একাত্তরের ৭ মার্চে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বাঙালির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ভাষণ-আলোকে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, বাংলাদেশ হচ্ছে কবিতা থেকে উঠে আসা একটি দেশ। এজন্য কবিতাকে বাস্তবতায় নিয়ে আসতে চাই। কবিতার মত সুন্দর দেশে পরিণত করতে চাই বাংলাদেশকে। একটি অমর কবিতা যেমন অনন্তকাল ধরে মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত থাকে, ঠিক একইভাবে একাত্তরের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই ১৮ মিনিটের ভাষণটিও পূর্ব পরিকল্পিত কোন কথা বলে মনে হয়নি। সব কথা তাঁর ভেতর থেকে উঠে এসেছে। যেন তাঁর হৃদয়, তাঁর যে কন্ঠ, এই দুয়ের মধ্যে একটি সংযোগ আছে, রনে তার সবস্মৃতি রয়ে গেছে, আর র্যাম্প দিয়ে সে সমস্ত স্মৃতি বের হচ্ছে, আর কণ্ঠে ছন্দ দিয়ে একটি বজ্র প্রবাহ দিয়ে, বজ্র কণ্ঠ দিয়ে, বজ্র সঙ্গীতে সেটি উচ্চারণ করেছেন। ফলে সৃষ্টিশীলতার এক চরম মোহনায় এসে, কাজী নজরুল ইসলাম যেমন বলেছিলেন, ‘বল বীর বল চির উন্নত মম শির’, ঠিক একইভাবে বঙ্গবন্ধু মাত্র ১৮ মিনিট সময়ের মধ্যে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণটি দিলেন মানুষের স্বাধীনতার জন্য। এটি বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ নয়, মানুষের মুক্তি সংগ্রামে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণের নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ।
‘বিজয়ের সুবর্ণ জয়ন্তী’ উপলক্ষে ১৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নিউইয়র্কে মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের আলোচনা-সমাবেশে নূরুল হুদা আরো বলেন, ১৯৭৩ সালের ১ ডিসেম্বর থেকে বাংলা একাডেমির সাথে যুক্ত থাকার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা রয়েছে আমার। এজন্য প্রবাসী শব্দটিকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে ‘বিশ্ব বাঙালি’ শব্দটি ধারণ করতে চাই। সে তাগিদেই প্রবাসীদের জন্য বাংলা একাডেমির পুরষ্কারটিরও (সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ পুরষ্কার) পুনর্বিন্যাস করবো। আরেকটি কথা বলতে চাই, আপনি প্রবাসী লেখক হিসেবে পুরস্কার পেলেন বলে অন্য কোন ক্যাটাগরিতে পাবেন না সেটি হতে পারে না।
তার যদি যোগ্যতা থাকে তবে অবশ্যই জাতীয় কোন পুরস্কার থেকে প্রবাসীকে বঞ্চিত করা সমীচিন হবে না। অতএব, কাউকে ছোট পুরস্কার আবার কাউকে বড় পুরস্কারে ভূষিত করা-টিকে আমি মেনে নিতে চাই না। যুক্তরাষ্ট্র্রে বসে আমি বলতে চাই যে, আমাদের যাত্রা হবে যুক্ত যাত্রা, আর মুক্তধারার এই অনুষ্ঠান থেকে বলতে চাই সে যাত্রা অবশ্যই মুক্ত যাত্রায় পরিণত হবে। তাই আমি মনে করি প্রবাসী বলে কিছু নেই। আমরা সবাই বিশ্ব বাঙালি। বাংলা ভাষার যে কোন লেখককে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে গুণগত মানের বিবেচনায় দেখা উচিত।
নূরুল হুদা আরো বলেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। আমি মনে করি এটি স্বাধীনতারও শতবর্ষ। কারণ বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, তাই আমি মনে করি, যেদিন তিনি জন্মগ্রহণ করেছেন সেদিনই বাংলাদেশের স্বাধীনতার শুরু।
অনুষ্ঠানের অপর অতিথি বক্তা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অনন্য গাঁথা মুক্তির গানের চিত্রগ্রাহক লিয়ার লেভিন বাঙালিদের অতিথি পরায়নতা এবং গভীর কৃতজ্ঞতা প্রসঙ্গে বলেন, আমেরিকায় ভাল কাজের লোকটির কথা প্রায়ই আমেরিকানরা ভুলে যায়। কিন্তু বাঙালিরা ব্যতিক্রম। তারা কখনো ভুলেন না। যুগের পর যুগ একই আবেগে জড়িয়ে ধরেন ভালো কাজের মানুষটিকে। এজন্য আমি বাঙালির প্রতি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ। ডাকলেই চলে আসি একাত্তরের স্মৃতিচারণ করতে। আর এজন্যেই ‘জয়বাংলা’ স্লোগানকে হৃদয়ে লালন করি সব সময়। এক পর্যায়ে তিনি অনুষ্ঠানে উচ্চকণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে নেতৃত্ব দিলেন।
৫০ বছর আগের স্মৃতিচারণকালে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ৬ সপ্তাহে ৭২ ঘণ্টা তথ্যচিত্রের ভিডিও ধারণ করার পর লিয়ার লেভিন ভারতে গ্রেফতার হন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে তাঁকে ভারত এবং বাংলাদেশ ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এক সপ্তাহ কারাবাস শেষে সহকর্মীসহ লিয়ার লেভিনকে ভারত ত্যাগ করতে হয়। কারণ হিসেবে প্রবীন এই চিত্র নির্মাতা ও পরিচালক বলেন, বাঙালির স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল মার্কিন সরকার। আমি একজন আমেরিকান হিসেবে হয়তো একই আচরণে লিপ্ত হতে পারি। সেজন্যে বিজয়ের কদিন আগে মিত্র বাহিনীর অপারেশনের ঘটনাবলি যাতে প্রত্যক্ষ না করতে পারি সেজন্যে আমাকে সেই এলাকা ছাড়ার নির্দেশ জারি করা হয়েছিল। একারণে ৭২ ঘণ্টায় থেমে যায় মুক্তির গানের মত দুর্লভ ভিডিও চিত্র। তিনি বলেন যে, তাঁর তৈরী ‘জয়বাংলা’ তথ্যচিত্র আজো আলোর মুখ দেখেনি। এজন্যে তিনি মনোকষ্টে রয়েছেন।
মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও বিশ্বজিত সাহা এবং ফাউন্ডেশনের সদস্য সউদ চৌধুরীর যৌথ সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এই সভায় আরো বক্তব্য রাখেন প্রাবন্ধিক-গবেষক আহমাদ মাযহার। শুরুতে মুক্তিযুদ্ধের মার্কিন বন্ধু লিয়ার লেভিনকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানান শহীদ পরিবারের সদস্য জাকিয়া ফাহিম এবং কবি নূরুল হুদাকে ফুল দিয়ে অভিবাদন জানান লেখক আদনান সেয়দ। দেড়ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানের শেষে ছিল সংক্ষিপ্ত প্রশ্নোত্তর পর্ব। এই পর্বে অংশগ্রহণ করেন কবি ও কলামিস্ট ফকির ইলিয়াস ও লেখক-সাংবাদিক সাঈদ-উর রব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের জন্য মুক্তধারা ফাউন্ডেশন ২০১৬ সাল থেকে যে কর্মসূচী পালন করে আসছে তারই সর্বশেষ অনুষ্ঠান ছিল ১৯ ডিসেম্বরের এই অনুষ্ঠানটি। এই ৬ বছরের পথ পরিক্রমায় মুক্তধারা ফাউন্ডেশন কোভিড অতিমারির আগের ৪ বছর (২০১৬-২০১৯) একটানা মূলধারার রাজনীতিকদের অংশগ্রহণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস শোভাযাত্রার আয়োজন করে এসেছে। ২৬ মার্চ ২০২১কে নিউইয়র্ক স্টেটের আইন পরিষদ কর্তৃক ‘বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেটস ডে’ ঘোষণার রেজুলেশন পাশ ছিল মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রচেষ্টার এক গৌরবোজ্বল অর্জন।
বিডি-প্রতিদিন/সালাহ উদ্দীন