা কঠিন ও নির্মম প্রশ্ন করল, ‘বাবা তোমার বেতন কত?’ আর বলতে লাগল- ‘এই যে, তুমি গাড়ি কিনেছ, ফ্ল্যাট কিনেছ- এত টাকা কোথায় পেলে, বাবা? মায়ের এত গহনা কোথায় পেলে? লোকজন বাসায় মিষ্টি আনে, ফলমূল আনে, কিসব প্যাকেট আনে, কেন এসব আনে? বলো না বাবা, তুমি ভয় পাচ্ছ কেন? আমি তো দুদক না। সত্য কথা বলো বাবা। আমি কিছু চাই না, শুধু সত্যটা জানতে চাই। বলো না বাবা, আমি ঘুষখোরের মেয়ে কিনা।’
বাবা ঘুষ খাওয়ার কথা অস্বীকার করলেন। কিন্তু মেয়েটি তা মন থেকে মেনে নিতে পারল না। পরদিন অফিস থেকে ঘরে ফিরে বাবা দেখলেন পোস্টারে লেখা আছে, ‘ঘুষ খাওয়া চলবে না, কোনোমতে ঘুষ না, ঘুষখোরের কন্যা আমি না।’ এরপর থেকে বাবার সঙ্গে মেয়ের সম্পর্কের দূরত্ব বাড়তে থাকে। বাবার দামি গাড়ি সে ব্যবহার করল না। রিকশায় করে সে স্কুলে গেল। কারণ তার মনে হয়েছে এই গাড়ি ঘুষের টাকায় কেনা। পরদিন আবারও দরজায় পোস্টার দেখা গেল। সেখানে কচি হাতের কালো অক্ষরে লেখা ছিল, ‘সাবধান সাবধান ঘরে ঘরে দুদক। ঘুষখোরের কালো হাত ভেঙে দাও। সত্যের বন্যায় ভেসে যাবে অন্যায়।’
এমন আরও অনেক কথা। বাবার গায়ে সে তীব্র একটা ঘুষের গন্ধ পেল। বাবা ভাবছেন আর ভাবছেন। তার মনোজগতে নানা ধরনের চিন্তাধারা তার কপালে অশনি সংকেতের ভাঁজ টেনে দিল। নিজেকে তার চোর বলে মনে হল। বদলে গেল বাবার জীবনধারা। সূত্রপাত হল সততার পথে নতুন জীবনে যাত্রা।
এরপর বাবা চিঠির শেষাংশে লিখেছেন, ‘মেয়েটার হাত ধরে বিকালে হাঁটি। মনে মনে ভাবি আমি এখন ভালো আছি। হেরে গেছি নাকি জিতে গেছি তা বুঝি না। তবে মেয়ে আমার জীবনের নতুন মাত্রার সন্ধান দিয়েছে তা বুঝি।’
এভাবে বদলে যাক অন্ধকারকে আঁকড়ে ধরা মানুষদের জীবন। পিতা যখন সন্তানের কাছে হেরে যায় তখন সেটা পিতার কাছে সবচেয়ে বড় জয় হিসেবে স্বীকৃত হয় | যে জয়ে গ্লানি নেই, আছে বিজয়ের গৌরব। যে কোনো বড় বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে অন্তত একবার হলেও আমরা পরম আদরের সন্তানদের মায়াবী মুখগুলো স্মরণ করি |
হয়তো সে মুখগুলো আমাদের খারাপ কাজ থেকে বিরত রাখবে, ভালো কাজের প্রেরণা যোগাবে। কারণ তাদের জন্য আমাদের তো আলোকিত একটা পৃথিবী রেখে যেতে হবে। যে পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে তারা সততাকে জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করবে | ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সামগ্রিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিবে। দেশপ্রেমকে জীবনের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসেবে ভাববে। আর এভাবেই তারা বদলে দেবে দেশ, বদলে দিবে মানুষের জীবন। পৃথিবীতে যত পরীক্ষা আছে তাদের চেয়ে সব থেকে কঠিন দেশপ্রেমের পরীক্ষা। দেশপ্রেমের পরীক্ষায় পাশ করতে হলে একশোতে একশো পেতে হয়। একশোতে নিরানব্বই বা ৯৯.৯৯৯ পেলেও পাশ করা যায় না। যে বাবার হাত ধরে সন্তান ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে, সে বাবাকে সন্তানরা নায়ক হিসেবে দেখতে চায়। ভিলেন হিসেবে নয়। পৃথিবীর সব বাবার লোকদেখানো নায়ক না হয়ে সন্তানদের চোখে প্রকৃত নায়ক হয়ে উঠুক। সন্তানরাও তাদের সন্তানদের জীবনজয়ের নায়ক হয়ে উঠুক। এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এ ধারা অব্যাহত থেকে সংস্কৃতিতে রূপান্তরিত হোক |
এ বিষয়ে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির জেলেনস্কির একটা পরামর্শ আমাদের মনোজগতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। তিনি তার দেশের প্রত্যেককে নিজের অফিসে তাদের সন্তানদের ছবি ঝোলানোর পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন ‘অফিসে নিজের সন্তানদের ছবি ঝুলান আর যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় সেদিকে তাকান।’
মনস্তত্ব খুব শক্তিশালী অদৃশ্য অস্ত্র যা মানুষের ভিতরে মনুষ্যত্বকে বের করে এনে মানুষকে জীবনবোধের পথ দেখায় | পচনশীলতার আবরণ থেকে বের করে এনে মানুষকে নতুন করে ভাবতে শেখায় | মানুষের মধ্যে অনুশোচনা জাগ্রত করে, মানুষের মধ্যে উপলব্ধির জন্ম দেয়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার মানুষের ধর্ম গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন ‘‘ধর্ম মানেই মনুষ্যত্ব। যেমন আগুনের ধর্ম অগ্নিত্ব, পশুর ধর্ম পশুত্ব, তেমনি মানুষের ধর্ম মানুষের পরিপূর্ণতা" |
মানুষ মানুষের মনুষ্যত্বের শুভবোধ দিয়ে পরিপূর্ণ হোক। একটা প্রাচীন বৃক্ষের শক্ত শেকড় হোক। শেকড়টা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে যতদিন আগুনের পরশমনি হয়ে সততার বীজ বুনে যাবে ততদিন মানুষের পৃথিবীর মৃত্যু হবে না।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা