যে কোনো বিচারেই বাবা দিবসের গুরুত্ব মা দিবসের চেয়ে বেশি নয়। মাকে নিয়ে যত ভালো ভালো কবিতা, গান পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় রচিত হয়েছে, তুলনামূলক বিচারে বাবা নিয়ে তেমন কিছুই হয়নি! কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাকে নিয়ে মর্মস্পর্শী কবিতা, গান রচনা করেছেন, বাবাকে নিয়ে আলাদা কিছু লিখেছেন এরকম আমার অন্তত জানা নেই! দেশের মোটামুটি সব সংবাদ পত্রই বাবা দিবসে নামকাওয়াস্তে কিছু তারকা টাইপ মানুষদের প্রথম বাবা হবার অনুভুতি প্রকাশ করে! খুব ইনিয়ে-বিনিয়ে প্রথম বাবা ডাক শুনতে কেমন লেগেছিল, কেমন লাগে এগুলোই তারকারা বর্ণনা করেন, আমরা পড়ে পুলকিত হই, কেউ কেউ হয়তো তারকাদের অনুভুতির সঙ্গে নিজের বাবা হবার অনুভুতি মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করেন, আমিও সে চেষ্টা করি কিন্তু প্রতিবার নিজের বাবা ডাক শোনার অনুভুতি মনে করার আগে, আমার নিজের বাবার ছবিটা মনের মধ্যে চলে আসে!
বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন পাঁচ বছরের বেশি, তবুও কারো সঙ্গে বাবাকে নিয়ে কথা বলতে গেলে বা যে কোনো আলাপেই বাবা প্রসঙ্গ এলে, আমাকে থামতে হয়, গলা ভারী হয়ে চোখ ভিজে যায়। এক্ষেত্রে সময় অবশ্যই আমার বাবাকে পেছনে ফেলতে পারেনি। আমার বাবা ছিলেন খুব বেশি সাধারণ, আর এখানেই তার অসাধারণত্ব! সব কিছু ছাপিয়ে যে জিনিসটি আমাকে সবচেয়ে বেশি পীড়িত করে তা হলো বাবাকে দেখাতে পারিনি যে তাকে কত ভালবাসি। নিষ্ঠুর প্রবাস জীবন বাবার সান্নিধ্য থেকে আমাকে বঞ্চিত করেছে। আমার প্রতি বাবার যে তীব্র ভালবাসা ছিলো, তা আমি এই সুদুর প্রবাসে বসে প্রতি মুহূর্তে টের পেতাম, মনে মনে আজও আমি তার স্নেহ টের পাই, এটা শুধুই তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক! বাবার সঙ্গে আমার এক ধরনের আলাদা বোঝাপড়া ছিলো, যা আমি বর্ণনা করতে পারছি না, শীর্ষেন্দুর মতো বড় লেখক হলে হয়তো বা অনুভূতিটা লিখতে পারতাম। আফসোস!
ডায়াবেটিস নামক নিষ্ঠুর অসুখটি বাবার কিডনি, লিভার নষ্ট করে দিয়েছিল! খেতে পছন্দ করা মানুষদের জন্য ডায়াবেটিস ভয়ঙ্কর অসুখ। আমার মা আর বোন বাবাকে পাহারা দিয়ে রাখতের যাতে ডায়াবেটিস বেড়ে যায় এমন খাবার তিনি না খেতে পারেন। এই নিয়ে আব্বা টেলিফোনে মাঝে মাঝেই অনুযোগ করতেন, আজ আর অনুযোগ করবার কেউ নেই।
বাবা যেদিন আমাদের ছেড়ে চলে যান সেদিন ছিল পহেলা এপ্রিল। আমাদের সবাইকে যেন এপ্রিল ফুল জানিয়েই তিনি চলে গেলেন। মৃত্যু সংবাদটা মেঝো ভাই ফোনে আমাকে দেয়, সে পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে ঠিক কি বলেছিল আমার মনে নেই, এটুকুই বুঝলাম বাবা নেই! ওর সেই কন্ঠ এখনো আমার কানে লেগে আছে। আগে প্রিয়জনদের কেউ মারা যায়নি। তীব্র শোকের সময় কি করতে হয় জানা নেই, আমি স্বাভাবিক কাজ-কর্ম করতে থাকলাম যেন কিছুই হয়নি। শুধু মনে হচ্ছিল যেভাবেই হোক আমাকে দেশে যেতে হবে, যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, না হলে আম্মাকে বাঁচানো যাবে না!
বিদেশে বহু মানুষের তাৎক্ষণিক দেশে যাবার সামর্থ্য থাকে না, আমারও ছিল না। ভাগ্য সহায় ছিল বলতে হবে, টিকেট সংগ্রহ করলাম, ওইদিন ফ্লাইট ছিল না, পরের দিন যেতে হবে, দেশে গিয়ে নামতে হবে ৩ এপ্রিল ভোরে। ইতোমধ্যে দেশে আমাদের বাসায় আত্মীয়-স্বজনরা গিয়েছেন, কেউ কেউ একজন আমাকে ফোনে জানালেন যে, মৃতদেহ বেশিক্ষণ রাখা ঠিক নয়, ইসলামিক নিয়ম মতে তাড়াতাড়ি কবর দেয়া উত্তম। কিছু মুহূর্ত থাকে যখন নিজের মতামত দেবার অবস্থায় মানুষ থাকে না। আমি শুধু বললাম, ঠিক আছে!
দেশে গিয়ে যখন বাবার কবরের সামনে দাঁড়িয়েছি, বুকভরা কেবল হাহাকার, মানি না এই মৃত্যু! কোনোভাবেই গ্রহণ করতে পারবো না! আমরা কেউ মৃত্যুকে মেনে গ্রহণ করি না, মেনে নেই, উপায় কি আছে মেনে নেয়া ছাড়া? নেই!