আমার আব্বা ছিলেন একাধারে আমার জন্মদাতা এবং আমার জীবনের প্রথম শিক্ষক। আমি যখন সিরাজগঞ্জ কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়তাম সেসময় আব্বা সিরাজগঞ্জ কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। উত্তরবঙ্গের যে’কজন লোক জীবনে অনেক সফলতা পেয়েছেন আব্বা ছিলেন তাদের অন্যতম। উত্তরবঙ্গের মধ্যে আব্বাই প্রথম ছিলেন যিনি বিসিএস ভাইবা বোর্ডের সদস্য। আব্বাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে অনেক কথা মনে পড়ছে। ২২ বছরের সব স্মৃতি লিখে শেষ করা যাবে না। আমার আব্বা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে অনেক স্মৃতিবিজড়িত সময় আজ মনে পড়ছে।
আব্বার নামের আগে এত বিশেষ্য লিখতে গিয়ে আমি নিজেই দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ি কোনটা আগে লিখব আর কোনটা শেষে। আমি সবচেয়ে বেশি গর্ববোধ করি, আমার আব্বা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আব্বা রোভার স্কাউটের বিভাগীয় লিডার ট্রেনার ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। জেলার শ্রেষ্ঠ শিক্ষক ছিলেন পরপর পাঁচবার। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে তার প্রতিটি কাজ করেছেন। রাজহংসের মতো জীবনের সব ক্ষেত্রেই ছিলেন অত্যন্ত সফল। সফলতা যেন আব্বার পদতল ছুঁয়ে ছিল সারা জীবন। সৃষ্টিকর্তা অনেক উদারভাবে সৃষ্টি করেছিলেন আমার আব্বাকে। এত সুদর্শন মানুষ আমি এখনো পর্যন্ত দেখিনি। সুউচ্চ গ্রীবা হলুদ গায়ের রং, বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। আর মনের দিক দিয়ে খুবই আবেগপ্রবণ, বাচ্চাসুলভ ছিলেন। খুব অল্পতে খুশি হতেন আবার সামান্য কিছুতেই খুব কষ্ট পেতেন। এ জন্য আব্বাকে মনের দিক দিয়ে সবসময়ই বাচ্চার মতো মনে হতো। আব্বা যেন আমার চেয়ে বয়সে ছোট। আব্বা ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক ছিলেন। এ জন্য আমাদের তিন ভাইবোনের নামের মধ্যে যেন সাহিত্যের একটা উষ্ণ ছোঁয়া লেগে আছে। মনের দিক থেকে অত্যন্ত ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও আব্বা আমাকে কখনো কোনো কাজে বাধা দেননি।
যেমন ছোটবেলায় আমার আগ্রহ ছিল বরাবরই নিউমেরোলজি পামেষ্টির প্রতি। আব্বাই আমাকে পামেস্টি ফর অল বইটা দিয়েছিলেন। পামেস্টি ফর অল বইটা পড়ে প্রথমে আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না, হাতের লেখাগুলোও ভালোভাবে বুঝতাম না। তখন আব্বাই আমাকে শিখিয়েছিলেন। এভাবে সব সময় আব্বা আমার ইচ্ছাগুলো পূরণ করার আপ্রাণ চেষ্টা করে গেছেন। ছোটবেলায় সাইকেল চালানো থেকে শুরু করে স্কুলে বক্তৃতায় চ্যাম্পিয়ন, রচনা প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অধিকার করা এগুলো আব্বার চেষ্টার জন্যই সম্ভব হয়েছে।
আব্বাকে ছোটবেলায় একদিন বলেছিলাম আপনি এত জানেন কিভাবে? আব্বা তখন হেসে বলেছিলেন আমি তোমার চেয়ে ৪০ বছরের বড়, এ জন্য আমি এত কিছু জানি। ছোটবেলায় মায়ের সঙ্গে আমি একবার নানাবাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম। দুতিনদিন পর সন্ধ্যার সময় বাড়িতে ফেরার পরে দেখি আব্বা আমার একটা ছোট ফ্রক হাতে নিয়ে বারান্দায় বসে আছেন। আব্বা আমাকে দেখে খুশি হয়ে বললেন, তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল এ জন্য ফ্রকটা হাতে নিয়ে বসেছিলাম। আমরা তিন ভাইবোনই মনে করি আব্বার মতো বা পিতা পাওয়া আমাদের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য। আমাদের তিন ভাইবোনের কাছে আমাদের আব্বা হচ্ছেন এক মহামূল্যবান সম্পদ। আজ আব্বা আমার এই লেখাটা পড়লে অনেক কাঁদতেন। আমার মতো প্রতিটি সন্তানের কাছেই তাদের বাবারা সর্বশেষ্ঠ, অন্যন্য, অসাধারণ, অতুলনীয়। কারণ প্রত্যেক বাবারাই সন্তানদের কল্যাণের জন্য নিজের জীবনটা পর্যন্ত উত্সর্গ করে দেন। এ জন্য ‘ফাদারস ডে’তে সব সন্তান ও বাবাদের জানাই ফাদারস ডের শুভেচ্ছা।