সংস্কৃতির রাজধানী খ্যাত বাংলাদেশের একমাত্র আবাসিক উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি বাংলাদেশের গৌরবময় ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিষ্ঠিত কিছু ভাস্কর্য যেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্যকে আরো বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অযত্ন, অবহেলা আর শিক্ষার্থীদের অসচেনতার কারণে প্রতিনিয়ত জৌলুস হারাচ্ছে এই তাৎপর্যময় ভাস্কর্যগুলো।
সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনের 'অমর একুশে', কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনের 'সংশপ্তক', ও 'কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার' ছাড়াও চৌরঙ্গীর মোড়ে অবস্থিত 'পদ্মফোয়ারা'র বর্তমানে বেহাল দশা। এ বিষয়ে একাধিকবার বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষন করলেও এ অবস্থার কোনো উন্নতিই চোখে পড়ছে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতে সবার প্রথমেই চোখে পড়বে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনের মহান ভাষা আন্দোলনের প্রতীক 'অমর একুশে' ভাস্কর্যটি। ভাষা আন্দোলনের প্রতিবাদী মিছিলে শত্রুর গুলিতে মায়ের কোল ভেঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে বাংলার এক দামাল ছেলে- এমনই এক চিত্রকে অতি সযত্নে ফুটিয়ে তুলেছেন ভাস্কর জাহানারা পারভীন। ১৯৯১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠিত হয় এই ভাস্কর্যটি। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংস্কারের অভাবে এটির এখন বেহাল দশা। ভাস্কর্যটির জন্য এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের গর্বের প্রতীক হলেও অযত্ন-অবহেলায় দীর্ঘ দিন ধরে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে এটি। খসে পড়তে শুরু করেছে এর বিভিন্ন অংশের পলেস্তার। স্থাপন করার ২৬ বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি নকশানুযায়ী পুরো প্রকল্পের কাজ। রং জ্তলে গিয়ে কালো বর্ণ ধারণ করার পাশাপাশি মায়ের অাঁচলের পলেস্তার খসে বেরিয়ে পড়েছে এর ভেতরের রড। ভাস্কর্যটির বেদীতে যত্রতত্র লাগানো হচ্ছে পোস্টার।
এদিকে, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে শত্রুর নির্মম আঘাতে এক হাত ও এক পা হারিয়েও প্রাণপণ লড়ে যাচ্ছে বাংলার স্বধীনচেতা বীর যোদ্ধারা এমনই এক চিত্রকে তুলে ধরা হয়েছে জাবির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাস্কর্য 'সংশপ্তক'র মধ্য দিয়ে। পরাজয় নিশ্চিত জেনেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত লড়ে যায় যে বীর সেইতো সংশপ্তক। ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান এমন দৃশ্যকে জীবন্ত করে তুলেছেন ব্রোঞ্জ নির্মিত এই ভাস্কর্যের গায়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে ১৯৯০ সালের ২৬ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয় এই প্রেরণাদায়ক ভাস্কর্যটি। অথচ 'অমর একুশে'র মতই প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংস্কারের অভাবে এটিও হারিয়েছে তার প্রতিষ্ঠাকালীন রূপ।
অন্যদিকে, স্থপতি রবিউল হুসাইনের অসাধারণ নকশায় ২০০৬ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শহীদ মিনারটি প্রতিষ্ঠিত হয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনকে ভিত্তি করে ৫২ ফুট ব্যাসের ভিত্তিমঞ্চের উপর এবং ১৯৭১ সালে গৌরবময় স্বাধীনতা অর্জনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা ৭১ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন এই ভাস্কর্যটি বহন করে চলেছে বাংলা ও বাঙ্গালি ইতিহাসের আরো অনেক গৌরবময় ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকে। সংস্কারের প্রয়োজন না পড়লেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অবহেলা আর শিক্ষার্থী ও ক্যাম্পাসে ঘুরতে আসা দর্শণার্থীদের অসচেতনতার ফলে অমর্যাদার শিকার হচ্ছে ভাস্কর্যটি। জুতা পায়ে ভাস্কর্যটির মূল বেদীতে উঠা নিষেধ থাকলেও বাস্তবে এর উল্টো চিত্রটাই চোখে পড়ে প্রতিনিয়ত। ভাষা আন্দোলনের এ মাসেও অমর্যাদায় রয়েছে এ মিনারটি। প্রতিনিয়তই এর মুল বেদীতে জুতা পায়ে উঠছেন অসচেতন শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীরা। এছাড়া শিক্ষার্থী ও ঘুরতে আসা দর্শণার্থীদের ব্যবহার্য জিনিস যেমন বাদামের খোসা, খাবারের প্যাকেট, টিস্যু পেপার, ঠোঙ্গা ইত্যাদি আবর্জনা প্রায় প্রতিদিনই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে এর বেদীতে উঠার সিড়িগুলোতে। এদিকে ক্যাম্পাসের সৌন্দর্য বৃদ্ধিকারী আরেকটি নান্দনিক স্থাপত্য হচ্ছে চৌরঙ্গীর মোড়ে অবস্থিত পদ্মপুকুরের মাঝের পদ্মফুল আকৃতির পানির ফোয়ারা। উপাচার্যের বাসভবনের নিকটে হওয়া সত্তেও এটিরও এখন করুণ দশা। প্রায় ১৫ লক্ষাধিক টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই ফোয়ারার সবগুলো নল থেকে পানি প্রবাহিত আর রাতের বেলা রঙিন আলো বিচ্ছুরিত হওয়ার কথা থাকলেও বহুদিন থেকেই সেটি হচ্ছে না। ২০১৩ সালে নির্মিত হওয়া এ ভার্স্কযটির এখন বেহাল দশা।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার আবু বকর সিদ্দিক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'অমর একুশে ভাস্কর্যটির মূল নকশার কাজ এখনো অসমাপ্ত রয়েছে। নকশার কাজ শেষ ও সংস্কারের জন্য প্রায় ২৫ লাখ টাকার প্রয়োজন। সরকারি অনুদান পেলেই আমরা কাজ শুরু করবো। এদিকে শহীদ মিনারে অমর্যাদার কথা জানতে চাইলে তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, 'আমরা সচেতনতার জন্য শহীদ মিনারের পাশে সাইনবোর্ডের ব্যবস্থা করেছি। এতেও যদি শিক্ষার্থী ও দর্শনার্থীরা সচেতন না হয় তা খুবই হতাশাজনক।'
বিডি-প্রতিদিন/২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬/শরীফ